ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজানা বরদাতা ও ঢাকা সিটি নির্বাচন-২০২০

প্রকাশিত: ০৭:৫৭, ২৭ জানুয়ারি ২০২০

 অজানা বরদাতা ও ঢাকা সিটি নির্বাচন-২০২০

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ যেন কোন এক অনুশাসনের মধ্যে থাকতে চেয়েছে, অজানা বরদাতার কথা ভেবে। এটা মানুষের একটা মৌলিক ভাবনা হতে পারে। তবে এ ভাবনা পরিপুষ্টি লাভ করে কিছু শ্রদ্ধাযুক্ত কর্মে। এ কর্মটা কিন্তু মানুষের ধর্ম। বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে এ অনুশাসনের ধারার কিছু তারতম্য রয়েছে। যেমন অবস্থার প্রেক্ষাপটে একই জল ঠান্ডা বা উষ্ণ সেবনের ব্যবস্থা, তেমনি পোশাক-পরিচ্ছদে ও চাল-চলন, কথনেও পার্থক্য। মানব জীবনের গতি প্রবাহে বৈচিত্র্যময় বিষয়গুলো কোন ব্যক্তিবিশেষের ওপর প্রভাব যখন ফেলতে সক্ষম হয় এবং তা সর্বজনীন হয়ে ওঠে তখন অজানা বরদাতার কথা স্মরণ করে। নেতৃত্ব সেখান থেকেই তৈরি হয়। এ প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা নেতৃত্ব একটি সুন্দর ও সফলকাম জীবন চর্চার প্রতি যতœবান থাকেন। যত্নবান থাকেন বলেই নেতৃত্বে¡র ক্ষেত্রে অমরত্ব লাভ করেন। এমন মহান নেতা যুগে যুগে জন্মায় না। যেমনটি বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন। একজন নেতা শান্ত, শুদ্ধ আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী স্বভাবের না হলে সমাজে শান্তির প্রভাব উপলব্ধি হয় না। স্বার্থবুদ্ধিপুষ্ট ও অব্যবস্থচিত্ত নেতার হাতে অস্ত্র সাধারণ মানুষের জন্যে নিরাপদ নয়। কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ নেতা ওই একই অস্ত্র মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করবে, এটাই স্বভাবিক। আসলে একজন শুদ্ধ নেতার শুদ্ধ মস্তিষ্ক সৃষ্টিশীল ও মূল্যবোধমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ক্রিয়াশীল থাকে। বিশ্বের প্রত্যেকটি নেতারই একটা ধর্ম আছে যা অস্তিত্বকে রক্ষা করে। আমরা স্বাভাবিকভাবে কিছু জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট মানুষকে নেতা হিসেবে দেখি বা গণ্য করি কিন্তু কিছু মানুষের সমর্থনপুষ্ট মানুষ সাময়িকভাবে নেতা, অস্তিত্ব রক্ষার নেতা নন। মনুষ্যত্বে¡র বিবেচনা যাদের মধ্যে নেই তারা কখনও নেতা হতে পারে না, ভোটে জিতেও তিনি নেতা হতে পারবেন না। নেতাকে হতে হবে মোহমুক্ত, নির্মল মানুষ। তিনি শান্তি লাভের অধিকারী হবেন। সাধারণ মানুষ সাধারণ চিন্তায় এরূপ নেতাকে অজানা বরপ্রাপ্ত ভাবে। চিন্তা সাধারণ হলেও এর তাৎপর্য যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। এ গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে ভোটের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে হবে নেতৃবৃন্দকে। অজানা বরপ্রাপ্তির প্রত্যাশাকে শিরোধার্য করে সঠিক পথে হেঁটে হেঁটে ভোট প্রার্থনা করতে হবে। তবেই কোন অপশক্তি স্পর্শ করতে পারবে না। কাজেই ভয় পাবার কিছু নেই। ঢাকা সিটির নির্বাচন বাকি আছে মাত্র কয়েকদিন। প্রচার এখন উঠেছে জমে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে রায় প্রার্থনার প্রচার চলছে প্রার্থীদের পক্ষে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একই দিনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে আস্থা-অনাস্থার দোলাচালের মধ্যেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এটাকে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মাধ্যম হিসেবে বর্ণনা করছে। তারা জানে