ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শত উপজেলায় হচ্ছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

প্রকাশিত: ১১:০১, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

শত উপজেলায় হচ্ছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

মনোয়ার হোসেন ॥ প্রান্তিক পর্যায়ে সংস্কৃতিচর্চাকে ছড়াতে চায় সরকার। শিল্পের আলোয় রাঙাতে চায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশকে। সেই আলোয় মনের আঁধার দূর হয়ে মানুষের মধ্যে জাগ্রত হবে শুভবোধের চেতনা। সংস্কৃতির আশ্রয়ে মৌলবাদ প্রতিরোধ করে মানবিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে নানা কর্মপরিকল্পনা। সেই কার্যক্রমেরই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। উপজেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে সংস্কৃতিচর্চা বিস্তারের উদ্যোগ হিসেবে দেশব্যাপী নির্মিত হবে উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া পর্যন্ত হবে এসব সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এ পরিকল্পনার প্রথম ধাপে একশ’ উপজেলায় নির্মিত হবে কেন্দ্র। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ইতোমধ্যে শত উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভূমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কেন্দ্রের নির্মাণকাজ শুরুর কথা রয়েছে এ বছর থেকেই ’২১ সালের জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। প্রথমে শত উপজেলায় হলেও পরে ধাপে ধাপে দেশের ৪৯২ উপজেলায়ই গড়ে উঠবে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপের কেন্দ্রসমূহের নক্সা চূড়ান্ত হয়েছে। চলছে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) প্রণয়নের কাজ। প্রথম ধাপে একশ’ উপজেলায় ৬০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে উঠবে এসব কেন্দ্র। আধুনিক সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন ও নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত হবে চারতলা ভবনের প্রতিটি কেন্দ্র। প্রতিটি কেন্দ্রে থাকবে তিন থেকে চারশ আসনের একটি অডিটরিয়াম। উচ্চমানের শব্দ ব্যবস্থাপনা ও উপযুক্ত আলোকপ্রক্ষেপণ ব্যবস্থা সংযুক্ত হবে এসব মিলনায়তনে। অডিটরিয়ামের উপরে থাকবে দেড় শ’ আসনের মাল্টিপারপাস হলো, যেখানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যাবে। এছাড়া বিনা খরচে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য থাকবে একটি করে এ্যাম্ফিথিয়েটার বা মুক্ত মঞ্চ। বইয়ের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টিতে প্রতিটি কেন্দ্রে থাকবে একটি করে গ্রন্থাগার, প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক পৃথক কক্ষ। এসব প্রশিক্ষণ কক্ষে নাচ-গান, আবৃত্তি, নাটকসহ সংস্কৃতির নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পাবেন এলাকার অধিবাসীরা। বিভিন্ন বিষয়ক আলোচনাধর্মী অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য থাকবে সেমিনার কক্ষ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নেয়া উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। নির্মাণকাজ সম্পন্ন করবে গণপূর্ণ অধিদফতর। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, স্থাপত্য অধিদফতরের মাধ্যমে উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহের নক্সা চূড়ান্ত হয়েছে। এখন চলছে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপ্রোজাল (ডিপিপি) প্রণয়নের কাজ। কর্তৃক প্রকল্পের বাজেটসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই শেষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) মাধ্যমে ডিপিপি অনুমোদন দেয়া হবে। এছাড়া প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে একশ’ উপজেলার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের অধিকাংশের ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিছু এলাকার জমি চিহ্নিত করে সেগুলো অধিগ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নক্সা করছেন স্থাপত্য অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি আসিফুর রহমান ভূঁইয়া। শিখা চিরন্তনের নক্সাবিদ এই স্থপতি জনকণ্ঠকে বলেন, সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রেখেই উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নক্সা করা হয়েছে। প্রতিটি ভবনের স্থাপত্যশৈলী হবে নান্দনিক। স্থানভেদে ৩০০ ও ৪০০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন থাকবে প্রতিটি কেন্দ্রে। এই মিলনায়তনের পাশেই থাকবে মেকআপ রুম ও মহড়াকক্ষ। প্রতিটি কেন্দ্রের নক্সায় স্থানীয় মহিলাদের সুবিধার কথা বিবেচনায় রাখা হচ্ছে মাতৃদুগ্ধ পান কেন্দ্র। প্রতিবন্ধীদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে তাদের জন্য মিলনায়তনে প্রবেশের পৃথক ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। উপজেলাসমূহের স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের বিনা খরচে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য থাকবে মুক্ত মঞ্চ বা এ্যাম্ফিথিয়েটার। মাল্টিপারপাস হলের সঙ্গে থাকবে ক্যাফেটেরিয়া। অতিথিদের আবাসনের জন্য প্রতিটি কেন্দ্রে থাকবে ডরমেটরি। স্থানীয় তরুণদের সৃজনশীল আড্ডার জন্য কেন্দ্রের উন্মুক্ত স্থানে বসার ব্যবস্থা থাকবে। সংযুক্ত হবে গাড়ি পার্কিং জোন। সব মিলিয়ে প্রতিটি উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রই স্থাপিত হবে অত্যাধুনিক নক্সায়। দৃষ্টিনন্দন এসব কেন্দ্র নিয়ে স্থানীয় লোকজন যেন নান্দনিক স্থাপনার অহংকার করতে পারে সেই ভাবনা প্রতিফলন থাকছে নক্সায়। নক্সার রূপায়নের কাজ চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই চূড়ান্ত নক্সাটি তুলে দেয়া বাস্তবায়নকারী সংস্থা শিল্পকলা একাডেমির কাছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী জানান, এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে চাই। বাংলার আবহমান শিল্প-সংস্কৃতির অস্তিত্ব ধরে রাখার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে চাই। