ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহীন রেজা

নক্ষত্রের একাকি যাত্রা

প্রকাশিত: ১২:১৯, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

নক্ষত্রের একাকি যাত্রা

“আমরা ম’রে গিয়ে কি বাতাসের সঙ্গে মিশে যাই মৃত্যু মানে কি এক জ্যোতির্ময় অন্ধকার থেকে অন্য এক অন্ধকারময় জ্যোতির দিকে নিঃসঙ্গ একান্ত যাত্রা” (মরণোত্তর রক্ত কনিকায়) ম’রে গিয়ে তিনি বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছেন কিনা জানিনা। এক অন্ধকারময় জ্যোতির দিকে নিঃসঙ্গ একাকী একান্ত যাত্রা তাঁর হয়েছে কিনা তাও জানিনা- শুধু এটুকু জানি তিনি নেই’ পৃথিবীর সকল বন্ধন ছিন্ন করে তিনি শেষ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন মৃত্তিকায়। মানুষ ম’রে গেলে কী হয়? মৃত্যু কি শুধুই সমাপ্তিÑ এ প্রশ্ন ছিল তাঁর। তিনি জানতে চেয়েছিলেন মৃত্যুর যাত্রা কি শুধুই অনন্ত যাত্রা নাকি এটি জীবনের নতুন উদ্বোধন? তিনি তাঁর কবিতায় এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন একান্তভাবে। কিন্তু রহস্য থেকেই গেছে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্যলোকে যাত্রার মাধ্যমে তিনি তাঁর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন কিনা আমরা জানিনা। শুধু জানি তিনি এখন আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতি, শুধুই কান্না। আমরা তাঁকে আর কখনও ফিরে পাবোনাÑ না কবিতায়, না আড্ডায়। কেউ আমাদের নিয়ে যাবেনা বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে সেই কেরানীগঞ্জে অথবা আফতাব নগরের ভিতরে ফুটে থাকা থরে থরে সাদা কাশবনের সেই নিবিড় অরণ্যে। আমরা আর কখনো চা খাবোনা ফুটপাতে বসে অথবা প্রেসক্লাবের ক্যাফেটরিয়ায়। ভেঙ্গে ফেলা সেই হারুন এন্টারপ্রাইজের অফিসে কোন দুপুর আর মৌ মৌ হয়ে উঠবেনা তার বাসা থেকে নিয়ে আসা সেই ভাত ও সালুনের ঘ্রাণে। বলছিলাম ফজল শাহাবুদ্দীনের কথা। আমাদের প্রিয় ফজল ভাই। ৭৭-এ এসেও যিনি ছিলেন তরুণ তুর্কী। আসর মাতিয়ে রাখতে যার জুড়ি ছিলনা। আড্ডা কিংবা আলাপে একাই বলে যেতেন অনর্গল। যুক্তির বিপরীতে যুক্তি কিংবা কথার বিপরীতে কথা ছুঁড়ে দেয়াতেই যেন তার আনন্দ। আর সেই আনন্দে মশগুল হতে কি যে নিবিড় একাগ্রতা। আড্ডাবাজ ফজল ভাইয়ের আড্ডাতেও ছিল ভিন্ন রং, ভিন্ন আমেজ। তার ছুটে চলা কথা বলা সবকিছুতেই যেন এক স্বপ্নের ছায়া, এক আকাংখিত সুন্দরের আর্তনাদ। তিনি যখন বলতেন তখন তাঁর মধ্য থেকে এক অসম্ভব অসাধারণ জ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটতোÑ যা সৃষ্টি করতো এক অমোঘ সম্মোহনের। ফজল ভাইয়ের আড্ডা মানেই অনিবার্যভাবে কবিতা। কি নেই তাতে। বোদলেয়র, কীটস্ থেকে শুরু করে জীবনানন্দ এমনকি সতীর্থ শামসুর রাহমান অথবা আল মাহমুদও উঠে আসতেন অবলীলায়। উঠে আসতেন কবিতার তরুণতম ব্যক্তিটিও। