ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহাঙ্গীর আলম সরকার

অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ৩০ জানুয়ারি ২০২০

অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা

ঊষাকালের সপ্তবর্ণের মধুর ছটা ছড়িয়ে সূর্য চরাচরের প্রতিটি প্রাণকণাকে যেভাবে উজ্জীবিত করে তোলে, ঠিক তেমনি ১৯৭২ সালের শীতের এক দিনে যখন বঙ্গবন্ধু দেশের মাটিতে নামেন, তখন কোটি বাঙালীর হৃদয়ে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করে। ২৯০ দিন পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থাকার পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়। তিনি বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান থেকে লন্ডন ও ভারত হয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর অন্ধকারের অপদেবতারা দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। ফলে স্বয়ং তিনি এই প্রত্যাবর্তনকে ‘অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেই রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করে দিতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যা চালায় বাংলাদশের সকল প্রান্তের নিরস্ত্র জনগণের ওপর। বঙ্গবন্ধু জানতেন, সামরিক জান্তা সরকার তাঁকে গ্রেফতার করবেই। ফলে তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি। তিনি আত্মগোপনে যাননি দুই কারণে। প্রথমত, তিনি কখনও সুবিধাবাদী শ্রেণীর মতো ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করেননি। দ্বিতীয়ত, তিনি পলাতক থাকলে সাধারণ জনগণের ওপর আরও ব্যাপক ভিত্তিতে গণহত্যা চালানো হতো। বঙ্গবন্ধু তাঁর নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপোস করেননি। কাজেই দৃঢ়চেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পূর্বেও কোন রকমের ভয় স্পর্শ করতে পারেনি। সূদুরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা করে দূরদর্শিতার সঙ্গে তিনি তাঁর বিশ্বাসভাজনদের সকল দায়িত্ব অর্পণ করে যান। দেশের আপমর জনগণের ওপর তাঁর বিশ্বাস ছিল অপরিসীম। তিনি বিশ্বাস করতেন, তৃণমূলের সাধারণ প্রান্তিক মানুষ শুধু যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েই ক্ষান্ত হবে না; বরং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দেশমাতৃকার বিজয় সুনিশ্চিত করবেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা তিনি পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে ফাঁসির অপেক্ষায় বন্দী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হয়। এত বড় অর্জনের পরও একটি বিশাল অপূর্ণতা ছিল সকলের হৃদয়ে। কেননা, এই বিজয় ইতিহাসের যিনি মহানায়ক, যার নামে মহান মুক্তিযুদ্ধে হাসিমুখে জীবন দিয়েছেন বাংলার অগণিত নারী-পুরুষ, তারই অপেক্ষায় ছিলেন বাংলার জনগণ। দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকা মানুষগুলোর অপেক্ষার পালা শেষ হয়। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হন ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি তারিখে। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সংবাদে প্রচার করে বলা হয় : ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডনে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে অবতরণ করবে।’ বিমানটি অবতরণের পর বিমান থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু ভিআইপি লাউঞ্চে আসলে তাকে ব্রিটিশ বৈদেশিক দফতরের উপস্থিত কিছু কর্মকর্তা স্বাগত জানান। দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্যার ইয়ার মাদারল্যান্ড এসে তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসেন। সেখানে লেবার পার্টির নেতা হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে সম্বোধন করেন, ‘গুড মর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট।’ এরপর বঙ্গবন্ধুর লন্ডনে পৌঁছার সংবাদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে নজিরবিহীন সম্মান দেখান। শুধু তাই নয়; বরং হিথ স্বয়ং তাঁর কার্যালয়ের বাইরে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু গাড়ি থেকে বেরিয়ে না এলেন। সকালে তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এ্যাডওয়ার্ড হিথ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ১০ জানুয়ারি তিনি ভারতে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা ও তিন বাহিনীর প্রধানগণসহ সর্বস্তরের জনগণের কাছ থেকে সংবর্ধনা গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় ভারতের জনগণের কাছে এবং সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভারত থেকে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে রক্ত¯œাত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হন। অবশেষে ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটের সময় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী সেই ঐতিহাসিক বিমানটি যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করে, তখন লাখো মানুষের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত চারদিক। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমে চলে যান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে সাধারণ জনগণের কাছে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের শুরুতেই বললেন, ‘স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সিপাই, পুলিশ, জনগণকে, হিন্দু, মুসলমান হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমি আপনাদের কাছে দু-একটা কথা বলতে চাই।’ এরপর তিনি জনতার উদ্দেশে নতুন বার্তা প্রেরণ করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ফিরে এসেই তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির ডাক দেন। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মা-বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’ সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের সেই জনসমুদ্রে তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নয়নের জন্য ডাক দিয়ে বলেন যে, ‘যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙ্গে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেয়ার চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না, আমি ক্ষমা করব না।’ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণতা আসে। কেননা, বঙ্গবন্ধু ছাড়া সেই স্বাধীনতা ছিল ম্লান হয়ে যাওয়া এক স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনের পরও বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশ ছিল অন্ধকারে নিমজ্জিত। কেননা, বাংলাদেশের আকাশের সূর্য ছিল পাকিস্তানের কারাগারে আটক। কিন্তু সূর্যকে তো আর হাতের মুঠোয় বন্দী করে রাখা যায় না। কাজেই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন বলেই স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশ একটি আদর্শ সংবিধান পেয়েছিল। মাত্র তিন মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে ভারতে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করার এক অনন্য নজির সৃষ্টি করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর উন্নয়নের সেই ধারা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা সফল হতে শুরু করেছে তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়ে উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে। শুধু তাই নয়; বরং ২০১৫ সালে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০১৮ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে। লেখা বাহুল্য যে, পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু সেদিন দেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলেই উন্নত বাংলাদেশের সাফল্যের সেই ভিত রচনা করা সম্ভব হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির এক আলোকিত অভিযাত্রার দিনের সূচনা করে। লেখক : আইনজীবী [email protected]
×