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৌলবাদও রুখে দিতে হবে। দেশের তৃণমূলের মানুষকে সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত করতে পারলে অশুভ অপতৎপরতা রোধ করা সহজ হবে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে আমরা একশ’ উপজেলায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করব। পরে ধাপে ধাপে সারাদেশের ৪৯২ উপজেলায়ই এই সংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের একশ’ উপজেলায় কেন্দ্র নির্মাণে ইতোমধ্যে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। সাংস্কৃতিক ভবনসমূহের নক্সাও চূড়ান্ত হয়েছে। এখন ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। এরপর সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহ নির্মাণের বাজেটসহ ডিপিপির খুটিনাটি বিষয় খতিয়ে দেখবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একনেকের মাধ্যমে ডিপিপি অনুমোদন হবে। সেই সুবাদে এ বছরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাই। ’২১ সালের জুনের মধ্যে প্রথম ধাপের একশ’ উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে চাই। শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে এই প্রকল্প। তাই উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভবনগুলো যেন নাট্য মঞ্চায়নসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের উপযোগী হয় সে বিষয়ে একাডেমিকে সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিমত নিতে করতে বলা হয়েছে। উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণকে দেশের সংস্কৃতিচর্চায় ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জনকণ্ঠকে বলেন, দশ বছর ধরে আমরা জোটের পক্ষ থেকে দেশের প্রতিটি উপজেলায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছি। বিলম্বে হলেও এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতিচর্চার জন্য ইতিবাচক। তবে প্রকল্পের যথার্থ বাস্তবায়নে শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টজনদের যুক্ত করতে হবে। প্রতিটি কেন্দ্রের কতগুলো মহড়াকক্ষ থাকবে, কতগুলো প্রশিক্ষণ কক্ষ থাকবে, শিল্পীদের আলাপচারিতা বা আড্ডার স্থান কেমন হবেÑ সেসব বিষয়ে সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। মিলনায়তনের মঞ্চ কত ফুট উঁচু হবে, সেটা নাটকের জন্য উপযোগী হবে কিনাÑ সে বিষয়ে নাট্যজনদের ভাবনাকে সংযুক্ত করতে হবে। প্রতিটি কেন্দ্রের প্রতিটি মিলনায়তনের শব্দ ব্যবস্থাপনা ও সুচারু আলোকপ্রক্ষেপণ পদ্ধতি করতে হবে। কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়ার শুরুতে এসব বিষয় খেয়াল না রাখলে পরে সেগুলো সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবর্তে কমিউনিটি সেন্টার হিসেবেই ব্যবহার করা হবে। এছাড়া শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, প্রকল্পের অধীন কেন্দ্রসমূহ নির্মাণকাজের সময়ও নির্ধারণ করতে হবে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যাতে দীর্ঘসূত্রতায় না পড়ে সে বিষয়ে নজর রাখতে হবে। প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহ : ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ, সাভার, দোহার, ধামরাই ও নবাবগঞ্জে ও মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় হবে উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। টাঙ্গাইল জেলার কেন্দ্রসমূহ নির্মিত হবে নাগপুর, ঘাটাইল, সখিপুর, কালিহাতি, ধনবাড়ী ও মধুপুরে। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন, রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ও বালিয়াকান্দি, মাদারীপুরের শিবচর গাজীপুরের কালীগঞ্জ, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া, ফরিদপুরের মধুখালী, নগরকান্দা, চরভদ্রাসন, শরীয়তপুরের নড়িয়ায় উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হবে। এছাড়া ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ফুলবাড়িয়া, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা, জামালপুরের বকশীগঞ্জ দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর ও মেলান্দহ, নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি, আটপাড়া, কেন্দুয়া ও দুর্গাপুর, শেরপুরের নালিতাবাড়ী, রাজশাহীর দুর্গাপুর, গোদাগাড়ী ও জয়পুরহাটের পাঁচবিবি ও খেতলাল, সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া ও বগুড়ার শেরপুর, সারিয়াকান্দি ও সোনাতলায়, নওগার মহাদেবপুর, আত্রাই, ধামইরহাট, মান্দা, নিয়ামতপুর, সাপাহার ও পতœীতলা, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ, খানসামা, ঘোড়াঘাট ও কাহারোল, রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা পঞ্চগড়ের বোদা, তেঁতুলিয়া, দেবীধস, নীলফামারীর জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও ডোমার, কুড়িগ্রামের রাজিবপুর, উলিপুর ও ভুরুঙ্গামারী, খুলনার বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া, সাতক্ষীরার দেবহাটা, কচুয়া, ফকিরহাট ও মোরেলগঞ্জ, কুষ্টিয়ার খোকসা, মেহেরপুর সদর, ঝিনাইদহের শৈলকুপা, কালীগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর, ভোলার লালমোহন, বরগুনা সদর, পিরোজপুরের ভা-ারিয়া, চট্টগ্রামের রাউজান, আনোয়ারা ও রাঙ্গুনিয়া, কক্সবাজারের রামু ও কুতুবদিয়া, কুমিল্লার মেঘনা, হোমনা, সুনামগঞ্জের দিরাইসহ নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলায় কয়েকটি উপজেলা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
×