ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভোরে শোনা যায় না গাছিদের হাঁকডাক

প্রকাশিত: ০৭:৫৯, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

ভোরে শোনা যায় না  গাছিদের হাঁকডাক

শীতের ঐতিহ্য মিষ্টি খেজুর রসের স্বাদ ভুলতে বসেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। আগের মতো এখন আর বাজারে পাওয়া যায় না খেজুর গুড়ের মন মাতানো সেই ঘ্রাণ। পল্লী এলাকায় শিশির ভেজা ভোরে এখন আর শোনা যায় না শিয়ালীদের (খেজুর রস বিক্রেতা) হাঁকডাক। ইট ভাঁটিতে অবাধে খেজুর গাছ পোড়ানোর ফলে খেজুর গাছ বিলুপ্ত হতে চলেছে। যে কারণে রসের পিঠা পায়েস দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য এখন শুধুই স্মৃতি। গত কয়েক বছর আগেও শীতের সকালে এ অঞ্চলের পল্লী গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙত শিয়ালীর (রস বিক্রেতার) হাঁকডাকে। এখন আর সেই ডাক শুনতে পাওয়া যায় না। শীত মৌসুমে গ্রাম্য হাট-বাজারে খেজুর গুড়ের মন মাতানো সেই ঘ্রাণ এখন আর পাওয়া যায় না। বর্তমানে যশোর এলাকা থেকে আসা চিনি মেশানো ভেজাল নিম্নমানের ঝোলাগুড় দক্ষিণাঞ্চলের হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে খেজুর গুড় হিসেবে। সেই ভেজাল গুড়ে রসনা তৃপ্ত করছেন এ অঞ্চলের মানুষ। এক সময়ে অধিকাংশ কৃষক তার কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি জমির আইলে বেড়ে ওঠা খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে শীত মৌসুমে বাড়তি রোজগার করতেন। বিশেষ কৌশলে খেজুর গাছ থেকে যারা রস সংগ্রহ করতেন তাদের স্থানীয় ভাষার বলা হতো শিয়ালী বা গাছি। রস সংগ্রহের জন্য কার্তিক মাস থেকেই শুরু হতো প্রস্তুতি। অগ্রহায়ণের শুরু থেকে নিয়মিত রস সংগ্রহ করা হতো। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রসের স্বাদ বেড়ে যেত। চৈত্রের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রস পাওয়া যেত। শীতের রাতে খেজুর রস খাওয়ার শৈশবের স্মৃতি এখনও মনে করেন অনেকে। কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছে ঝুলে রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকতেন গাছিরা। খেজুর রস সংগ্রহ করে আমন চালের পিঠা, পুলি ও পায়েস তৈরির ধুম পড়ত গ্রামীণ জনপদে। তাছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিরার মোয়া ও মুড়ি খাওয়ার জন্য কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে শীতের মৌসুম অতিপ্রিয় হয়ে উঠত। তাই তো শীতের ভরা মৌসুমের আগেই গাছিরা মাটির হাঁড়ি, দা ক্রয় করে সকল প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। পাশাপাশি খেজুর রস দিয়ে গুড় বানানোর জন্য বাড়ির উঠানে তৈরি করা হতো মাটির সু-বিশাল চুলা। সেসব এখন অনেকটাই স্মৃতি। একটি বেসরকারী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের ছয় লাখ খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হতো। রসদিয়ে পিঠা পায়েস খাওয়ার পাশাপাশি প্রায় ছয়’শ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন করা হতো। ১৯৯৪ পরবর্তী সময় থেকে এ অঞ্চলের ইট ভাঁটিতে ইট পোড়ানোর জন্য খেজুরগাছ নিধন শুরু হয়। কমদামে অধিকাংশ খেজুর গাছ ইট ভাঁটির বলি হয়। এরপর থেকে ক্রমেই খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে খেজুর রস কমতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এখন তা বিলুপ্ত হওয়ার পথে। বাবুগঞ্জের