ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তিতাস গ্যাসের ১০ লাখ সংযোগ

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২৮ জানুয়ারি ২০২০

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তিতাস গ্যাসের ১০ লাখ সংযোগ

রশিদ মামুন ॥ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি প্রায় ১০ লাখ সংযোগ দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে পাঁচ বছর ধরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সংযোগ দিলেও তিতাস প্রশাসন জেনে শুনে চুপ থেকেছে। সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সংযোগ কেলেঙ্কারির তদন্তও করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। তিতাস সূত্র বলছে, আবাসিকে নয় লাখ ৬৬ হাজার ৬৬, সিএনজিতে ৬৩ আর বাণিজ্যিকে এক হাজার ১৬২ গ্যাস সংযোগ বেড়েছে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির। ২০১৪ থেকেই আবাসিক, সিএনজি এবং বাণিজ্যিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয় জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু বিগত ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত তিতাস প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে গ্রাহক বৃদ্ধির কথা বলছে। এক দিকে সংযোগ বন্ধ আরেক দিকে সংযোগ সংখ্যা বৃদ্ধিতে দুর্নীতি হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে বিশেষ সুবিধা নিয়ে কাউকে কাউকে এসব সংযোগ দেয়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত বছর যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে প্রতিষ্ঠানটি ভয়াবহ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যারা সংযোগ দিয়েছে তাদের বিচার হতে হবে। তিনি বলেন, তিতাসের বিরুদ্ধে পাল্লায় মেপে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ছিল। কারা এই ঘুষ নিয়েছে তাদের নাম-ধাম পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। ফলে তাদের এ ধরনের শক্তির উৎস কি তাও খতিয়ে দেখতে হবে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সরকারী আদেশ অগ্রাহ্য করে এসব সংযোগ দিয়েছে। তিতাসের বিভিন্ন জোনের সঙ্গে প্রধান অফিসে যোগসাজশে সংযোগ বন্ধের আগের তারিখে গ্রাহকের আবেদন জমা নেয়া হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে এসব সংযোগ দিয়ে কম্পিউটারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্দিষ্ট কয়েক জনের কাছে কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড রয়েছে তাদের সহায়তায় এই সংযোগ কেলেঙ্কারি ঘটানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে তিতাসের কর্তা ব্যক্তিরা জেনে শুনেই বিশেষ কারণে চুপ থেকেছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে চাইলেও প্রভাবশালীরা তা থামিয়ে দিয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, তিতাসের কাউকে দিয়ে ভয়ঙ্কর এই দুর্নীতর ঘটনা তদন্ত করলে কিছুই বের হবে না। তিতাসের বাইরে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তদন্ত করা উচিত বলে তারা মনে করছেন এরা। এতে অবৈধ সংযোগের বিষয়টি বের হয়ে আসবে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি আবাসিকে যে সংযোগের সংখ্যা দেখাচ্ছে তাতে বলা হয়েছে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৫৩টি। এর পরের বছর এই সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজার ৬৬০টি বেড়ে ২০ লাখ ছয় হাজার ১৩টি হয়। এর পরের বছর এই সংখ্যা এক লাফে সাত লাখ ১১ হাজার ৫২৩ জন বেড়ে হয়েছে ২৭ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৬টি। ধারাবাহিকভাবে এর পরের বছর ৪৬ হাজার ৭১১টি সংযোগ বেড়ে হয়েছে ২৭ লাভ ৬৪ হাজার ২১৪টি। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিগত বছরের তুলনায় ৮২ হাজার ১৭২টি সংযোগ বেড়েছে বলে দেখানো হচ্ছে অর্থাৎ তিতাসের আবাসিক সংযোগ বেড়ে হয়েছে ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯টি। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে দুই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। কেউ কেউ বলছে, কোম্পানির গ্রাহক থাকলেও তাদের নাম কম্পিউটারে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। পরে ক্রমান্বয়ে অন্তর্ভুক্ত করাতে এই সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ২০১৪-১৫ সালে তিতাস কি তাদের আবাসিক গ্রাহক সংখ্যা কত জানত না? যদি জেনেই থাকে তাহলে কেন সেই সংখ্যাটি উল্লেখ করল না। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির একজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে এই প্রশ্নটি করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে তিতাস বোর্ডে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন এমন এক ব্যক্তি বলেছেন, গত বছর আবাসিক সংযোগ বন্ধ থাকার মধ্যেই তিতাস বোর্ডে আবাসিকে কিছু সংযোগ দেয়ার জন্য এজেন্ডা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখন বলা হয়েছিল এসব ব্যক্তি আগেই ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দিয়েছে। সঙ্গত কারণে সংযোগ না দিলে আইনগত জটিলতায় পড়বে তিতাস। তখন কোম্পানির পরিচালকরা আইনগত জটিলতা এড়াতে এসব সংযোগের অনুমোদন দেন। তখনও সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে তিতাস আবাসিকে এই সংযোগ দিয়েছিল। কিন্তু অনেক মানুষ এখনও ডিমান্ড নোটের টাকা জামা দিয়ে সংযোগ পাননি। তিতাস তাদের ডিমান্ড নোটের টাকা ফেরতও দেয়নি। তাহলে গত বছর কোন যোগ্যতায় তিতাস আবাসিক গ্রাহকদের সংযোগ দিয়েছিল বা তাদের বাছাই করা হয়েছিল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই অবস্থা তিতাসের সিএনজি সংযোগের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। সরকার আবাসিক, সিএনজি এবং বাণিজ্যিক সংযোগ বন্ধ রাখার জন্য তিতাসকে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে তিতাস ৬৩ সিএনজি সংযোগ দিয়েছে। আর বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রেও তিতাস গত পাঁচ বছরে নিজেদের গ্রাহক সংখ্যা এক হাজার ১৬২ সংযোগ বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ছোট গ্রাহক বলে তিতাস কম্পিউটারে এন্ট্রি ছিল না উল্লেখ করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সিএনজি এবং বাণিজ্যিক গ্রাহকরা বড় গ্রাহক তাদের এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেল কিভাবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, এই সংযোগ কিভাবে দেয়া হয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। সব সংযোগই অবৈধভাবে উৎকোচের বিনিময়ে দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো এমনভাবে আইনের ফাঁক বের করে দেয়া হয়েছে যে চাইলেও এদের ধরা যাবে না। ছোঁয়াও যাবে না। গত ২১ মে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করে তিতাসের আবাসিক, বাণিজ্যিক এবং সিএনজি সংযোগ বন্ধ করে দেয় জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু এর আগে অলিখিত নির্দেশে তিতাসকে ২০১৪ সাল থেকেই এই তিন শ্রেণীর সংযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। তখন তিতাসে আবাসিক কোন গ্রাহক আবেদন করতে গেলে আর নেয়া হতো না। কিন্তু এত বিপুলসংখ্যক গ্রাহক কিভাবে কোন প্রক্রিয়াতে সংযোগ পেয়ে গেল বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী মোঃ আল-মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, আমি নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আবাসিক সংযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে এখন কাজ করছি। জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১১ সালের ৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কিমিটিতে যাচাই-বাছাই করেই গ্যাসের সংযোগ দেয়া হতো। তখন কেবল শিল্প সংযোগ দিতো এই কমিটি। তখন অন্য সব সংযোগ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় সরকার। এরপর ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবার আবাসিক সংযোগ চালু করে। কিন্তু ওই নির্বাচনের পর আবার অলিখিতভাবে জ্বালানি বিভাগ থেকে বিতরণ কোম্পানিকে আবাসিকে নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করে দেয়া হয়। কিন্তু কোন কোন বিতরণ কোম্পানি সরকারের লিখিত আদেশ না থাকায় আবেদনপত্র গ্রহণ করে একই সঙ্গে ডিমান্ড নোটও ইস্যু করে। কিভাবে এই সংযোগ দেয়া হলো জানতে চাইলে খান মঈনুল ইসলাম মোস্তাক বলেন, গত বছর আইনগত জটিলতার কথা বলে কিছু সংযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর বাইরে ভিভিআইপি হলে তাদের সংযোগ দেয়া হয়। তবে এভাবে প্রতি বছর কিভাবে সংযোগ বাড়ছে সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না বলে জানান।
×