ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবিলম্বে ন্যাশনাল এক্সপার্ট কমিটি গঠন করুন ॥ পরামর্শ ডাঃ বি চৌধুরীর

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২৯ জানুয়ারি ২০২০

অবিলম্বে ন্যাশনাল এক্সপার্ট কমিটি গঠন করুন ॥ পরামর্শ ডাঃ বি চৌধুরীর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অধ্যাপক ডাঃ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি যতটা পরিচিত এর পেছনে রয়েছে তার আরেকটি বড় পরিচয়। তিনি ছিলেন রোগ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, সাবেক রাষ্ট্রপতি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। যদিও রাজনৈতিক কারণে তিনি এখন আর বিএনপির ঘরে নেই। প্রগতি সরণি এলাকায় কে সি মেমোরিয়ালে নিয়মিত রোগী দেখেন। সামাজিক দায়বদ্ধতা আর মানুষের ভালবাসা থেকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেন গরিব দুঃখী মানুষের। চীনের করোনা ভাইরাস নিয়ে যখন বিশ^ চিন্তিত তখন বাংলাদেশে এই ভাইরাস রোধে বিস্তারিত পরামর্শ নিয়ে হাজির হয়েছেন তিনি। পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল কমিটি অব এক্সপার্ট গঠনের। মঙ্গলবার বি চৌধুরীর পক্ষে তার প্রেস সেক্রেটারি জাহাঙ্গীর আলম গণমাধ্যমে লিখিত বক্তব্য পাঠান। এতে বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক বলেন, মাত্র ১৭/১৮ দিনে চীনের নতুন ছোঁয়াচে করোনা ভাইরাস রোগ চীন তো বটেই সারা পৃথিবীতে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি এটা যেমন সত্য এবং এটাও সত্য চীনের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে আমাদের যাতায়াত এবং যোগাযোগ উপেক্ষা করার মতো নয়। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে এই ভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস কি ॥ করোনা ভাইরাস সংক্ষেপে সিওভি। এটি নতুন ভাইরাস। যা মনুষ্য সমাজে আগে কখনও ছিল না। চীনের ইউনান প্রদেশের একটি বাজারে যেখানে বন্য পশু এবং মাছ বিক্রি হতো সেখান থেকেই প্রথম মানুষ সংক্রমণ হয়। এভাবে জন্তু-জানোয়ার থেকে মানুষের দেহে এই নতুন ভাইরাস প্রবেশ করে। তারপর এটা বিদ্যুত গতিতে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে (ছোঁয়াচে রোগ) ছড়িয়ে পড়েছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ইবোলা, এইচআইভি সংক্রমণের মতো এটাও মানব সমাজের ওপর একটি নতুন ভাইরাসের আক্রমণ। এর ফলে এই ভাইরাস ও রোগ সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্রুতগতিতে এর সমাধান খুঁজছে। বর্তমানে চীনের সমগ্র পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সমস্ত প্রদেশে এটা এপেডিমিক পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে দ্রুতগতিতে। অন্য দেশে ॥ চীনেই এটা থেমে থাকেনি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এর সংক্রমণ চলছে। দেখা গেছে, চীন থেকে যারা অন্য দেশে গেছেন তাদের মধ্যে এই রোগ দেখা যাচ্ছে। হংকং, তাইওয়ান, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপিন্স ও থাইল্যান্ডে। এ ছায়াও ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে এই রোগী শনাক্ত করা গেছে। সব ক্ষেত্রেই যারা সম্প্রতি চীন ঘুরে এসেছেন তাদের মধ্যে এ রোগ ধরা পড়েছে। গত ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশিত চীনের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় শনাক্ত করা দুই হাজার রোগীর মধ্যে ৫৬ জন মারা গেছেন (শতকরা ২ দশমিক ৮ ভাগ)। এখনও গুরুতর অসুস্থ ৩০০ জন (শতকরা ১৫ ভাগ) ১৬/১৭ দিনে এই অবস্থা। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক এতে কোন সন্দেহ নেই। রোগের উপসর্গ ও লক্ষণ ॥ করোনা ভাইরাস এটি শ্বাসনালী সংক্রামক ভাইরাস। সুতরাং এর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপসর্গ হচ্ছেÑ জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। গুরুতর শ্বাসকষ্ট একটি মারাত্মক উপসর্গ। যার মানে হচ্ছে রোগটি নিউমোনিয়ার দিকে যাচ্ছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ এবং শিশুদের নিউমোনিয়া অত্যন্ত মারাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যায়ে লিভার এবং কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসা ॥ এ রোগের এখন পর্যন্ত খুব ভাল চিকিৎসা বের হয়নি। প্রথমত রোগী থেকে সংক্রমণ যাতে না ছড়াতে পারে সেজন্য তাকে আলাদা রাখতে হবে। এর জন্য সংক্রামক হাসপাতালে (ইনফেকশাস হসপিটাল) তাকে ভর্তি করতে হবে। এই হাসপাতালে ছোঁয়াচে রোগের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও সেবক/ সেবিকার মাধ্যমে চিকিৎসা দেয়া হয়। এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে তারমধ্যে প্রোটিএইচ ইনহিবিটর, যথা লোপেনাভির এবং রেটোনাভির এজেন্ট। (নিউমোনিয়া রোগীদের জন্য) এক্সপেরিমেন্টাল জন্তুদের ওপরে ইন্টারফেরন ব্যবহার করা হয়েছে। মানুষের ওপর ব্যবহারের ফল এখনও জানা যায়নি এবং এই রোগের বিরুদ্ধে এখনও কোন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। তবে চেষ্টা শুরু হয়েছে। রোগ প্রতিরোধ সহজ ও সস্তা ॥ এখন পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধের পুরোপুরি ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা জানি না। তবে এটা জানা যায়, মানুষ থেকে মানুষে এ রোগ সংক্রমিত হয়। আমরা এখন এও জানি যার ভেতরে এই জীবাণু প্রবেশ করেছে তার থেকে সুস্থ মানুষের মধ্যে এ জীবাণু প্রবেশ করার পর ১০/১২ দিন পর রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায়। কিন্তু উপসর্গ প্রকাশ করার আগে থেকেই জীবাণু তার ভেতরে প্রবেশের কারণে তিনি ছোঁয়াচে হয়ে যান। প্রথম পর্যায়ে তিনি একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে সমাজে বিচরণ করতে পারেন। সাধারণত নিশ্বাসের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। তাদের হাঁচি, কাশিতে অজস্র জীবাণু বের হয়। সুস্থ মানুষ নিশ্বাসে অথবা ভেজা চোখের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। হাতে বা আঙ্গুলে জীবাণু থাকলে সেটা নাক, চোখ স্পর্শ করার ফলে হাতের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে দ্রুতগতিতে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ সারাদিনে ২০/২৩ বার তার হাত বা আঙ্গুল মুখে, চোখে, নাকে লাগায় প্রতি ঘণ্টায়। সুতরাং জাগ্রত অবস্থায় ১৮ ঘণ্টায় ৩৬০ বার মুখম-লে চোখ বা নাকে হাত দেয়। এক. সেই জন্য বার বার হ্যান্ড লোশন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দুই. মাস্ক বা মুখোশ পরা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে মাস্কের বড় অসুবিধা এতে চোখ ঢেকে রাখা যায় না। মাস্কের আশপাশে ঢিলা থাকে এবং মাস্ক বারবার বদলানো যায় না। এজন্য বয় এবং টাইট মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন। কোথা থেকে রোগ ছড়ায় ॥ এক. রোগীর বাড়ি থেকে। দুই. যেখানে অনেক জনসমাগম হয়। যেমনÑ জনসভা, ধর্মীয় সভা, বাচ্চাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালের আউটডোর, ব্যক্তিগত ও সরকারী সামাজিক আয়োজন। পার্টি সেন্টার পার্ক, সিনেমা হল ইত্যাদি। চীনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে ইউনান প্রদেশে এই সমস্ত স্থান সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। গণপরিবহন, উড়োজাহাজ, রেলগাড়ি ইত্যাদি। এগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। এয়ারপোর্ট, সমুদ্র বন্দর, রেল স্টেশন হাসপাতাল আউটডোর ইত্যাদি জনবহুল স্থানে স্ক্যান করতে হবে। চীনে ব্যবহৃত জ্বর দেখার স্ক্যানার জোগাড় করতে হবে। এটা শুধু কপালের কাছে লাগালেই গাণিতিক অক্ষরে স্পষ্টভাবে দেখা যাবে, যা ভাইরাসের প্রথম উপসর্গ জ্বর। টিভি, বেতার, সংবাদপত্রকে তাদের যোগ্য ও প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে হবে। কেমন করে আত্মরক্ষা করতে হবে তা শিখিয়ে দিতে হবে। কেউ যেন ভয় না পায় সেটাও দেখাতে হবে। শেষ কথা ॥ সরকার ও চিকিৎসক, সেবক/সেবিকাসহ জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মীদের এসব বিষয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। এ বিষয়ে ন্যাশনাল কমিটি অব এক্সপার্ট অবিলম্বে গঠন করা উচিত। আমাদের স্মরণে আছে, বহু বছর আগে প্রতিবেশী দেশে প্লেগের আবির্ভাব হয়েছিল। তখনকার জাতীয় কমিটিতে স্বাস্থ্য বিভাগ, পুলিশ, বিডিআরসহ জাতীয় কমিটির সাফল্যের ফলে একটি প্লেগ রোগীকেও বাংলাদেশে শনাক্ত করা যায়নি।
×