ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বজিৎ ঘোষ

আশ্চর্য ইশারার পঙ্ক্তিমালা

প্রকাশিত: ১২:১৬, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

আশ্চর্য ইশারার পঙ্ক্তিমালা

শব্দের আশ্চর্য ইশারায় চিত্তে যখন সৃষ্টি হয় সংবেদনা তখন জন্ম নেয় কবিতা। কবিতার শব্দে আর ছন্দে, উপমায় আর চিত্রকল্পে ওই ইশারাকেই কবি সন্ধান করেন কিংবা বলি নির্মাণ করেন। অর্ধ-শতকের দুয়ারে পা-দেওয়া দীপ্র ও ক্ষুব্ধ কবি আলফ্রেড খোকনের কবিতা নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই মনে আসলো তাঁর কবিতার এই আশ্চর্য ইশারার কথা। খোকনের কবিতায় কী সেই ইশারা? কেনই বা তিনি মত্ত থাকেন ইশারা নির্মাণে? প্রচল সমাজ আর দৈনিক অধীনস্থতার নিষ্পেশনে-নিয়ন্ত্রণে বিপন্ন মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধটাই, তার অতল-অতুল বাঁচার আকাক্সক্ষাই খোকনের কবিতার নিহিত ইশারা। অনেক কথাই কবি বলেন না সরাসরি, বলেন ইশারায়- যেমন বলেন তিনি তাঁর জন্মপল্লি ফুল্লশ্রী গ্রামকে নিয়ে এমন পঙক্তিমালা : ‘ওপারে চাঁদের আলো এই পাড়ে বাড়ি আমাদের, উপভোগ্য হলে উঠোনের বাগানে বসবে কিছুক্ষণ- যে কোন গাছের ডালে পাখি ডাকবে একটু একটু বাতাস, যে কোন আকাক্সক্ষার মত উজ্জ্বল হবে আকাশের তারা খুব মজা হবে, পেয়ে যেতে পার এক আশ্চর্য ইশারা’। ‘ফুল্লশ্রী ডট কম’ কবিতায় উচ্চারিত এই আশ্চর্য ইশারাই বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় রূপে-রূপান্তরে শিল্পিতা পেয়েছে আলফ্রেড খোকনের কবিতায়। একক্ষুব্ধ ও বিরুদ্ধ সময়ে বাংলাদেশের কবিতাভুবনে অনুপ্রবেশ আলফ্রেড খোকনের। সময়ের ওই বিরুদ্ধতা খোকনের পঙক্তিমালায় নানাভাবে রূপান্বিত। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখানে ঠেকেছে তলানিতে ছাষাড়ার মোড়ে দেখা প্রেমিকা চলে গেলে অন্যের হাত ধরে, রাষ্ট্রের সাথে ক্রমেই বেড়ে চলেছে মানুষের বিচ্ছিন্নতা- এমন বিপন্ন সময় খ-ের কবি আলফ্রেড খোকন সেই আশ্চর্য ইশারায় নির্মাণ করেন বাসযোগ্য অমরাবতী, তাঁর স্বপ্নের ফুল্লশ্রীÑ ভুবন। আন্তঃমানবিক ধস আর বিপন্নতার বিপ্রতীপে খোকন নির্মাণ করতে চান সম্পর্কের সেতুবন্ধ- সেই সেতুবন্ধের উপকরণ হয়ে আসে গ্রামীণ জীবন, ফেলে- আসা স্মৃতিলোক, রূপকথা আর ইতিহাস : ‘জেনেছি শতাব্দী শেষে অন্ধকার ঝাউবনে অস্তিবিহীন/তোমাকে ছোঁয়ার সাধ ও আঙুলের মহিমায় কতদিন/তাঁতীর নন্দনতত্ত্ব মিহিন সুতার আবেশে গেঁথে রেখে/বসন্ত মর্মরে, পাতার