ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

মৌসুমীর পরিবেশ বাঁচানোর সংগ্রাম

প্রকাশিত: ১২:১১, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

মৌসুমীর পরিবেশ বাঁচানোর সংগ্রাম

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অপূর্ব সুন্দর সব নদী দেশজুড়ে। অথচ নদী মারা যাচ্ছে। পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে। ইকোসিস্টেম ভেঙ্গে পড়েছে । উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুল একে একে বিলুপ্ত হচ্ছে। ছোট বেলায় যেসব ফুল দেখেছি, পাখি দেখেছি, সেসবের সমস্তই এখন অদৃশ্য। কথাগুলো ফারজানা হোসেন মৌসুমীর। তিনি একজন সাইক্লিষ্ট। নদী, পাহাড় রক্ষাসহ বিভিন্ন পরিবেশ সচেতনতায়মূলক কাজ করছেন। নভেরা নামে একটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। সচরাচর পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনগুলো যে আঙ্গিকে হয়। মৌসুমীরটা একটু ব্যতিক্রম। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রুপ নভেরা মেয়েদের সাইকেল চালানো শেখায়। সাইকেলে মেয়েরা র‌্যালি করে। সঙ্গে ঝুলানো থাকে নদী বাঁচাও, পাহাড় বাঁচাও, বন বাঁচাও, সবুজ বাঁচাও, পৃথিবী বাঁচাও, গাছ বাঁচাও, গাছ বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, বাতাস দূষণ বন্ধ কর, নির্মল বাতাস চাই, পানি দূষণ বন্ধ কর, পাখিদের বাঁচতে দাও, আমার মাটি আমার মা, উজার হতে দেব না, হাওড়-বাঁওড় বিল বাঁচাও, এমন সব সচেতনতামূলক কথা। রক্ষণশীলতার দেয়াল মৌসুমীরা যেন ভেঙ্গে ফেলেছে। মেয়ে মানুষ সাইকেল চালাবে। কত রকম কথা। কটাক্ষ তো আছেই। কিন্তু এসব কে মৌসুমীরা পাত্তাই দেন না। তিনি বলেন, আমরা যখন পরিবেশের জন্য কাজ করি। তখন আসলে কে কি বলল ওসব ভাবার একদমই সময় হয় না। নভেরা নারায়ণগঞ্জ জেলার স্বপ্নবাজ নারীদের গ্রুপ। ফেসবুক এই গ্রুপে প্রায় চার শ’ নারী সদস্য রয়েছেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ সাইকেল চালান। কিছু আছে যারা সাইকেল চালানো শিখতে আগ্রহী। দেশের প্রথম নারী ভাস্কর নভেরা আহমেদের নামে রাখা হয় এই গ্রুপের নাম। গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা মৌসুমী ইব্্রাহিম মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। সমাজ কল্যানমূলক কাজ করেন অনেক আগে থেকেই। তিনি ২০১৪ সালে সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের স্কুল সমগীত পাঠশালায় পড়াতেন। কারাতেও শিখেন সেই সময়ে। ২০১৪ তে তার সাইকেল চালানোর হাতেঘড়ি হয়। এতকিছু থাকতে সাইকেল কেন পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনের বাহন হিসাবে বেছে নেয়া হলো। মৌসুমী বলেন, মেয়েরা সাইকেল চালাতে পারে। এই সমাজ তা ভাবতেই পারে না। মেয়েদের সাইকেল চালানো ভাল চোখে দেখে না। নারীর সাইকেল চালানো এক সাহসী কাজ। কুসংস্কার আর অজ্ঞতার মূলে কুঠারাঘাত। অন্যদিকে সাইকেল পরিবেশবান্ধব বাহন। সাইকেলে জৈব জ্বালানি ব্যবহৃত হয় না। এসব কারণে সাইকেলকেই আমি বেছে নেই মানুষকে সচেতন করতে। আমরা বিভিন্ন সময় সাইকেল র‌্যালি করি। বিভিন্ন বিষয় মানুষকে সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করি। সে রকমই একটা ঘটনার কথা মৌসুমী জানালেন। এক বাস ড্রাইভার অযথাই হর্ন বাজিয়েই যাচ্ছিল। পরে আমরা তাকে হর্ন বাজানোর বিষয়টা বুঝিয়ে বলি। পরে তিনি এর ক্ষতিকারক দিকগুলো বুঝতে সক্ষম হন। বললেন মৌসুমী। দৃশ্যত এই সব কর্মকা-ে কোন পরিবর্তন এসেছে কি? মৌসুমী বলেন, আমাদের ছোট কাজগুলো এক সময় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। পরিবেশ দূষণ করলে নিজেরই ক্ষতি। মানুষের মধ্যে এই বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফলে অনেকেই এখন সচেতন হয়ে উঠেছে। মৌসুমী জানালেন, নভেরায় সাইকেল চালানো শিখতে কোন টাকা পয়সা দিতে হয় না। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে নভেরা। মাসে একটি কর্মশালা ৩ দিনব্যাপী হয়ে থাকে। বর্তমানে ন্যূনতম ১৬ জন মেয়ে এতে অংশ নেয়। এ পর্যন্ত ৫টি সফল কর্মশালার আয়োজন করেছে নভেরা। কর্মশালার আয়োজন কিছুদিন আগে শুরু হয়। তবে তারা সাইকেল শেখায় তিন বছর ধরে। সাইকেল না থাকলেও এখানে সাইকেল চালানো শেখা যায়। নভেরার সদস্যরা নিজেরা চাঁদা তুলে সাইকেল কিনে নিয়েছে। ১৫ জন প্রশিক্ষক রয়েছেন। যারা বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। আবার সময় করে সাইকেল চালানো শেখান। কর্মশালার বাইরে প্রায় শতাধিক নারী সাইকেল চালানো শিখেছে বলে জানা গেছে। এই গ্রুপে এসে সাইকেল চালানো শিখে এখন অন্যদের শেখাচ্ছেন। এমন অনেকে আছেন বলে জানা গেল। নভেরার একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সুমনা আক্তার। তিনি বলেন, আমাদের কার্যক্রমে বিভিন্ন বয়সী নারীদের উৎসাহ, আগ্রহ দেখা গেছে। যা আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি মনে করেন, কম দূরত্বে আমরা সবাই সাইকেল ব্যবহার করলে পরিবেশের ক্ষতির পরিমাণ একটু হলেও কমবে। জানা গেল তিনি নিজেও যাতায়াতের জন্য সাইকেল বেছে নেন। ২০১৯ সালের জলবায়ু সপ্তাহে নভেরার সদস্যরা পরিবেশবান্ধব বাহন সাইকেলে চলে মানুষের প্রতি আহ্বান জানায়, পরিবেশের সমস্ত উপাদানের প্রতি মানুষের প্রবল ‘ভালবাসা’ জন্ম হোক। প্রত্যেক মানুষ চেতনা ফিরে পাক, পরিবেশকে সুরক্ষা করেও উন্নয়ন সম্ভব।
×