ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ডজয়ী ‘বৃহন্নলা’

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ২৮ জানুয়ারি ২০২০

জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ডজয়ী ‘বৃহন্নলা’

আমাদের সমাজে তাদের দেখা হয় অনেক ঘৃণার চোখে। মানুষ অনেকটা আতঙ্কে যেন উল্টো দিকে দৌড় দেয় তাদের দেখলে। বলছি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কথা যারা আমাদের সমাজে হিজড়া নামেই বেশি পরিচিত। তারাও কিন্তু সৃষ্টির সেরা জীব। কিন্তু কতটুকু অধিকারই তারা পাচ্ছে। কখনও ভেবেছি কি? একজন মানুষ হিসেবে আমরা যতটা অধিকার ভোগ করছি তার কিছুই না হয়ত। তাদের জীবনকে কি একটু সুন্দর করে তোলা যায় না? এমনই ভাবনা দেখা দিয়েছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাথায়। তাঁদের জীবনকে একটু সুন্দর করে তুলতেই যাত্রা শুরু করে ‘ বৃহন্নলা’। যাত্রা শুরুর গল্পের জন্য ফিরে যেতে হবে ২০১৭ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এডুকেশন এন্টারপ্রেনার্স সোসাইটি ‘এডুপ্রেনারশিপ আইডিয়া কোয়েস্ট’ নামের প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল সে বছর। সাদিকুল ইসলাম ও তাঁর বন্ধু রুবাইয়া শারমিন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পোড়া কপালে ভাগ্য দূর করার একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। মূলত সাদিকের পরিকল্পনা হলেও তিনি অনেকের সঙ্গে এই পরিকল্পনাটি শেয়ার করেছিলেন। আর সেখান থেকেই চমকপ্রদ এই উদ্যোগটি ভাল লেগে যায় শারমিনের। সমাজের জন্য কিছু করতে চাওয়া এই তরুণীকেও আলোড়িত করে সাদিকের সঙ্গে। তারপর দুজন মিলে যাত্রা শুরু করেন বৃহন্নলা। মস্তিষ্কপ্রসূত একটা ধারণাকে সামাজিক উদ্যোগে রূপ দেয়ার সময় টিএসসি এলাকায় অবস্থান করা তৃতীয় লিঙ্গের অনেকের সঙ্গে সেটি শেয়ার করেন তাঁরা। ভাল সাড়াও পান। দিন-রাত তথ্য সংগ্রহ করে একটি সার্ভে রিপোর্ট এবং সার্ভে ভিডিও তৈরি করেন দুজন। ১৩১টি আইডিয়ার মধ্যে তাদেরটি চ্যাম্পিয়নশিপে সেরার খেতাব অর্জন করে। আর সেই প্রেরণায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য সমাজ গড়ার স্লোগানকে সামনে রেখে শুরু হয় ‘ বৃহন্নলা’র যাত্রা। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে এ সময় সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেন তারা। তাই সমাজে ফিরে এনেও সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সক্ষমতা তৈরি রীতিমতো এক চ্যালেঞ্জ। বৃহন্নলার অন্যতম লক্ষ্য তৃতীয় লিঙ্গের এসব মানুষের সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সক্ষমতা। স্বনির্ভর হওয়ার জন্য বৃহ্নলাদের পছন্দ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দেয়া এবং আইসিটি হাব স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্বজগতের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটানো এবং যুক্ত হওয়া তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একীভূত শিক্ষা, জেন্ডার সেনসিটাইজেশনসহ জেন্ডার রেসপনসিভ পাবলিক সার্ভিসের ওপর জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো তাদের আরো দুটি লক্ষ্য। তবে এসব ছাপিয়ে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটা সুগম পথ তৈরিকেই বড় অর্জন বলে মনে করছেন স্বপ্নদ্রষ্টারা। এক নজরে ‘ বৃহন্নলা’র উদ্যোগগুলো অন্তত ৪০০ জনকে কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ। ঈদ, পূজা, বাংলা নববর্ষের মতো ৬-৭টি উৎসবে ১০০ জনের অধিককে উপহার বিতরণ। কয়েকটি জেলায় কার্যক্রম, ভবিষ্যতে সকল জেলায় কার্যক্রম শুরু করার প্রত্যাশা। সামাজিক আন্দোলনে অন্তত ৫০০ জনকে সম্পৃক্ত করা। ২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সচেতনতা কার্যক্রম। ২৩ জন হিজড়া সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজারে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীদের দু’দিনব্যাপী সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন আয়োজন। ৩৩ জন হিজড়া সদস্যদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীদের ফুড শেয়ারিং ফেস্ট ‘ফেস্ট ফর ফ্রেন্ডশিপ’ আয়োজন। ইতোমধ্যেই বৃহন্নলা তাদের চারটি উইংয়ের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বৃহন্নলা সাংস্কৃতিক দল হিজড়া সদস্যদের সাংস্কৃতিক দক্ষতার উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং এর মাধ্যমে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিজড়া সদস্যরা তাদের সাংস্কৃতিক দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা তাদের অধিকার এবং সুন্দর জীবনের আবেদন সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছেন। বৃহন্নলার এক্সিসিবল এনভায়রনমেন্ট প্রমোশন টিম তৈরি করেছে দেশের ইতিহাসে প্রথম একটি দেয়াল পত্রিকা ‘উদ্বাস্তু আরণ্যক’ যেখানে হিজড়া সদস্যদের করুণ জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইয়ুথ নেটওয়ার্কিং টিম ইতোমধ্যেই যুক্ত করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের। এ বছর আরো ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বৃহন্নলা গবেষণা দল সহযোগিতা করছেন হিজড়া সদস্যদের জীবন ও সামাজিক অবস্থান নিয়ে উচ্চতর গবেষণা করতে যাওয়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়াও তাদের নিয়ে উচ্চতর গবেষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। বৃহন্নলার স্বপ্নদ্রষ্টা সাদিক জানান, ‘আমাদের পৃথিবী এখন দুটো সঙ্কট মোকাবেলা করছে, একটি হলো পরিবেশের সঙ্কট, অন্যটি মানবতার। আমরা মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শিখিনি। স্বীয় স্বার্থের কারণে আমরা একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছি, অন্যদিকে একটি গোষ্ঠী বা জাতিকে অন্ধকারে ফেলে দিতেও আমরা দ্বিধা করি না। ফলে আমরা যা প্রতিদান পাচ্ছি, তা আরও ভয়াবহ। তাই অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে আলোর পথে নিয়ে আসা তরুণ সমাজের দায়িত্ব বলে মনে করি। আর আমরা বিশ্বাস করি, তরুণ সমাজ চাইলে যে কোন চেইন, যে কোন অসম চর্চা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব। তাই হিজড়া জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় যুক্ত করার রথে আমরা তরুণ প্রজন্মকেই এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। পাশাপাশি বৃহন্নলার প্রতিটি কার্যক্রমে আমরা পরিবেশ রক্ষার তাগিদের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছি যাতে মানুষ সহজেই উল্লিখিত দুটো সঙ্কট ভালভাবে অনুধাবন করতে পারে।’ সমাজ পরিবর্তনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৮ সালে ‘ বৃহন্নলা’ ‘জয় বাংলা ইয়ুথ এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে।
×