বাহুর মৌন আড়াল ঢেকে;/মৃদু যে বালুর শিশি দিয়েছিলে তুমি লোকালয় পথঘাট এড়িয়ে এসে/সন্ধ্যায় তাকে মনে রাখবে না জেনেও তো এসেছিলে খুব ভালবেসে/তারও কোন মানে নেই জেনে আধারের হাত থেকে/আমিও নিয়েছি সেই অস্ফুট স্বর ম্লান পাথর ডেকে;/কানে তার পরিয়েছি রূপকথা রাত্রির প্রথম প্রহর,/যেখানে বসেছে যেস-; তার তলে মনে মোহর’। (‘মধু বৃক্ষ প্রতারণা বিষ’) সামরিক শাসনের স্বৈর-আচরণের বিরুদ্ধে আলফ্রেড খোকন কবিতায় আবির্ভূত হন প্রতিবাদী ভূমিকায়। অপশাসন যখন মানুষকে বন্দি করে ফেলে, মেরে ফেলে তার বাঁচার সাহস, খোকন তখন কবিতায় সে মানুষকেই করতে চান রক্তমুখী, স্বপ্নমুখী, জীবনমুখী। কী পরিহাস কী ব্যঙ্গ কী নিরব ইশারাময় প্রতিবাদ নির্মিত হয় খোকনের কবিতায়, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, মারণাস্ত্রধাী বাহিনীর বিরুদ্ধে : ‘পুলিশগুলো ভালো। সারা রাতটাই পাহারা দিচ্ছে,/ওদের কাঁদে টুকরো চাঁদের আলো:/পাহারা দিচ্ছে নিরীহ মানুষের গন্তব্য, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় ক্লিন্ন বাগানের ফুল,/কয়েকটি কুকুর আর সেঁধিয়ে থাকা ঘুমকাতুরে লিঙ্গগুলি,/ঘটনাটা বেশ ভালো, চমক আছে। বাইরে আলেÍারাষ্ট্রের ধারণা পাওয়া যায়./ছোটবেলায় পুলিশ ছিল হবি।/ভালো ঘটনায় থাকে কিছু মেঘ, পুলিশ করছে লিঙ্গ চেক। পকেটে ঘুম,/চোখেও, ছোটবেলার পুলিশরা সব কবি।’ (‘গত রাতের ঘটনা’) মানুষের খ-ায়নই এ কালের প্রধান প্রবণতা। খোকনের কবিতা এই খ-ানের বিরুদ্ধে। যে খেতে চায়, ছাগলটাকে খ- খ- করাই তার নেশা-কথাটা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। ছাগলটার যুদ্ধ থাকে ওই খ-ায়নের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধ ভয়ঙ্কর। সেই যুদ্ধে খোকন আত্যন্তিকভাবে চান মানুষের সহযোগ-মানুষকে জাগাতে চান সংযোগ-সমরে। বিরুদ্ধ সময়ে দাঁড়িয়ে একজন কবির এই অন্তর্দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে, তাই বারবার পাঠ করি আলফ্রেড খোকনের এই ইশারাময় শব্দমালা : ‘ভোর ছিলো সাধারণ/দরজায় টোকা দিয়ে চলে গেছে সে,/একথাও মনে করা যাবে না এখন।/... আমি যখন এসব কথা লিখছিলাম/ইতিহাসের শাদা পৃষ্ঠায়/তখন একটা চুল উড়ে আসল লেখার খাতায়;/যেমন লিখি ফড়িঙের ওড়া/লোকে বলে ‘আর কোনো বিষয় পেল না।’/লিখছিলাম একজোড়া হাত নিয়ে/তারা বলল, ‘মানুষ কোথায়“’ তো এইভাবে লিখতে লিখতে/খাতার ওপর একটা চুল/এইভাবে লিখতে লিখতে/এড়িয়ে যাওয়া গোপনেষু ভুল-লেখাটি মুদ্রিত হলো গত শুক্রবার,/চুলটি বাদ দিলেন দৈনিকের গাঢ় সম্পাদক।’ (গত শুক্রবারের ঘটনা) পাঠক, শুরুতেই খোকনের কবিতা নিয়ে বলেছিলাম যে ইশারার কথা, এবার তো বোঝা গেল, এই পঙক্তিমালায় কাকে বলে ইশারা! সমকালীন বাংলা কবিতা, কিংবা বলি আশি-উত্তর বাংলাদেশের কবিতা খ-তার আরাধনায় মুখর, ম্যাক্রো-জীবন পরিহার করে মাইক্রো-জীবনের স্বপ্নে আত্মহারা। কালিক এই প্রবণতার বিরুদ্ধে অতি সংগোপনে, আলফ্রেড খোকন নির্মাণ করতে চেয়েছেন একটা সামূহিক মানবসৌধ। এই সৌধ নির্মাণে খোকন উপাদান সংগ্রহ করেছেন ইতিহাসের ধূসর জগৎ থেকে- তাঁকে ইট-কাঠ জোগান দিয়েছে লোকায়ত বাংলা, কিংবা চাষাড়ার মোড়ে দেখা সেই স্বপ্ন-বালিকারা। ইতিহাসের বিশাল ডানায় ভর করেছেন বলে আলফ্রেড খোকনের কবিতায় জীবনের শূন্যতার চাষ নেই, বরং আছে পূর্ণতার আভাস। ইতিহাস-রূপকথা আর লোকবাংলার ¯িœগ্ধ হাত মাথার উপর আছে বলে আলফ্রেড খোকন কবিতা লিখতে গিয়ে কখনো পথহারা হননি; বরং নির্মাণ করেছেন অতুল এই পঙক্তিরাশি, যে পঙক্তিমালা উঠে আসে মানবপ্রজাতির পরম্পরাগত সংযোগসূত্র : ‘একটি পালক তাই আর বেশি ধ্বনিময়/একটি মৃতহাড় আরও বেশি জীবনের দিকে.../অথচ কোত্থেকে অন্ধকার-হাওয়া এসে তুলে নেয়/আর ক্রমশ দৃশ্যের রঙ থেকে আরও বেশি ফিকে/হয়ে যায় আমাদের বধূটির লালপেড়ে শাড়ি;/দৃশ্যত এই রঙে আমরা পালক হয়ে ভেসে যাই/দৃশ্যত হাড়ের ভিতর উদ্যত খড় হয়ে উঠি.../আমাদের সেই প্রতœ-প্রতিতমহের গল্পের হাড়গোড়/কিংবা সেইসব যৌনগন্ধ মাঠের ভিতর/অথবা সেইসব গুহা চি্ের, মমির শরীর নিয়ে ধ্বনিময়/গণিকাদের উজ্জ্বলতা-মাঠের দূরবর্তী হাওয়ায় হাওয়ায়/ঘনশ্বাস আজও আক্রান্ত করে,/গোধূলি রেখায়, প্রপঞ্চের জ্যামিতিতে, সেইসব/পালকীয় হাড়ে বালক-বালিকা খেলা/সেইসব দেশে-আহা দেশ থেকে দেশে...।’ (‘প্রতœ-পদাবলি’) ‘বর্গা ইতিহাস’ কবিতায়ও আছে ওই ইতিহাস প্রলেপের কথা। জীবনানন্দ যেমন বলেন ‘ইতিহাস খুড়লেই রাশি রাশি দুঃখের খনি/ভেদ করে শোনা যায়/শত-শত জলঝর্ণার ধ্বনি।’ আলফ্রেড খোকনের কবিতায়ও তেমনি দেখে লোকবাংলার সঞ্জীবনী ইতিহাস-সূত্র : ‘আমার এখন অভিধান লাগে!/খোলা অভিধানে চোখ রাখতেই পিতার মুখ পাঠ করি/জানালায় বৃষ্টির ঝাপটা এসে পৃষ্ঠাগুলো ভিজিয়ে দিয়ে যায়;/মায়ের চোখ মনে পড়ে/আমার কবিতার কাঠামো পরিবর্তিত হয়।/গাড়ির চাকা চলছে/মানুষ বাড়ছে, দালান উড়ছে/মানুষীরা আকাশ ছোঁবে, মানুষেরা ছোঁবে মেঘ;/পিতার জোড়াহাত জানে এ সবের ইতিহাস/মায়ের চোখ জানে ইতিহাস গড়িয়ে পড়া জল/অভিধান এর কিছুই জানে না।’ (‘বর্গা ইতিহাস’) মানুষের অন্তর্গত নির্বেদ-নৈঃসঙ্গ্য-অনস্বয় পৌরঃপুনিক শিল্পতা পেয়েছে আলফ্রেড খোকনের কবিায়। সামূহিক বিচ্ছিন্নতার চাপে ব্যক্তির নৈঃসঙ্গ্য খোকন তাঁর শব্দে আর ছন্দে ধরতে চেয়েছেন নিপুণ হাতে। কিন্তু বিশেষ করে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে এ প্রসঙ্গ যে, নির্বেদ-নৈঃসঙ্গ্য খোকনকে হতাশামগ্ন করে না, বরং তা হয়ে ওঠে তাঁর সৃষ্টিশীলতার অবারিত প্রাণনা। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায় তাঁর ‘চাষাড়া মোড়ের ভিড়ে’ কবিতার প্রেম-বিচ্ছিন্নতার গরলমুখে কবিকণ্ঠের অস্ফুট এই আর্তনাদ : ‘একটা পাখি একবার, ব্যবহৃত সেই পাখির পালক/একবার, একাকী বধু একবার-আমাকে বলেছিল;/ভালো হোক উপেক্ষারা, ভালো হোক অবহেলা-ভুল/ভালো হোক পৃথিবীর মন ভালো হোক পায়ের আঙুল/ভালো হোক তোমার সঙ্গে কোনোদিন আর না দেখা;/দূরের রাস্তায়-সকল পায়ের তলা হাঁটে একা একা’। (‘চাষাড়া মোড়ের ভিড়ে’) এই একাকী মানুষের কথা বারবার উঁকি দেয় খোকনের কবিতাকাশে, কখনো তা লোকবাংলায় ও খুঁজে পায় খোকনের ভাষা : ‘আমাদের ফড়িঙেরা, গাছ-পাতা-ফুল, মেঘের বাঙালি বিকেলবেলা/চৈত্রের সন্ধ্যায় জামাইয়ের খুনসুটি আর ওই দূরে রাজবাড়ি মেলা/কেমন লজ্জা পেয়ে মৃদু হয়ে উঠবে নাÑ‘বলো?’/ হু হু করে ট্রেন যায় পেছনেরা ডাক দেয় : ‘চলো’/পৌষে আমের ক্ষেত রকমারি সাইনবোর্ডে লেখা;/ট্রেনের কামরা থেকে নির্জনতা ঝাঁপ দেয় একা।’ (মধু বৃক্ষ প্রতারণা বিষ’) আলফ্রেড খোকনের কবিতা বিষয়ে যেমন ব্যতিক্রমী, গঠনেও তেমনি প্রাতিস্বিকতা-চিহ্নিত। পাঠক, একবার পাঠ করুন তাঁর ‘একটি প্রেমের কবিতা’। প্রচার মাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতা কী নিপুণতায় এখানে ব্যবহার করেছেন-ভাবা যায়! শব্দ-ব্যবহারে, শব্দ-সৃজনেও খোকনের পরীক্ষা সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার নয়। তাঁর কল্পনা একান্ত নিজস্ব, যেমন ‘আততায়ী গোধূলি’ আরম্ভ হয় এই কল্পছবি দিয়ে : ‘এমন বিকেলে ছুরি মেরে দাও আকাশের তলপেটে।’ খোকনের চিত্রকল্প নির্মাণ ও স্বকীয়তাবদ্ধ। খেয়াল করা যাক ‘শেষমুহূর্ত’ কবিতার এই চিত্রকল্পটি : ‘মানুষের অনেক মুহূর্ত এসে পাশ ফিরে চুপচাপ শোয়,/টিনের চালে আকাশের ব্যথা ঝরে। আলফ্রেড খোকন, আগেই বলেছি, দীপ্র ও ক্ষুব্ধ কবি। তাঁর আগামীর কবিতাগুলো এই দীপ্রতা আর ক্ষুব্ধতাকে আরো শানিত ও শিল্পিত করবেÑ এমন আশার কথা জানিয়ে শেষ করি আজ আমার এই খোকনমঙ্গল।
×