ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গল্প ॥ পাতা

প্রকাশিত: ১২:১৫, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

গল্প ॥ পাতা

ছোট্ট মাটির চুলা। টিনের ঘরের লাগোয়া বারান্দার এককোণে আলগা চুলা দিয়ে রান্না করছে শিলা। পুকুরের এঁটেল মাটি দিয়ে গড়া মাটির চুলাটি অনেকদিন লেপা হয়নি। রোদে শুকিয়ে ফাটল ধরেছে- একটু নরম কাদামাটির ছোঁয়ার অপেক্ষায় বুক চিরে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। শিলা চুলার ফাটলের দিকে চোখ স্থির রেখে মাথা নিচু করে আগুনে ফুঁ দিচ্ছে আর একহাতের আঙ্গুল দিয়ে মাঝে মাঝে মুছে নিচ্ছে চোখের কোণা। চুলগুলো বেণী করা। গলায় সোনার চেন। হাতে মেহেদির রঙিন আভা। বাড়ির বাহিরের আঙিনা, পেছনের বাগান থেকে কুড়িয়ে-আনা পাতা দিয়ে চুলায় জ্বাল শুরু করে শিলা। চুলা একবার নেভে একবার জ্বলে। পাশে রাখা কুপি থেকে পাতা দিয়ে আগুন জ্বালায় সে। বাইরে তখন বৃষ্টি। মাঝে মাঝে ঝাপটা-দেয়া বাতাস। ভয়-ধরা ঝড়ের আভাস শিলার মনে চাপা কান্না জমিয়ে তোলে। বাতাসে পাতা সামাল দেয়া ভার। যেন পাতা নয়Ñ শরীর ও মন উড়িয়ে নিচ্ছে এই হিংসুটে বাউলা বাতাস। পাতাগুলো পাকিয়ে পাকিয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। চুলার ভেতরে নয়, শিলার মনের গলি ও বারান্দায় ঘুরপাক খাচ্ছে অসংখ্য শুকনো পাতা। প্রথমে পাতা একটা থেকে দুটো হয়। এরপর মুহূর্তের মধ্যে সে সংখ্যা হাজার অথবা লাখ কিংবা কোটি ছাড়িয়ে যায়। বিয়ে হয়ে মাত্র ৪ দিন আগে এক ঘন-অন্ধকার সন্ধ্যাবেলা শ^শুরবাড়ি আসে শিলা। টুঙ্গিপাড়া বাপের বাড়ি থেকে নতুন সংসারের দূরত্ব কিলো দশেকের বেশি হবে না। কিন্তু শিলার মনে হয়েছে ভাড়া-করা প্রাইভেট কারটি বোধহয় ১০০০ মাইল পাড়ি দিয়েছে। কারটি তার শ্বশুর কিংবা শ্বশুরের ছেলের নয়- রেন্ট-এ-কারের। বরের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, টাকাটা গুনে নিয়ে বিদায় নেবে সে। তারপর শিলার বাবার দেয়া ইয়ামাহা হানড্রেড-এ চরে নাইওরে যেতে হবে। বাপের বাড়ির আঙিনা ছেড়ে নামতে মন সায় দেয়নি কিছুতেই। গাড়িতে ওঠার সময় মনে হয়েছিল ৮০ কিলোর চালের বস্তা সে টেনে তুলছে কাঁধের ওপর। বাবা শিলার হাত ধরে কেঁদেছিলেন গাড়ির দরোজার পাশে দাঁড়িয়ে। চুলায় পাতা গুঁজতে গুঁজতে সে-কথাই ভাবছিল শিলা। কেন বাবা বিয়ে দিলেন তাকে? কী এমন হয়েছিল? সে কি সংসারে কোন ঝামেলা করছিল? বাবার তো চাকরিও শেষ হয়নি। ঘরে খাবারের কোন টানাপড়েন নেই। ছোট্ট দুই ভাই আর শিলাকে পড়াশোনা করাতে তাদের পিতামাতার খুব কষ্ট হচ্ছিল