ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আব্দুল্লাহ আল মাসুম

রেডিও-টিভিতে বিকৃতি!

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ৩০ জানুয়ারি ২০২০

রেডিও-টিভিতে বিকৃতি!

মুটে-মজুর, মেথর, চাষাকে সালাম। তথাকথিত এই নিম্ন শ্রেণীর মুখে রক্তে ভেজা বাংলার বিকৃতি হচ্ছে না। হচ্ছে আপনাদের দ্বারাই। যারা বিকৃত বাংলায় কথা বলতে পেরে নিজেদের আধুনিক ভাবেন তাদের বলছি। কী আশ্চর্য ব্যাপার তাই না! তরুণ প্রজন্মের তথাকথিত আধুনিক, উচ্চ শিক্ষিতের দাবিদার একটি অংশ নিজ মাতৃভাষায় যখন ঠিকমতো ভাব প্রকাশ করতে পারে না, উচ্চারণ করতে পারে না বর্ণগুলো, জানে না কোন স্থানে কোন শব্দ ব্যবহার করতে হবে তখন তারা সভ্য, আধুনিক, সেরাদের সেরা। আর এই প্রজন্মেরই আরেকটি অংশ যখন বিকৃতি এড়িয়ে বিশুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে, বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণ এড়িয়ে চলে, অথবা এসব বিকৃত শব্দ জানে না, বুঝে না, সচেতনভাবে বলে না তখন তারা হয়ে যায় ‘ক্ষ্যাত’, বোকা, উচ্চ শ্রেণীতে বিচরণের অযোগ্য বা সার্কাসের সঙ। ভাষার এই করুণ অবস্থা বেশি দিনের নয়। এফএম রেডিওতে ‘রেডিও জকি’দের হাত ধরে বিকৃত উপস্থাপনার ভঙ্গি শুরুর পর থেকেই খুব অল্প দিনেই দ্রুত শব্দে পরিবর্তন শুরু হয়। মহামারীর মতো সংক্রমিত হতে থাকে তরুণ প্রজন্ম। ভাষার এই বিকৃতিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা বুঝতে সাদাকালো যুগের গণমাধ্যম ও বর্তমান গণমাধ্যমে ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করতে হবে। আমাদের বাবা-মায়েদের সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বিজ্ঞান লেখক আবদুল্লাহ আল মূতি শরফুদ্দীন, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কবি আসাদ চৌধুরী, উপস্থাপক ফজলে লোহানী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ মোমেন চৌধুরী, অধ্যাপক মুস্তফা নুরুল ইসলাম, ফরহাদ খান, সেলিনা হোসেন, বেতারে মোস্তফা কামাল সৈয়দ, ড. সেলিম জাহান, কৌশিক আহমেদ, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান আতাউর রহমান, শফি কামালদের কথা শুনে তাদের মতো করে শুদ্ধ ও পরিশীলিতভাবে কথা বলা, শুদ্ধ উচ্চারণ জানা, নতুন শব্দ শেখার চেষ্টা করত সচেতন দর্শকেরা। আমরাও গণমাধ্যম থেকে ভাষার উচ্চারণ শিখছি। তবে আমাদের সময়ের গণমাধ্যমের ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই অতীতের অবস্থানে নেই। আমরা ও আমাদের শিশুরা আকাশ সংস্কৃতির ছোয়ায় শত ভিনদেশী টেলিভিশন মাধ্যমে এবং সেই সঙ্গে আমাদের দেশীয় উদ্যোক্তাদের বদৌলতে বেড়ে উঠছে আরও ‘স্মার্ট’ হয়ে মাতৃভাষাহীনতায় ভোগা এক আশ্চর্য প্রজন্ম হয়ে। সবচেয়ে বিধ্বংসী ফলাফল আসবে অনাগত প্রজন্মের হাত ধরে। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের বাবা-মায়েরা বিকৃত উচ্চারণের ভাষার অধিকারী নয়। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম দূষণে আক্রান্ত। এই প্রজন্ম জন্ম দেবে নতুন প্রজন্মের। অনাগত প্রজন্ম মাতৃকোলেই এই সংক্রামক ব্যাধির মরণ থাবার শিকার হবে। মায়ের মুখ থেকে শিখবে মিশ্র ভাষার দূষিত বিকৃত শব্দ। অনাগত প্রজন্মের মাতৃভাষা হবে ‘বাংহিংলিশ’। আমাদের অন্যতম সম্পদ আঞ্চলিক ভাষার বিভিন্নতা। অথচ আজ টিভি নাটক, বিজ্ঞাপন ও এফএম রেডিও তা উপহাসে পরিণত করেছে। ভাষা তো ভাষাই। ভাষার অবমাননা মানা যায় না। আমি যে মাটি থেকে জন্মেছি সে মাটির, আমার মায়ের শব্দমালা নিয়ে ঠাট্টা করা প্রমাণ করে একটা জাতি কতটা মূল্যবোধহীন হয়ে বেড়ে উঠছে। মায়ের ভাষার সম্মান রক্ষাই একুশের চেতনা। আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা ফেলনা নয়। কোন ভাষাকেই উপহাসের ভঙ্গিতে উপস্থাপন করাকে সমর্থন করা যায় না। শুধু ভাষার মাসে নয়, ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে হবে বছরের প্রতিটি দিন প্রতিটি নাগরিককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে
×