ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক দেশে এক মানুষ ছিল

প্রকাশিত: ১২:১৯, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

এক দেশে এক মানুষ ছিল

রূপুর সারা শরীরে ব্যথা। পাশ ফিরতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট। দু’দিন হলো জন্ম নেয়া একটা শিশু তার পাশে শুয়ে। নার্স একবার দেখে গেছে। কর্কশ কণ্ঠে বলে গেছে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা কর নইলে বুকে দুধ আসবে না। রূপু জানে শালদুধ শিশুর জন্য ভাল। মনে হচ্ছে সেটুকুও শরীরে নেই। বাচ্চারে তুলে বুকের কাছে নেয়ার সামর্থ্য রূপুর নেই। সরকারী হাসপাতালে ওয়ার্ডের মেঝেতে এক কোনে রূপু আর তার ছোট্ট শিশুটা শুয়ে আছে। শ্বাস নিচ্ছে, ট্যা ট্যা করে কেঁদে জানান দিচ্ছে সে এসেছে। পৃথিবীতে এসেছে। অথচ কোথাও কোন মমতার স্পর্শ যেন নেই এই পৃথিবীতে। যে কোন জন্মেরই উৎসব থাকে। অথচ সে উৎসবের দেখা সবাই পায় না। রূপুর পাশে তার মায়ের থাকার কথা ছিল। তার শাশুড়ির থাকার কথা ছিল। বিভিন্ন ননদ দেবর ভাবিকুলের ফলমূল হরলিক্স নিয়ে পাশে এসে সেবা করার কথা ছিল। তারা নেই। তারা কেউ পাশে নেই। কেন নেই সে সব ভাবতে রূপুর ভাল লাগে না। সে মোমেন আলীকে ভাবে। যে মোমেন আলীর অর্থ নেই বিত্ত নেই, বুকে আগলে রাখার মত শক্ত চওড়া বুক নেই, অথচ ভালবাসার মতো তীব্র এক শক্তি আছে? এই এক শক্তির জন্যই মোমেন আলী ধর্ম ছেড়ে পরিবার ছেড়ে নিজের বাপের দেয়া নাম ছেড়ে নিজের সমস্ত নিয়ে রূপুর হয়ে গেছে। চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকায় রূপু। সব শিশুর পাশে মায়ের সঙ্গেও কেউ না কেউ আছে। কেউ কলা ছিলে মাকে খাইয়ে দিচ্ছে। কেউ শিশুকে ধরছে বুকের কাছে। রূপুর গায়ে এক ফোটা শক্তি নেই আড়াই কেজি ওজনের শিশুটিকে বুকের ওপর তুলে মুখে খাবার তুলে দেয়। সিজারের কষ্ট, অপুষ্টির কষ্ট, মানসিক দুর্বলতার সমস্ত সুযোগ নিয়ে রূপুকে এই জীবন দুর্বল থেকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। পাশে পড়ে আছে সকালের দেয়া পাউরুটি, কলা, সেদ্ধ ডিম। রূপুর চোখ ফেটে কান্না আসে। কেউ আসুক। বুকের ওপর শিশুটিকে তুলে দিক। স্যালাইন লাগানো হাতটা দিয়েই সে তার বুকের মানিককে বুকে ধরে রাখবে। কেউ আসুক। মোমেন আলী কোথায় কোথায় ঘুরছে কে জানে। আহারে লোকটার খাওয়ার ঠিক নাই। যতেœর ঠিক নেই। নিশ্চয় সকাল থেকে কিছু খায় নাই। একবার আসলে তো পাউরুটি কলাটাই মোমেন আলী খেতে পারত। মোমেন আলী হন্যে হয়ে ঘুরছে। পরিচিত বিভিন্ন দ্বারে হাত পাতছে। সরকারী হসপিটাল বলে সামান্য খরচে সিজার সম্ভব হয়েছে। সিজারের পুরো টাকাটা সে তার সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙ্গে মিটিয়ে দিতে পেরেছে। কিন্তু ওষুধ? এত দামি দামি ওষুধ, আরও আনুষঙ্গিক খরচ আরও টাকা আরও টাকা কোথায় পাবে মোমেন আলী? বংশ পরম্পরায় মুচির কাজটাই শিখেছিল। যখন সে মোমিন আলী হয়ে ওঠেনি, রূপুকে ভালবাসার আগে তার সামান্য মুচির কাজেই তো দিব্যি চলে যেত। একটা ছাপড়া ঘরের পাশেই তার জুতা পালিশের ছোট আখড়া। এই ঘরটায় রূপু এসে উঠবে। তার সাত রাজার ধন ভালবাসার পুত্র এসে উঠবে। অথচ এক কোনা দিয়ে বাতাস ঢুকছে। একটা পলিথিন দিয়ে ঘেরা জরুরী। একটা ছোট্ট মশারি। একটা দুধ খাওয়ার ফিডার। সামনে বাড়িটায় দোতলা উঠছে। ওদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মোমেন আলী ভাবে খালাম্মা দিল দরিয়া মানুষ। চাইলে কি আর ফেরাবে? কিছু তো দেবেই। কতবার কত কিছু করে দিয়েছে মোমেন। গাছের ডাব পেড়ে দিয়েছে। ইটের গাড়ি নরম মাটিতে ঢুকে গেছিল, সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে তো গাড়িটা গর্ত থেকে উঠিয়েছে। যে কোন বিপদে বুক চিতিয়ে যেতে পারে সে, এই বিপদে খালাম্মা কি তাকে একটু সাহায্য করবে না? -বাচ্চা পালতে পারবা না তো বাচ্চা নিসো কেন? খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই বিয়া করাই তো অন্যায় হইসে। দেখতে সেই তো বাড়ির কাজ চলতেসে। ১০০ টাকা ধরো। যাও। বিরক্ত করিও না। মোমেন আলীর মাথা নিচু থেকে আরও নিচু হয়ে যায়। লজ্জায়। অপমানে। মনে হতে থাকে আসলেই তো! পৃথিবীতে ভালবাসা খুবই অদরকারি জিনিস। কি দরকার ছিল বুকের মানিক নিয়া স্বপ্ন দেখার। লজ্জা করে খুব লজ্জা করে মোমেন আলীর। আট দশজন হিজড়া ঢোকে। -কি মা জননী বাড়ি তুলতেসেন। আমাদের তো ভুললে বাড়ির ইটে চিহ্ন রাইখা যামু। পেছনের দুজন তালি মারতে থাকে। আরেকজন বুকের কাপড় খুইলা দাঁড়ায়। পেট দেখায়া বলে বুক হইয়া পেটে যে খাদ্য যাইব মা জননী টাকা না দিলে কেমনে! কিছুক্ষণ এক হাজার দু’ হাজার তিন হাজার নানা রকম তর্ক-বিতর্ক শেষে মা জননী চার হাজার টাকা হাতে তুলে দিয়ে হিজড়া বিদায় করে। মোমেন আলীর ঠোঁটের কোনায় থুতু জমা হয়। গিলতে গিলতে ভাবে শালার হিজড়া হলেই তো ভাল করতাম!
×