বলেও মনে হয় না। তাহলে? হ্যাঁ, এর পেছনে আছে ষড়যন্ত্র। পরিবারের কিংবা পরিজনের সবাই তো আর অন্যের ভাল চায় না। কোন কোন সংসারে এমন লোক থাকে, যে অন্যের ক্ষতির জন্য সব সময় রেডিই থাকে। শিলার এক মামি সব নষ্টের মূলে। সব দোষ তার বড় মামির। হ্যাঁ। তিনিই লতিফুর রহমানকে জাদু করেছেন। শিলার বাবা লতিফুর। ব্যাংকে ভাল চাকরি তার। ঢাকায় থাকেন। সংসার এই টুঙ্গিপাড়ায়। ছুটিতে বাড়িতে আসেন। বলতে গেলে পরিবারে তিনিই একমাত্র শিক্ষিত ও চাকরিজীবী। তার অন্য তিন ভাই কৃষক। এক ভাই গ্রামে ছোটখাটো ব্যবসা করে। চাচাতো-মামাতো ভাইবোনদের কেউ স্কুলের সীমা পেরুতে পারেনি। কেবল লতিফ কলেজ পাস করে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিল। শিলার বড় মামি টেনেটুনে নবম শ্রেণী পাড়ি দিয়েছেন। তার বাবা যুদ্ধের সময় সস্তায় অনেক জমি-জমা কিনেছেন। সে-সূত্রে কন্যা কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। মহিলার বুদ্ধিও ভাল। সংসারের চারদিকে প্রখর চোখ। কার ঘরে কী করে অশান্তি ঢোকাতে হয়, সে বিষয়ে তার খ্যাতির প্রমাণ মিলেছে বহুবার। শিলার গায়ের রং ফর্সা। প্রায় ৬ ফুট লম্বা দেহ। নাক খাড়া। ঠোঁট আস্ত কমলার কোয়া। চোখে রঙিন স্বপ্ন। একবার চোখে পড়লে কোন মেয়ে মানুষের পক্ষেও চোখ ফেরানো কঠিন। পুরুষের কথা না-বলাই ভাল। কথা বলে ধীরেÑ শান্ত গলায়, টেনে টেনে। যেন বহু দূর থেকে হেঁটে এসে কোন ক্লান্ত পথিক এক গ্লাস পানি চায় কোন বদনা-হাতে কলে-পানিতোলা-কিশোরের কাছে। ছোটবেলায় খেলার সাথী সীমান্ত বলেছিলÑ ‘তুই শিলা বৃষ্টি।’ শিলা অবাক হয়ে বলেছিলÑ ‘শিলা বৃষ্টি! কই আমি তো কোন বৃষ্টি দেখি না। বৃষ্টি কোথায়? চোখে তো পানিও জমে না একফোঁটা।’ Ñ হ্যাঁ, তোর চোখের দিকে তাকালে মনের ভেতরে তা-ব হয়ে যায়। বুকের মধ্যে শুরু হয় রাজ্যের তোলপাড়। সব কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে যায়। খেতের ফসল-নষ্ট-করা শিলাবৃষ্টির মতো তুই সব কিছু শেষ করে দিতে পারিস। ভেবে কোন কিনারা পাই না। Ñ ভাবিস না। কে বলেছে তোকে ভাবতে? কথাগুলো বলতে বলতে সীমান্ত আর শিলা বিকেলে মাঠ থেকে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। পথের ধারে ছোট্ট একটা ঝোপ। জঙলা গাছের ঝোপের আড়ালে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে সীমান্ত। হাত চেপে ধরে শিলার। তারপর ঠোঁটে একটা গভীর চুমু দেয় সীমান্ত। বলেÑ বুঝলি, কেমন শিলা বৃষ্টির ঝাপটা বয়ে গেল? সেই দুষ্টামির জন্য সেদিন সীমান্তকে খুব বাজে ছেলে মনে হয়েছিল শিলার। কথাই বলেনি প্রায় মাস