আগরপুর গ্রামের শিয়ালী সিরাজুল ইসলাম জানান, আগে তিনি শীত মৌসুমে ৩০ থেকে ৪০টি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতেন। সংগৃহীত রস দিয়ে পিঠা, পায়েস খাওয়ার পাশাপাশি গুড় তৈরি করে বছরে প্রায় ১৫/২০ হাজার টাকা আয় করতেন। কিন্তু এখন সেই খেজুর গাছ না থাকায় শীত মৌসুমে রস সংগ্রহ করতে পারছেন না। পরিবেশবিদদের মতে, খেজুর গাছ পরিবেশ ও ভূমিরক্ষায় খুব উপকারী। সামান্য স্বার্থে উপকারী গাছটিকে নিধন করে পক্ষান্তরে ক্ষতি করা হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় এবং রসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য তারা সরকারী উদ্যোগে রাস্তার পাশে খেজুর গাছ লাগানোর জোর দাবি করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার যেসব খেজুর গাছ রয়েছে তা থেকেই শীত মৌসুমে গাছিরা রস সংগ্রহ শুরু করেছেন। ফলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষকে ঘিরে গ্রামীণ জনপদে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। খেজুর রস দিয়ে তৈরি গুড়, পাটালি, পিঠা ও পায়েস নিয়ে গ্রামীণ জনপদে অতিথি আপ্যায়নের ধুম পড়ত। আগেকার মতো গ্রামীণ জনপদে খেজুর রসের দানা গুড়, ঝোলা গুড় ও নলেন গুড়ের মৌ মৌ গন্ধ না থাকলেও যে রস, গুড় ও পাটালি পাওয়া যায় তা নিয়েই শীত মৌসুমে রীতিমতো শুরু হয়েছে কাড়াকাড়ি। আগে এক হাঁড়ি খেজুর রস ৩০ থেকে ৪০ টাকা দামে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। -খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতি শীত ও খেজুরের রস। এ দুয়ের সঙ্গে গভীর একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে বর্তমান গ্রাম-বাংলায় এ সম্পর্ক ক্রমেই কমে যচ্ছে। একটা সময় ছিল গ্রামাঞ্চলের নারীরা খেজুরের রস দিয়ে নানা ধরনের পিঠা তৈরি করতেন। এখনও কিছু থাকলেও কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। খেজুরের রসের ফিরনি, রকমারি পিঠা-পুলি, পায়েস, পাটালি গুড়, লালি ও দানা গুড় অনেকেরই প্রিয়। সীতাকু-ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা মিরসরাই ও ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের কোন কোন এলাকায় খেজুরের রস পাওয়া যায়। রস নামার শুরুর পর থেকে গ্রামে চলে এসব খাওয়ার ধুম। অতিথি আপ্যায়নেও এর কদর রয়েছে বেশ। তবে জেলার অন্য কোথাও খেজুরের রস না পাওয়ায় গুড়ের প্রতি ঝুঁকছেন শহরের বাসিন্দারা। শহরের বড় বাজার ঘুরে জানা গেছে, পাটাগুড়, হাজারী গুড়, মছু মিঠাই, তত্বই মিঠাইসহ নানা জাতের গুড় দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন রকমের পিঠা-পুলি। তবে ক্রেতাদের কাছে পাটাগুড় আর হাজারী গুড়ের চাহিদা বেশি বলে জানালেন বিক্রেতারা। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খেজুরের গুড় আনা হয়। মছু মিঠাই, তত্বই মিঠাই কেজি প্রতি প্রকারভেদে ১০০ থেকে ৭০ টাকা, পাটাগুড় ১২০ থেকে ১০০ টাকা, হাজারী গুড় ১২০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সীতাকু- উপজেলার ভাটেরিখিল এলাকার আবুল খায়ের নামে এক বিক্রেতা জানান, খেজুরের রস দিন দিন হারিয়ে যেতে বসায় গুড় দিয়ে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। গৃহিণী নাসরিন সুলতানা জানান, আগের মতো প্রয়োজনের তুলনায় খেজুরের রস না পাওয়ায় গুড় দিয়ে পিঠা-পুলি তৈরি করতে হয়। এসব পিঠা-পুলি সুস্বাদু হওয়ায় পরিবারের সবার পছন্দ।’ সীতাকু-ের উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, স্বল্প পরিসরে হলেও আজও গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস। কুয়াশা-মোড়া প্রভাতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে রস নামানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন গ্রামাঞ্চলের গাছিরা। মুরাদপুর ইউনিয়নের বসতনগর উপকূলীয় এলাকার মাসুদ বলেন, ‘প্রতিবছর কার্তিক (অক্টোবর-নবেম্বর) মাস থেকে গাছকে রসের জন্য প্রস্তুত করতে থাকি আমরা। মাঘ-ফাল্গুন (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ) মাসে রস সংগ্রহ করি। প্রতি কলস রস প্রকার ভেদে ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা মূল্যে বিক্রি করি। আবার কেউ কেউ প্রতি কেজি রস ৩০/৪০ টাকা দরে বিক্রি করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন, সবাই কর্মব্যস্ত ও শহরমুখী হওয়ায় খেজুরের রসের সঙ্গে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য, গৌরব আর সংস্কৃতিও হারিয়ে যেতে বসেছে। সেদিন আর বেশি দূরে নেই, খেজুরের রস যেদিন ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় অনেক দূর-দূরান্ত থেকে লোক খেজুর গাছের সামনে গিয়ে বসে থাকত, আমরা কখন রস নামাব, আর একটু কাঁচা রস খাওয়া যাবে। কিন্তু বর্তমানে দেশের কোন কোন জায়গায় কাঁচা রস খেলে নিপা ভাইরাস নামে একটা রোগ হবে বলাতে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে আর কেউ কাঁচা রস খেতে চায় না।’ -জাহেদুল আনোয়ার চৌধুরী, সীতাকু- থেকে মাগুরার পাটালি গুড়ের গ্রাম মাগুরার গ্রামে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তা জ্বালিয়ে পাটালি গুড় তৈরি করে অর্ধ শতাধিক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। জেলার বিভিন্ন গ্রামে শীত মৌসুমে খেজুরগাছ কেটে রস সংগ্রহ করছে অর্ধ শতাধিক গাছি। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে জেলায় ২৬ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। অর্ধশতাধিক পরিবার খেজুর গাছ কেটে রস জ্বালিয়ে পাটালি গুড় তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। প্রতি হাঁড়ি কাঁচা রস দুই শ’ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। অন্যদিকে রস জ্বালিয়ে পাটালি গুড় তৈরি করা হচ্ছে। প্রতি হাঁড়ি রস থেকে প্রায় এক কেজি গুড় তৈরি করা হয়। প্রতি কেজি গুড় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। শীত মৌসুমে পিঠা পায়েস খাওয়ার জন্য খেজুর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। নড়িহাটি গ্রামের গাছি কায়েম আলী জানান, তিনি এ বছর ৯৭টি গাছ কেটে রস সংগ্রহ করছেন। প্রতিদিন ১৫টি খেজুর গাছ কেটে ৪ হাঁড়ি করে রস পান। এই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করা হয়। বাজারে পাটালির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতি কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা করে বিক্রি হয়। একজন গাছি প্রতিদিন ৪-৫শ’ টাকা আয় করে থাকেন। মহিলা রস জ্বালিয়ে থাকেন। জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করা হয় খেজুর গাছের পাতা। জেলার চারটি উপজেলায় প্রায় অর্ধশত পরিবারের মৌসুমী কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তারা রস সংগ্রহ ও গুড় পাটালি তৈরি করে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করছেন। -সঞ্জয় রায় চৌধুরী, মাগুরা থেকে
×