ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমার মেয়র

প্রকাশিত: ০৯:২২, ২৯ জানুয়ারি ২০২০

আমার মেয়র

আবারও নির্বাচনী জ্বরে কাঁপছে বাংলাদেশ। নির্বাচন ঢাকাতে। কিন্তু রাজধানী বলে কথা। ঢাকার নির্বাচনী উত্তাপ তাই ছড়াচ্ছে ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে সারাদেশে। এবারের নির্বাচনে যে সরগরম আমেজ তার আরেকটা কারণ বোধ করি দীর্ঘদিন পর বিএনপি আবারও রাজনীতিটা রাজনীতির মতো করে করার চেষ্টা করছে। এবার এখনও নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়নি দলটি। চেষ্টা করছে না ভাড়াটে নেতার ঘাড়ে ভর দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পেরোনোরও। সবচেয়ে বড় কথা, সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপার থেকে নির্বাচনে কলকাঠি নাড়াচাড়ার বিষয় এখন পর্যন্ত তেমন একটা শোনা যাচ্ছে না। কাজেই প্রায় এগারো বছর পর নির্বাচন করার সুযোগ পেয়ে দলের নেতাকর্মীরাও মাঠে নামছে ঠিকঠাক মতোই। আমি ছাপোষা ডাক্তার। রাষ্ট্রের ক্ষমতার শীর্ষে কে এলো-গেল তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা সামান্যই। আমি শুধু চাই- সরকারে থাকুক বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন, ক্ষমতার শীর্ষে থাকুক বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার আর দেশটা চলুক বঙ্গবন্ধুর দেখিয়ে যাওয়া অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা আর একাত্তরের চেতনার পথে। এতেই আমি সুখী। ব্যস, এতটুকু হলেই আমার চলে। কিন্তু মেয়র নির্বাচনের বিষয়টা একেবারেই অন্য রকম। সকালবেলা ক’টার সময় ঘর থেকে বের হলে ঠিক সময়ে কাজে পৌঁছতে পারব, ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কায় আমাকে নিদ্রাহীন রাতযাপন করতে হবে কিনা কিংবা বেপরোয়া ট্রাফিকের অত্যাচারে বেড়ে যাওয়া প্রেসারের কল্যাণে হাসপাতালে পৌঁছে রোগীর সঙ্গে আমি ভাল ব্যবহার করতে পারব কি পারব না অথবা দূষিত পরিবেশে শ্বাস নিতে গিয়ে আরেক দফা অসুস্থ হব কি হব না ইত্যাকার যাবতীয় বিষয়ের জন্যই আমরা এই শহরের মেয়রের ওপর নির্ভর করি। রাস্তায় জ্যাম থাকলে গালি দেই মেয়রকে। গাল খান মেয়র। ঢাকায় মশার উপদ্রব কিংবা ঢাকার বাতাসে ধোঁয়ার মাত্রাটা বেড়ে গেলেও। ঢাকায় যদি পান থেকে খসে চুন, তাতেই মেয়র মহোদয়কে শাপশাপান্ত করতে আমাদের এক সেকেন্ডও দেরি হয় না। কিন্তু একজন সাবেক পেশাজীবী আমলার সন্তান হিসেবে আমি জানি, ঢাকার মেয়রদের ক্ষমতার দৌড় কতখানি। আমার বাবা পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি জীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদফতরে। এই অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন শেষে কিছুদিন কাজ করেছেন অধুনালুপ্ত ঢাকার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ডের (বর্তমানে সম্ভবত ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে। পদাধিকার বলে এই বোর্ডের প্রধান ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকার মেয়র। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সেই মেয়রের ক্ষমতাও ছিল খুবই সামান্য। মেয়রের মূল ভূমিকা সমন্বয়কের। ঢাকার কোন্্ রাস্তায় কখন ফ্লাইওভার বানানো হবে, খোঁড়া হবে কোন্্ রাস্তাটা কিংবা কোথায় নতুন স্টর্ম সুয়্যারেজ কিংবা বৈদ্যুতিক ক্যাবল বসানোর কাজ শুরু হবে, এ নিয়ে মেয়রের বলার-করার সুযোগ খুব সামান্যই। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো আছে আরেক ঝামেলাও। ঢাকার মাটির তলার কোন প্রকৃত মানচিত্র আমাদের কোন সরকারী বিভাগের হাতেই নেই। মহাখালী ফ্লাইওভারটি হচ্ছে ঢাকার প্রথম ফ্লাইওভার। এটির নির্মাণের সঙ্গে আমার প্রকৌশলী পিতা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ সময়ের চেয়ে বেশি লাগার একটা বড় কারণ ছিল মাটির নিচে পানি-বিদ্যুত-গ্যাস ইত্যাদি লাইনের অবস্থা সম্বন্ধে সঠিক তথ্যের অভাব। লাইনগুলো যেভাবে আছে মনে করে ফ্লাইওভারটির নির্মাণ পরিকল্পনা ও বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছিল; তাতে বিস্তর পরিবর্তন আনতে হয়েছিল পরবর্তীতে ফ্লাইওভারটি বানাতে গিয়ে। কারণ কাগজের সঙ্গে মাটির তলার প্রকৃত অবস্থার কোন মিলই