নির্বাচনে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আগাম ফলের কথা নিজেরাই প্রচার করছে। বিএনপির প্রচারে মনে হচ্ছে, ভোটের আগেই হেরে বসে আছে। এদিকে ইভিএম পদ্ধতির ভোট গ্রহণের বিষয়ে বিএনপির প্রতিবাদ একটি কৌশল। এই পদ্ধতিতে ভোটের ফল হেরফের হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এটা বিএনপিও ভাল করে জানে। কিন্তু তাদের ভয়টা অন্য জায়গায়। সেটি হচ্ছে নির্বাচনে তাদের ভোটার উপস্থিতি ঘটবে কিনা। বিএনপির বড় সমস্যা হচ্ছে সাহসী নেতৃত্বের সঙ্কট; নির্ভীক নেতৃত্ব ছাড়া নির্ভীক সমর্থক তৈরি হয় না। সুবিধাবাদী নানা ভাবনা ও মতের মানুষ দ্বারা গঠিত বিএনপির কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-আদর্শ নেই। তারপরও এ দলটি দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছে। দেশ শাসন করতে গিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মৌলিক চেতনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। তারা স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকেই অস্বীকার করেছে, এখনও করছে। মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য, সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে রাজনীতি করে আসছে। আধুনিক এ বিজ্ঞান সভ্যতার যুগে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি খুব একটা বড় জায়গা দখল করতে পারবে না। তারপরও বিএনপির ব্যাপক ভোটার রয়েছে। তবে এই ব্যাপকতায় একটা ঘাপলা আছে তাতে সন্দেহ নেই। বিএনপিকে যারা ভোট দেয় তাদের বেশিরভাগ সমর্থক হিসেবে নয়, আওয়ামী লীগকে পছন্দ না করার কারণে। এটাকে বলা হয় নেগেটিভ ভোট। অর্থাৎ নৌকায় দেবে না, তা হলে ধানের শীষেই দেয়া হোক। অবস্থাটা এ রকমই। কার্যত বিএনপির কট্টর সমর্থকের সংখ্যা টোটাল ভোটারের মধ্যে শতকরা ১৫% এর বেশি হবে না। এটাও নেহায়েত কম নয়। আবার বাকি ৮৫% যে আওয়ামী লীগ সমর্থক, তাও নয়। আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক ২৫%। জামায়াত সমর্থক ৭%, জাতীয় পার্টি ৮%, অন্যান্য সব পার্টি মিলিয়ে ৬% এর বেশি হবে না। ২০% ভোটার সব সময় ভোট দান থেকে বিরত থাকে। ১৯% ভোটার একেক সময় একক রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে এই ১৯% ভোটারের ওপর নির্ভর করে জয়-পরাজয়। এদিকে জামায়াত, স্বভাবত কারণেই নিজ প্রার্থী না থাকলে বিএনপি প্রার্থীকেই ভোট দেয়। জামায়াতের ভোট যোগ করলে বিএনপির ভাগে ২২% সমর্থক জোটে, সেই সঙ্গে ইসলামী ছোট ছোট দলের ভোট যোগ করলে বিএনপির আরো ২% যোগ হবে। তাতে পরিসংখ্যান দাঁড়ায় ২৪%। এগুলো পপুলার ভোট। অন্যদিকে বামপন্থী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে বিশ^াসীগণ আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করবে। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট পড়বে ২৭% এর মতো। সুতরাং ১৯% ভোটারের মন জয়ের বিষয়টি বড় ফ্যাক্টর। আসন্ন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে যে প্রার্থী সঠিক পথে প্রচার চালাতে সক্ষম হবে জয়ের সম্ভাবনা তারই বেশি। তবে এটি বিএনপি-আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মজার বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক নেতাগণ পার্থিব ভোগ-সুখে বড় ক্লান্ত ও শ্রান্ত। তাদের আরও সহায়সম্পদের প্রয়োজন। এসব নেতা কখনও বুঝতে চায় না সহায়সম্পদের আধিক্য তাকে সুখ দিতে ব্যর্থ হবে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের প্রভাবশালী