খানেক। তারপর নদীর ভাঙনে সীমান্তরা ওপারের চরের পরে দূরের কোন গাঁয়ে নাকি আসামে নাকি আগরতলায় বসতি স্থাপন করলে তাদের খেলার সমাপ্তি ঘটে। আর দেখা হয়নি সীমান্তদের সঙ্গে। তাদের পরিবারটি শিলাদের পরিজনের মতোই ছিল। সীমান্তর কাকা ছিদাম নৌকা চালাত। খেয়াপারের মাঝি ছিল সে। সীমান্তরা সবাই চলে গেলেও কেবল ছিদাম কাকা রয়ে গেলেন নদীর মায়ায়। পরে, ফারাক্কা বাঁধ তৈরি হলে, হোজা নদী মরে গেলে ছিদাম ডাক্তারি শুরু করে। এখন সে শুকিয়ে-যাওয়া নদীর ধারে চায়ের দোকান চালায়। পৃথিবীর কী যে নিয়মÑমানুষ কেন যে বিচ্ছেদের সুতোয় আটকে পড়ে! শিলারা কিংবা গ্রামবাসী তো পরের কথা ছিদাম কাকার সঙ্গেও আর কোন যোগাযোগ রাখেনি সীমান্তরা। কোথায় যে চলে গেলো? ইন্ডিয়া থেকে পুশইনের কোন খবর পেলে হাতরে দেখে শিলাÑ যদি সীমান্তদের কারও নাম পাওয়া যায়! শিলার স্বামী রমিজ বেশি লেখাপড়া করেনি। ক্লাস থ্রিতে নাকি ফোরে গিয়েছিল কিছুদিন। তারপর সিনিয়র বখাটে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় গেছে। গ্রামের হাটের এককোণে ছোট্ট ছাউনি দিয়ে আড়ত খুলে বসেছে। চৈতালির ব্যবসা তার। মসুর, কলাই, মটরের আড়তদার সে। কামাই খারাপ না। সমবয়সী অন্য ছেলেদের তুলনায় সে টাকা-পয়সার দিক থেকে বেশ সচ্ছল। প্যাকেটভরা সিগারেট রাখে পকেটে। বিদেশী লাইটারে আঙ্গুলের টোকায় কায়দা করে আগুন জ্বালায়। দু’চারজনকে সেধে সিগারেট খাওয়ায়। শখ করে কখনও কখনও খিলি পান খায় হাকিমপুরি দিয়ে। গলায় সোনার চেন। সিঙ্গাপুর থেকে আনা। হাতে গোপালগঞ্জ শহরের দোকান থেকে সস্তায়-কিনে-আনা ব্রেসলেট। মনে ফুরফুরে আনন্দ। ঘরে তার সুন্দরী বউ। বউ-এর হাতের রান্না খেয়ে আয়েশ করে বালিশে মাথা রেখে দূর আকাশে চোখ রেখে সুখটান দেয়া তার প্রতি রাতের রুটিন। সিগারেটের ছেড়ে-দেয়া-ধোঁয়ায় কু-লি পাকিয়ে আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে স্বপ্নমাখা চোখে তাকায় বারান্দার দিকেÑ যেখানে মাটির চুলায় রান্না করে শিলা। তারপর কুপির আলোয় শিলার সন্নিধ্যের অপেক্ষার প্রহর গুনে। রমিজকে একটুও ভাললাগে না শিলার। প্রথম থেকেই। তাকে ফালতু ছেলে মনে হয়। ক্লাস নাইনে যখন, তখন তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। সায়েন্স পড়বে না-কি আর্টস এই যখন তার ভাবনা, হঠাৎ একদিন বড় মামির ফোন এলো। Ñ হ্যালো, শিলা, আজ বিকেলে একটু বাসায় আসিস তো, কথা আছে। Ñ আচ্ছা, মামি। শিলা স্বপ্নেও ভাবেনিÑ মামি তাকে বাড়িতে ডেকে বিয়ের কথা বলবেন। বিকেলে মামিদের ড্রয়িংরুমে ঢুকে শিলা দেখে সেখানে তার বাবা-মাও বসা। ব্যাপার কী? বাবা অফিস থেকে সরাসরি মামিদের বাসায় কেন? মা কখন এলো? মামি বললেনÑ ‘শীলা, বসো, তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে। আমরা তোমার বিয়ের কথা ভাবছি। ভাল ছেলে পেয়েছি। বড় ঘরের ছেলে। তোমার কোন মতো আছে?’ শিলা বললÑ ‘না, মামি। আমি লেখাপড়া করব।’ Ñ ‘তোমার কোন পছন্দের ছেলে আছে? আজকাল তো শুনি স্কুলে-পড়া মেয়েরা সবাই প্রেম-ট্রেম করে। অনেকে তো পালিয়েও বিয়ে করছে। এই তো সেদিন শুনলাম ফরিদপুরে নাকি মাদারীপুরে স্কুল ফাইনালের দিন সকালে ক্লাস এইটের একটা জুটি পালিয়েছে।’ Ñ না। আমার পছন্দের কেউ নেই। পাড়ার ছেলেরা, স্কুলের ছেলেরা যে তার পিছু নেয়নি, তা নয়। নিয়েছে। একজন নয়Ñ অনেকজন। এই তো মাত্র সপ্তাহখানেক আগেও ক্লাস টেনের শিপন তাকে হাতে লেখা চিঠি দিয়েছে। বলেছেÑ ‘শীলা, তোমার জন্য লেখা। রাজি না থাকলে ছিঁড়ে ফেল।’ চিঠিটা নেয়নি শিলা। বলেছিলÑ ‘আপনার কাছে রেখে দেন। পরে নেব।’ তখন স্কুলের টিউবওয়েলে পানি খাচ্ছিল শিলা। একা ছিল। বান্ধবীরা ছিল কমনরুমে। কেউ দেখেছে কি-না, শিলা তা দেখেনি। কিন্তু মামির যে কী যোগাযোগ! কোথা থেকে যে রাজ্যের খবরাখবর তার কাছে আসে, কে জানে! শিপনের কথা তুলে যাচ্ছেতাই বলে গেলেন মামি। ভাবটা এমন যে শিলা প্রেম করে বেড়াচ্ছে। অথচ গোপন করছে। বাড়ির ছোট ভাইবোনদের সামনে এসব কথা শুনে খুব অপমান বোধ হয়েছিল শিলার। বাবা-মার ওপর ভীষণ রাগ হয়েছিল। তারা নিজের বাড়িতে চড়-থাপ্পড় মারতে পারত। কিন্তু অন্যের বাড়িতে এনে ছোটছোট মামাতো ভাই-বোনদের সামনে এই অপমান সে মানতে পারেনি। কী ভাবল ওরা? চুলায় পাতা ঠেলতে ঠেলতে শিলার মনে হয়Ñ সংসার তার জন্য না। এভাবে সে পারবে না। আর কতদিন অভিনয় করা যায়! যাকে ভাল লাগে না, তার সঙ্গে কেন থাকতে হবে সারাজীবন। সংসারের চাকা ঘোরাচ্ছে না সে। পারছে না। কেঁদে কেঁদে মরছে শুধু। কী সব কথা মনে পড়ছে আজ। কেন বিয়ে দিল বাবা? এমন তো না যে সে দেখতে খারাপ ছিলÑ কোন ছেলে বিয়ে করতে রাজি হবে না। গ্রামের আর দশটা মেয়ের চেয়ে বরং বেশিই সুন্দরী সে। লেখাপড়ায়ও ভাল ছিল। নাইনে ওঠার সময় সেকেন্ড হয়েছিল ক্লাসের ২৮৮ জন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে। স্যার-ম্যাডামরাও খুব আদর করতো তাকে। হেড মাস্টার বলতেনÑ ‘তুই প্রেসিডেন্ট হবি।’ চুলায় জ্বাল দিচ্ছে না সে। যেন নিজেই তাজা গাছ থেকে ঝরে পড়া পাতাÑ অযতেœ বেড়েওঠা গাছ থেকে পড়ে শুকিয়ে গেছে। চুলায় ঢুকছে সে পাতারা ছদ্মবেশে। শহর থেকে কে যেন খবর নিয়ে এসেছেÑ ‘ঢাকার ধানম-ি ৩২ নম্বরে গোলমাল হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মিলিটারিরা হামলা করেছে। মেরে ফেলেছে সবাইকে। শহরজুড়ে এখন মিলিটারির পাহারা। মোড়ে মোড়ে শত শত আর্মি। কেউ ঘর থেকে বেরোতে পারছে না।’ পাড়ার মেয়েদের কানে কানে ছড়িয়ে বাতাসের মতো, পাতা উড়িয়ে নেয় চারদিক থেকেÑ এমন বাতাস, শিলার চুলার সামনে এসে যেন আছড়ে পড়ে খবরটি। সমস্ত শরীর তার পাতার মতো হালকা হয়ে যায়। বসে থেকেও বসে নেই যেন। রাতে শিলা একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। দেখেছে গাছ-থেকে-ছেঁড়া একটা কচকচে কাঁচা পেয়ারা খাচ্ছে সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। গাছে পাকা পেয়ারাও ছিল। কিন্তু তার ওই কাঁচাটাই খেতে ইচ্ছে করল। তো দ্বিতীয়বার পেয়ারায় জোর করে যেই কামড় দিয়েছে, অমনি তার সামনের সারির ৭ নম্বর দাঁতটি অর্ধেকের মতো ভেঙে পড়ে গেছে। মাটিতে পড়ে-থাকা দুধে-আলতা খ-িত দাঁত হাতে তুলে নিয়ে দাঁড়াতেই মাজায় টান পড়ে তার। আর তখনই ঘুমটা ভেঙে যায়। শালার দেশটার হলোটা কী! কার্ফ্যুজারি হলো না-কি পাকিস্তান পিরিয়ডের মতো? বাঙালী আবার পিছিয়ে পড়ল? না-কি কালিমা ধুয়ে-মুছে নতুন কোন বাংলাদেশ বানিয়ে ছাড়বে শেষ পর্যন্ত? দাঁতভাঙা জবাব দেবে তো কেউ? না-কি ভয়ে গুটিয়ে থাকবে সবাই? পিছিয়ে যাবে না-কি মানুষ ও সমাজ? পেয়ারা খাওয়ার এই স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভাঙার পর শিলার বার বার পেয়ারা ফুফুর কথা মনে পড়ছে। অবশ্য পেয়ারা তার সত্যিকারের ফুফু নাÑ তার নূরজাহান ফুফুর ননদ। নূরজাহান ফুফুও আবার তার বাবার মামাতো বোন। তো পেয়ারা ফুফুর চেহারাটাও পাকা পেয়ারার মতো। দেখলে কেমন মন ভাল হয়ে যায়। আজও কি পেয়ারা ফুফুকে দেখতে পেলে মন ভাল হবে শিলার? ঘুরে আসবে না-কি একবার নন্দীপাড়ার ওদিকটায়? নন্দী হাজির বাড়ির পরের বাড়িটা, বড় পাকুর গাছের ছায়ার তলে পেয়ারা ফুফুদের বাড়ি। সামনে রাস্তার ধারে টিউবওয়েলের কাদামাটি মাখা এলাকা পেরুলে দুটো ছোট্ট ঘর। একটা ঘরে থাকে পেয়ারা ফুফুর নানি। বয়স প্রায় ১০০ হবে। কেউ কেউ বলে ১৩০ বছর। এই এক সমস্যা। গ্রামের লোকেরা অযথাই বৃদ্ধদের বয়স যাচ্ছেতাই রকম বাড়িয়ে বলে। কিন্তু যাবে কী করে শিলা পেয়ারার ফুফুদের বাড়ি? এদিকে তা তা-ব শুরু হয়েছে মাতাল বাতাসেÑ ঠিক সময়ে রান্না শেষ করতে পারলেই হয়। না হলে তো আবার স্বামীর হাতের পিটুনি খেতে হবে। শিলা নড়তে পারে না একফোঁটাও। বা পা-টা কেমন ঝিনঝিন করছে। রগে টান পড়েছে না-কি। এবকার পা-টা টানটান করে আবার পিঁড়িতে বসে চুলায় ফু দেয় শিলাÑ ফু-উÑউÑউ। ছোট্ট শিলা দাদির কাছে শুনেছিলÑ ‘চুপরে খোকা চুপ। ওই শোনা যায় বুটের ধাপুর-ধুপ।’ কার যেন কবিতাটা? মনে পড়ছে না। সম্ভবত ওই লোকটাই লিখেছেÑ এমন একটা মা দেনা, যে সন্তানরা কান্দে আবার হাসতে জানে।‘ হ্যাঁ, এখন তো সেই দশাই হয়েছে। কেঁদে কোন লাভ নেই। বুকের কান্না জমিয়ে রেখে মুখ খুলে হাসতে হবে। চারদিকে যা দিনকাল পড়েছে। যুদ্ধের পর তো অনেকে অস্ত্র জমা দেয়নি। লুটপাটে আর হত্যা-জখমের খবর তো প্রায়ই আসে দেশের নানা কর্নার থেকে। শিলা কি কাঁদবে কিছুক্ষণ? বুকের ভেতর ধুপ-ধুপ আওয়াজ করতে থাকে তার। মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে গাছের শুকনো কিংবা আধা-পাকা পাতা। পাতারা পাক খেয়ে খেয়ে পড়ছে তার মুখের ওপর, মাথার ওপর। বসে পড়ে সে ধুপ করে মাটিতে। চোখে অন্ধকার দেখে। ঝাপসা চোখে তাকায় বাড়ির উঠানের শেষ মাথায়। ওখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে একটা বেল গাছÑ সেই কবে থেকে সে বাড়ির নিশানা হয়ে আছে কে জানে? শিলা দেখেÑ ওই বেল গাছটার পাশে বাঁকা হয়ে সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে কে একজন চোখে চশমা, কপালে সামান্য ভাঁজ করা চুল, গায়ে কালো রঙের হাফ কোট, আঙ্গুল তুলে তুলে বক্তৃতা করছে। কী যেন বলছে সামনে বসে থাকা লোকেদের। একটি মাইক্রোফোন তাক করে রাখা তার বুক বরাবর। দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। উচ্চকিত কণ্ঠ। কিন্তু সামনের উঠান ফাঁকা। কোন মানুষ নেই। কে শুনবে তার কথা? লোকটির পড়নে সাদা পাঞ্জাবি। শিলা সাদা পাঞ্জাবিতে লাল লাল ছোপ দেখতে পায়। কে যেন রঙের ছিটা দিয়ে গেছে এইমাত্র। খুব টাটকা। বুকের পাঁজরের কাছটায় রঙের ছোপটা যেন বেশ গাঢ়, বেশ প্রশস্ত। একবার স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনে যেমনি খুশি তেমনি সাজো কম্পিটিশানে ক্লাস টেনের কি যেন নাম ছেলেটা এ রকম একটা লাল-রঙমাখা সাদা পাঞ্জাবি পড়ে সারা মাঠ প্রদক্ষিণ করেছিল। বিশেষ করে বিচারকম-লীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বার বার কাঁধে রাখা বাঁশের কাবাড়ি দিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব করছিল। কেউ কেউ বলছিল আহত মুক্তিযোদ্ধা। কে যেন পাশ থেকে বলেছিলÑ বুকে লাল রংটা বাংলাদেশের পতাকার প্রতীক। কিন্তু শিলার যতটুকু মনে পড়ে এমন রঙের পতাকা জাপানের না কোরিয়ারÑ বাংলাদেশের না। পরে শুনেছিল পাঞ্জাবির জমিনটা যদি সবুজ হতো, শ্যামল বাংলার মতো, তাহলে না-কি ছেলেটা ফার্স্ট পুরস্কার পেয়ে যেত। শিলা দেখতে থাকেÑ বুকে ছোপ ছোপ রক্তমাখা সাদা-পাঞ্জাবির-লোকটা বক্তৃতা করতে করতে সামনে নদীর দিকে এগিয়ে যায়। কিংবা সমুদ্রের দিকে। কিংবা আকাশের দিকে। কখনও-বা আকাশ থেকে নেমে হাঁটতে থাকে লোকালয়ের দিকে। রেসকোর্স নাকি পল্টন নাকি সোহরাওয়ার্দীর দিকে। কিন্তু এখানে তো কোন নদী নেই। একটা খাল ছিল। তাও সেই কবে শুকিয়ে গেছে। খাল কেটে কুমির আনার গল্প তো ডাহা মিথ্যা! এ গ্রামের লোকেরাÑ এই টুঙ্গিপাড়ার লোকেরা কি কখনও কুমির দেখেছে? কিংবা গোপালগঞ্জে কে, কবে খাল কেটেছিল! স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায়শই একটা লোককে দেখতো শিলাÑসাদা পাঞ্জাবি পড়ে ভাঙা-কালভার্টের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছে। শুনেছে লোকটি না-কি একাত্তরে ভারতে না যুদ্ধে গিয়েছিল। কোথায় কোথায় ক্যাম্প ছিল আর কোন কোন এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে, শিলা তা জানে না। জানবে কী করে? লোকেরা সত্যি কথা বলে? যে যার মতো গালগপ্পো করে বেড়ায়। শিলা অবশ্য এসব নিয়ে বেশি ভাবেনি। এগুলো তার কম্ম নয়। ভাবুকগে ইতিহাসবিদরা। আর রাজনীাতবিদরা তো রয়েই গেছে চারপাশে। তো কালভার্টে-বক্তৃতা-করা লোকটা, দেশ স্বাধীন হলে ফিরে এসে সংসারের কাউকে পায়নি। আধা-পোড়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় সারাদিন। তারপর থেকে পাগল হয়ে গেছে। সরকারি কলেজের কাছে একটা পতিত বাড়িতে একা একা থাকে। কোন এক ব্যাচেলর প্রফেসর জসীম না কী যেন নাম, বোটানি পড়ায়, তার খাবার আর পোশাক-আশাকের বিহিত করে। এটা অবশ্য শোনা কথা। কত কথাই তো বলে লোকেরা। নিন্দুকেরা রটিয়েছে বিদেশ থেকে না-কি টাকা পায় ওই প্রফেসর। যুদ্ধে যারা আহত কিংবা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যারা পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে এদের পুনর্বাসনের জন্য না-কি প্রচুর টাকে আসে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে। লোকটা হাত লম্বা করে সামনের দিকে মেলে দিয়ে কাদেরকে যেন সে বলে যেতো অনর্গলÑ ‘আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। আমি অপারেশানে যাচ্ছি। তোরা ওদেরকে দেখে রাখিস। তোরা ওদের খবরাখবর রাখিস।’ লোকটি না-কি তার দলের লোকদের খুব বিশ^াস করত। শিলা ভাবেÑ ৩২ নম্বরে যারা হামলা করেছে, তারা কি পরিচিত ছিল? তাদেরকে কি ওই বাড়ির লোকেরা কিংবা কর্তা ব্যক্তি খুব বিশ^াস করত? তারা কি ভাবতে পেরেছিল যে, ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে? ওরা কি সত্যি সত্যি শত্রু ছিল? না-কি ভাড়া করা লোক ছিল? ভাড়ায় এলে কত টাকা পেয়েছিল? টাকা দিলে কি ওরা নিজের পরিবারের লোকদেরকে এভাবে মারতে পারত? ওরা কি তখন স্বাভাবিক ছিল? না-কি মাতাল ছিল? ওরা কি কারও কিংবা কারও কারও নির্দেশ পালন করতে এসেছিল? হত্যা করে তারা কি সুখ পেয়েছিল? না-কি তারাও কেঁদেছিল গোপনে? কিংবা হত্যাকারীদের কেউ কি ৩২ নম্বরের কারও প্রেমে পড়েছিল? প্রেমে কি ব্যর্থ কিংবা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল? কেন তারা হত্যা করল? ৩২ নম্বরের লোকেরা দেশের কী ক্ষতি করেছিল? সত্যিই কি তারা কিংবা তাদের কেউ একজন তাদের জন্যÑ সকলের জন্য ভয়ঙ্কর ছিল? মাটির আলগা চুলায় পাতার আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না শিলা। ছোট্ট হাতে সে আর কতটুকু সামলাবে? সেই কখন থেকে না-কি সেই কবে কোন কাল থেকে শিলা জ্বাল দিচ্ছে চুলায়। আজ আর রান্না শেষ হচ্ছে না কিছুতেই। কখন থেকে শুধু ফুÑফুÑফু করছে। একফোঁটা লকলকে আগুন সে চোখে দেখল না। নেভে আর জ্বলে। জ্বলে আর নেভে। বাতাস এত শক্তি কোথা থেকে পায়? কী করে এই বাতাস পাতা আর আগুনকে, চোখের জল আর নদীর ধারাকে, স্বপ্ন আর বাস্তবকে, জানা আর অজানাকে, পুরুষতা আর কাপুরুষতাকে এক করে দেয়? কী করে বাতাসের তোড়ে সবকিছু সমান হয়ে যায়! এটা কি বাতাস, না কেয়ামতের আলামত? সত্যি সত্যি কি ইসরাফিল তার চুঙ্গাতে শেষ ফু মারছে। তা না হলে এ রকম বাউলা বাতাস তো শিলা আগে কখনও দেখেনি। কোত্থেকে এলো এটা এই অবেলায়? ছোট্ট মাটির চুলার মুখটাকে শিলার এখন নদীর মতো লাগছে। ঠিক নদী নয়Ñ যেন অগ্নিগিরি। লাভা বেরুচ্ছে এখান থেকে। তপ্ত লাভা। দ্রুতগামী লাভা। চুলার মুখটির ভেতর দিয়ে বাতাস নয়Ñ যেন রক্তের অবিরল ধারা বয়ে চলেছে। না, রক্ত নাÑ অগ্নিলাভার জ্যোতি। আগুনের আঁচগুলো বৃষ্টির ঝাপটাকে অতিক্রম করে মৃদু আদর লেপে দেয় শিলার করুণ-কঠিন মুখে। হাতে মাখা মেহেদির রং আগুনের মতো লেলিহান হয়ে ঢুকে পড়ছে ছোট্ট চুলার মুখে। আর পাতাগুলো উড়ে ভেসে যেতে থাকে ৩২ নম্বরের দিকে। টিনের ঘরের বারান্দার ছোট্ট চুলাটি চোখের পলকে ৩২ নম্বরের ‘সুধা সদন’ হয়ে ওঠে। ধোঁয়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়। একটা অস্পষ্ট রেখা, একটা আবছা অবস্থা শিলার সামনে ঘুরপাক খেতে থাকে। বমি বমি লাগে তার। কেন এমন হচ্ছে? এ কি ঘেন্না? এ কি ক্ষুধার জ্বালা? এ কি ব্যর্থতার হাহাকার? সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে শিলা। কল্পনার শক্তি। বিবেচনার শক্তি। অনুভবের শক্তি। মাটির ছোট্ট চুলার মতো নিজেকে আলগা আলগা লাগে তার। তারপরও জোর করে একটা ফু দেয়।
×