ছিল না। একই ঘটনা ঘটেছিল যাত্রাবাড়ীতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণের সময়ও। প্রথমে পাকিস্তান এবং পরে তাদের ভাবধারাপুষ্ট বিএনপি আর জাতীয় পার্টির সরকার সম্ভবত ধরেই নিয়েছিল যে, এ দেশটা সারা জীবনই তাদের চাওয়ার ‘তলাছাড়া ঝুড়ির’ বাংলাদেশ হয়েই রয়ে যাবে। এ দেশের রাজধানীতে কোনদিন মেট্রোরেল তো দূরে থাক ফ্লাইওভারও যে তৈরি হতে পারে এটি ছিল তাদের স্বপ্নেরও অতীত। সে কারণেই সম্ভবত ঢাকার মাটির তলার এসব স্ট্রাকচারের কোন ম্যাপ সংরক্ষণের কোন তাগিদই তাদের ছিল না। ঢাকার মেয়রদের কাজ করতে গিয়ে এসব কারণেও হোঁচট খেতে হয় দফায় দফায়। তাই বলে আমি এও চাই না যে, ঢাকায় আমরা টোকিও সিটি গবর্নমেন্টের আদলে মেয়রের নেতৃত্বে একটি আলাদা প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করি। আমি মনে করি না আমরা সবাই এখনও গণতন্ত্র চর্চা আর বোঝার সেই মার্গে পৌঁছতে পেরেছি, যেখানে দেশের জন্য একটি সরকার আর কার্যত ঢাকার জন্য আরেকটি সরকার সফল হবে। কাজেই আমার চাওয়া এমন একজন মেয়র যিনি তার দক্ষতা, ক্যারিশমা আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু কো-অর্ডিনেশনের মাধ্যমে আমাদের একটা বাসযোগ্য শহর দেবেন। আমি জানি, মেয়রদের কাছে কোন জাদুর বাক্স নেই। আগামী পাঁচটি বছরে দিনকে তারা রাত বানাতে পারবেন না। আমি শুধু চাই পিতা হিসেবে আমার সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনে আমার যে সততা আর নিষ্ঠা, সেটুকু আমি আমার নগরের পিতার কাছ থেকেও পাব। আমি উত্তর ঢাকা সিটি কর্পোরেশেনর বাসিন্দা। আমার মাথায় তাই উত্তরের নির্বাচন আর সামনে বেছে নেয়ার মতো প্রার্থী বাস্তবে দু’জন। আমি দলীয় রাজনীতির দোষে দুষ্ট হয়ে কোন মন্তব্য করতে চাই না। সে কারণেই আমার পছন্দের তালিকার বাইরে যে মেয়র প্রার্থী, তার ইতিহাস আর ভবিতব্য বিশ্লেষণেও আমি যাব না। আমি দেখছি আমার সামনে অন্তত এমন একজন মেয়র প্রার্থী আছেন, যিনি বিজিএমইএর সভাপতি হিসেবে রানা প্লাজার ধসের ধাক্কায় ধসে যাওয়ার হাত থেকে আমাদের গার্মেন্টস শিল্পকে রক্ষা করার রীতিমতো যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমি দেখেছি, কি অসাধারণ মমত্ব নিয়ে তিনি সেদিন অসহায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তার কোষ্ঠী ঘাঁটতে গিয়ে আমি জেনেছি, তিনি একেবারেই নিজের চেষ্টায় আজকের অবস্থায় এসেছেন। জন্মের সময় তার মুখে অন্য দু’-চারজনের মতো কোন সোনার চামচ ছিল না। আমি ঘেটেছি তার পরিবার পরিচিতিও। এদেশের উচ্চ আদালতের একের পর এক বিচারপতি যখন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারকাজ পরিচালনায় বিব্রত হয়েছেন, তখন তারই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি হিসেবে সেই বিচারকাজ সমাধা করে দেশ আর আমাদের কলঙ্কমুক্ত করেছেন। আবার তারই আরেক ভাই বিডিআর বিদ্রোহের পর ভেঙ্গেচুড়ে পড়া বাহিনীটির দায়িত্ব নিয়ে একে আজকের বিজিবি হিসেবে পুনর্গঠনের জটিল কাজটি অদ্ভুত দক্ষতায় সমাধা করেছিলেন। কাজেই আমি নিশ্চিত যে আমরা যেমনটি চাই তেমনই একটি নাম আমার নগরের পিতা নির্বাচনের ব্যালটে থাকছেই। আর ক্ষণগণনার ঘড়িতে চোখ পড়তেই আমি দেখি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর উৎসবের বাকি নেই আর দুটি মাসও। বঙ্গবন্ধুর এক শ’ বছর উদযাপন শেষেই আমরা মাতব প্রিয় বাংলাদেশের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে। আর তার পরের বছর আমরা উদযাপন করব নতুন বাংলাদেশের পথের দিশারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মের প্লাটিনাম জুবিলী। আমি খুব ভাল করেই জানি, এই তিন উৎসব উদযাপনের সুযোগ আমি আমার এই নশ্বর জীবনে একবারই পাব। কাজেই আমি কখনই চাই না, কোন কিছুর বিনিময়েই মেনে নিতে পারি না যে, আমার নগরে এই সময় এমন একজন নগরপিতা থাকবেন, যার নেতৃত্ব রঞ্জিত নিরপরাধের রক্তে, যার নেতৃত্বের হাতে পোড়া মানুষের গন্ধ, যার নেতৃত্ব দুর্নীতির দায়ে কারাগারে কিংবা দেশ ছাড়া, আর যার নেতৃত্বের সূর্য উদিত হয় পাকিস্তানে আর ডুবেও সেখানেই। আগামী এক তারিখে আমার সিদ্ধান্ত তাই খুবই স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। লেখক : সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×