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দকে ছাপিয়ে শুধু কবিতার জন্য কাউকে স্বীকৃতি বা ধন্যবাদ জানানোর উদাহরণ যেন ফজল শাহাবুদ্দীনেই সম্ভব। যারা তাকে চিনতেন তারা নির্দ্বিধায় এ সত্যটিকে স্পর্শ করবেন। ফজল শাহাবুদ্দীন কেমন কবি ছিলেনÑ কি ছিলো তার কবিতার প্রতিপাদ্য বিষয়Ñ এসব এ লেখার প্রসঙ্গ নয়। এ লেখাটি প্রয়াত কবির প্রতি একজন অনুজ কবি, যাকে তিনি অকাতরে সতীর্থ নামক এক ‘মায়া-শৃঙ্খলে’ আবদ্ধ করেছিলেনÑ এটি শুধু তার শ্রদ্ধাচারণ মাত্র। ফজল শাহাবুদ্দীন খেতে ভালোবাসতেনÑ খাওয়াতেও। তার এই খাওয়ানোর বাতিকে আজমিরী ভাবীরও সমর্থন ছিলো। তা নাহলে সময় নেই অসময় নেই বাউন্ডুলে অভুক্ত কবিদের পেট শান্ত করার দুরূহ কর্ম ফজল ভাইয়ের একার পক্ষে কি সম্ভব হতো? দুপুর হয়েছে অথচ ফজল ভাইয়ের বাসা থেকে কেউ না খেয়ে চলে এসেছে এমন কোন উদাহরণ আমাদের জানা নেই। ফজল শাহাবুদ্দীন একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘আমরা কেউ মরিনা’। সত্যিই তো দেহের বিনাশ আছেÑ কিন্তু কর্মের? কর্মের মধ্য দিয়েই একজন মানুষের বেঁচে থাকা। একজন মানুষ কমর্ দিয়েই স্থান গাড়েন অন্যের হৃদয়ে। তারপর স্মৃতি হন। ইতিহাস হন। ফজল ভাই এখন আমাদের কাছে শুধুই স্মৃতিÑশুধু এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। যে ইতিহাস আমাদের নিয়ত সঙ্গী। আনন্দ ও বেদনায়, শীতে ও বর্ষায় যা আমাদের কখনো ভারাক্রান্ত করবে আবার কখনো উষ্ম। আর এরই মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাবে সময় এবং একসময় আমরাও পরিণত হবো ইতিহাসে। বেইলী রোডের ‘বৈচিত্র’ অফিস ফজল ভাইয়ের খুব প্রিয় ছিল। সময় অসময় নেই তিনি এখানে ছুটে আসতেন। নীচে এসেই খবর পাঠাতেন। আমি নেমে গিয়ে তাকে নিয়ে আসতাম। এখানে অসংখ্যবার বিভিন্ন কবিতায়োজন হয়েছে আর তার সবকটিতেই অনিবার্যভাবে ছিল তার উপস্থিতি। ফজল ভাইকে ঘিরে অনুজ কবিদের আড্ডাকে তিনি খুব উপভোগ করতেন। এই ‘বৈচিত্র’ অফিসেই পালিত হয়েছিল তার ৭৬তম জš§দিন। এতে সামিল হয়েছিলেন অনেক নবীন প্রবীণ কবি। কবিতা আলোচনা আর গানে কেটে গিয়েছিলো অনেকগুলো ঘণ্টা। ফজল ভাই নেই, এই ‘বৈচিত্র’ অফিসে আর তার পায়ের ছাপ পড়বেনাÑ ভাবতেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দু’চোখ ভরে আসে নিবিড় অশ্রুকণায়। ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘বন্ধুতালিকা’ও খুব একটি দীর্ঘ ছিলোনা। তার প্রিয়বন্ধু হিসেবে যে তিনজনকে শনাক্ত করা যায় তাদের মধ্যমনি হারুন। এককালের সাড়াজাগানো নায়ক হারুনের সাথে দীর্ঘ ৪ দশক বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিলেন তিনি। এক সঙ্গে ব্যবসা আর বন্ধুত্বের এই দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। সাবেক রাস্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খান মোহাম্মদ আমীরের সাথেও ছিল তার গভীর সখ্য। ফজল শাহাবুদ্দীনকে আর একজন মানুষ খুব প্রগাঢ়ভাবে ভালোবাসতেন, তিনি সজল আরেফিন। ফজল ভাইয়ের মৃত্যু তাকে শিশুর মতো কাঁদিয়েছে। অনুজ কবিদের মধ্যে ফজল শাহাবুদ্দীনের প্রিয় দু’জন কবির নাম আমিনুর রহমান টুটুল এবং শাকিল রিয়াজ। শাকিল এখন সুইডেন প্রবাসী। ফজল শাহাবুদ্দীন সাম্প্রতিক সময়ে যে দুটি গাড়ী ব্যবহার করেছেন তা খুব একটা বড়ো ছিলনা। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, বড়ো মানুষের ছোট গাড়ী। তার সেই গাড়ীও ছিল আমাদের আড্ডাস্থল। তিনি তাতে আমাদের উঠিয়ে নিতেন আর চলে যেতেন দূরে কোথাও Ñকখনো কখনো আবার একটি চক্করেই শেষ হতো আমাদের যাত্রা। এই গাড়ীতে অনুজদের সাথে কখনো কখনো প্রবীণরাও যুক্ত হতেন। উঠতেন কবি আল মুজাহিদী, কবি মাহবুব তালুকদার প্রমুখ। তখন আড্ডাটা বেশ জমতো। আমরা এ আড্ডাটিকে বলতাম ‘গাড়ী আড্ডা’। বাংলা কবিতায় এই গাড়ী আড্ডার জনক আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় কবি ফজল শাহাবুদ্দীন। তিনি অবশ্য এদেশে আরও দুটি জিনিসের জনক। তার একটি ‘বসন্তকালীন কবিতা উৎসব’ আর অন্যটি ‘পিরিওডিক্যাল পত্রিকা’। এদেশে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘বিচিত্রা’র জনক এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। এরপর একে একে বিনোদন, চিত্রিতা, নান্দনিক প্রভৃতি অসাধারণ সব পত্রিকা বের হয়েছে তারই হাতে। কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের আর একটি অনন্য কৃত্তি ‘কবিকণ্ঠ’। কবিতা বিষয়ক এ পত্রিকাটি অনিয়মিত হলেও এর প্রভাব আমাদের কবিতাঙ্গনে নিতান্তই কম ছিলনা। ফজল শাহাবুদ্দীন নেই। এই ‘নেই’ হয়ে যাওয়াÑ এটাই সত্য, চিরসত্য, যেমন সত্য বৃক্ষকুল কীটপতঙ্গ পক্ষীকূল পৃথিবী এবং গ্রহতারা। এই সত্যের উপরে দাঁড়িয়েও যে কথাটি উচ্চারণ করতে হচ্ছে আমাকে একান্তভাবে, যা শুধু আমার কথা নয়Ñ সকলেরও। এ উচ্চারণ আমাদের যুথবদ্ধ উচ্চারণÑ আর এ কোরাসের জনক আমাদের প্রিয় কবি, প্রিয় মানুষ ফজল শাহাবুদ্দীনÑ ‘মানুষেরা ম’রে যায় কিন্তু এই প্রকৃতি প্রাচীন বেঁচে থাকে নিরবধি। যেন এক জীবনের ধারা চলে ক্রমাগত। যেন যাবে সেই চির মৃত্যুহীন পরপারে। ম’রে যায় বৃক্ষ পাখি ম’রে গ্রহ তারা সব কিছু ম’রে যায় কিন্তু তবু মরে না জীবন। অদ্ভ’ত আঁধার এক নিয়ে আসে মৃত্যুহীন জ্যোতি। বার বার বেঁচে ওঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আত্ম
×