ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অলোক আচার্য

ভাষার প্রতি ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৯:২০, ৩০ জানুয়ারি ২০২০

ভাষার প্রতি ভালবাসা

ভাষা আমাদের অহঙ্কার। একুশ এলেই ভাষা নিয়ে যে তোড়জোড় চোখে পড়ে তার কিছুটা যদি সারা বছর থাকত তাহলে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহারের ভ্রান্তি নিয়ে এত কথা হতো না। সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নিয়ে এত কষ্ট করতে হতো না। একুশে ফেব্রুয়ারির পরের দিনই দিবসটি পালন নিয়ে বিভিন্ন স্থানের নানা অজ্ঞানতার খবর পেয়েছি। সেসবের ভেতর শহীদ মিনারে জুতা পায়ে ওঠা সেলফি তোলা থেকে শুরু করে নানা রকম অসঙ্গতি চোখে পড়েছে। শহীদ দিবসকে স্বাধীনতা দিবস, ব্যানারগুলোতে বানানের ভুলের প্রতিযোগিতা এসবই ঘটেছে একুশের দিনে। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাড়িতে বাড়িতে শহীদ মিনার বানিয়ে পালন করেছে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই কি একুশের পেছনের ইতিহাস জানে? নাকি কেবলমাত্র আনন্দ করার উদ্দেশ্য নিয়েই এটা পালন করে। অন্তত আধুনিক যুগের বিশাল বিশাল সাউন্ড বক্স আর ডিজে গান বাজানোতে এটা অনুমান করাই যায়। বড় হিসেবে আমাদেরও তো দায়িত্ব রয়েছে ওদের ভাষার ইতিহাস শোনানো। আসলে একুশে ফেব্রুয়ারি যত না পালনের তার চেয়ে বেশি আড়ম্বরের হয়ে যাচ্ছে। মানেটা হলো দিন শেষ তো সব শেষ। সারা বছর আবার সেই ভুল, আবার বিদেশী ভাষার প্রাধান্য। ভুল বানানের ছড়াছড়ি। যেন বানান ভুলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। খোদ একুশে ফেব্রুয়ারিতে ব্যানারে যত ভুল পত্রিকাগুলোতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এসেছে তা আমাদের হতাশ করে দেয়। কিন্তু দিবস পালনের উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি নেই আমাদের। কিন্তু তার সঙ্গে ইতিহাসটাও জানতে হবে। এক ব্যানারে তো দেখলাম স্বাধীনতা দিবসের ইতিহাস আর ফেব্রুয়ারির ইতিহাস সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে ভুল বানান আমাদের চোখে এতটা সয়ে গেছে যে, সেটা যে ভুল তা আর মনেই থাকে না। মনে হয় হোক, একটু আধটু ভুল হলে কি ক্ষতি। ক্ষতির পরিমাণ যে কতখানি তা যতই দিন যাচ্ছে দেখছি ভুল বাড়তে বাড়তে এত বেশি হয়ে গেছে যে তা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। কিন্তু এর শোধরানোর তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। ব্যানার, লিফলেট, সাইনবোর্ড, দেয়াল সব জায়গাতে ভুল। অথচ শুদ্ধ ও সঠিক চর্চার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আমরাই এগিয়ে নিয়ে যাব। আমরা তো সারাক্ষণ হিন্দী, ইংরেজী চর্চা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাই। লেখাপড়া করছি তো সঠিক ইংরেজী শিখতে হবে। হিন্দী সিরিয়াল বা সিনেমা দেখতে হবে। বাংলার উপর গুরুত্ব দেয়ার সময় কোথায়। তাহলে বাংলা শিখবে কিভাবে। ভুল বানান হলে তা ধরিয়ে দেয়ার লোক নেই। হচ্ছে তো হোক। কার কি আসে যায়। দেশে অনেক ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল রয়েছে। সেখানে ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলার সঠিক ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ হলে ভাল হয়। আমি বার বার বলছি বর্তমান যুগে চলতে গেলে বিদেশী ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু তা যে কোনভাবেই মাতৃভাষাকে কম গুরুত্ব দিয়ে তা আমি মানতে নারাজ। আমাদের প্রজন্ম, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। স্কুলগুলোতে শুধুমাত্র ইংরেজী বা অঙ্ক বা বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি ভীতিসূচক গুরুত্ব না দিয়ে পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য, বাংলা ব্যাকরণ এসব বিষয়কে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করতে হবে। মাতৃভাষার প্রতি যে মমতা তা খুব অল্প বয়স থেকেই শুরু করা উচিত বলে মনে হয়। ফেব্রুয়ারি এলেই বাংলা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। বংলা ভাষার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ কতখানি তা পরিমাপের একটা চেষ্টা করা হয়। আসলেই বিষয়টা এমন হওয়া উচিত? সারা বছর বাংলা নিয়ে চর্চা হবে। সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করার চেষ্টা করা হবে। মোট কথা শুধু কাগজে-কলমে নয় অন্তরে স্থান দিতে হবে বাংলাকে। তাহলেই অন্তর হবে শুদ্ধ। আর শুদ্ধ অন্তর দিয়ে যে ভাষাই আয়ত্ত করতে চাও না কেন তা সম্ভব। কবি সেই কবেই মাতৃভাষাকে মাতৃদুগ্ধের সঙ্গে তুলনা করে গেছেন। প্রথম জীবনে পরভাষায় সাহিত্য চর্চাকারী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বুঝতে পেরেছিলেন শিকড় ছেড়ে যে কা-ের খোঁজে ছুটেছিলেন তার কি যন্ত্রণা। দেশে ফেরার পর তো তার কলমের শুধু ইতিহাস। মাতৃভাষার গুরুত্ব এত সাবলীলভাবে তার বিভিন্ন কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছেন তা সবার জানা। সনেট কবিতার জন্ম দিয়ে তিনি আলাদা একটা ধারার জন্ম দিলেন। নিজের ভাষা সঠিকভাবে আয়ত্ত করতে না পারলে ভিনদেশী ভাষা যে আয়ত্ত করা কঠিন সে অতি খাঁটি কথা। পাবনা থেকে
×