দুই দলের প্রার্থী ব্যারিস্টার তাপস ছাড়া অন্যরা ব্যবসায়ী ঘরের সন্তান। এরা নগরপিতা হয়ে আপন ব্যবসাবান্ধব নগরপিতা হবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। ব্যতিক্রম ছিলেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তিনি ব্যবসাক্ষেত্রে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং নগরপিতা হয়ে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার একটা বড় গুণ ছিল নগরবাসীর মতামতকে প্রাধান্য দেয়া। নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিদের সঙ্গে নগর উন্নয়নে প্রায়শ মতবিনিময় করতেন। প্রয়াত মেয়র হানিফও ছিলেন রাজনৈতিকভাবেই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। আদর্শচ্যুত-সুবিধাবাদী পরিবারের সন্তান তাবিথ আওয়াল একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তার বাবা আওয়াল মিন্টু একসময় আওয়ামী লীগের লোক ছিলেন। আওয়ামী লীগে তার প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। শেখ হাসিনার খুবই বিশ^স্ত ও বঙ্গবন্ধু প্রেমিক ছিলেন। শেখ হাসিনার কাছ থেকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ও অনৈতিক সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হয়েই স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকারকারী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফ্যাসিবাদী দলে ভিড়েছেন। তার সুযোগ্য পুত্র তাবিথ আওয়াল বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী। সাধারণ ভোটার যদি সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় তবে সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি। যে সকল নেতা সম্ভোগ করতে ভালবাসে তাদের অলীক প্রতিশ্রুতি ভোটারদের বিশ^াস হবে না কোনদিনই। নেতৃত্ব সার্থক করতে, মধুময় করতে উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত হতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা সেটা কতটা করতে পেরেছেন সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ঢাকা সিটি নির্বাচনে গত টার্মে নির্বাচিত অনেক কাউন্সিলরের কীর্তিকাহিনী সারা বিশে^র মানুষ জেনে গেছে। ক্যাসিনোখ্যাত ওই সব কাউন্সিলর দেশের সম্মানে আঘাত করেছে। এবারের নির্বাচনে সত্যাশ্রয়ী, প্রাজ্ঞবান ব্যক্তিবর্গ নির্বাচিত হবেন সে প্রত্যাশা করছি। একজন জনপ্রতিনিধি কেবল এ কারণেই জনপ্রতিনিধি যিনি জনকষ্ট অনুসন্ধান ও তা নিরসনের ক্ষমতা রাখেন। আমাদের নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের উদ্দেশে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অভির পরে উদয় মানে হলো কল্যাণ; অভির মানে হলো সম্মিলিতভাবে, এককভাবে নয়। উদয় এই বিশেষ শব্দটির পূর্বে ব্যবহৃত ‘অভি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ। যার তাৎপর্য হলো সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটতে পারে না। সুস্থ-সবল সমাজ গড়তে হলে সমন্বিত কার্যপ্রণালী ও সংঘবদ্ধতা বা সমবায়ী মনোবৃত্তির প্রয়োজন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে লড়াই করলে কোন সমৃদ্ধি আসবে না। এ নগরে সামাজিক শান্তির বড় প্রয়োজন; এ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় সমন্বয়ের ভিত্তিতে। আজ প্রয়োজন সঙ্ঘবদ্ধ কার্যধারার এবং এসবেরই ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে অভি শব্দটির মাধ্যমে। এটি এমন একটি মূল্যবোধ, যাকে এই উপমহাদেশে সাম্প্রতিক কয়েক শতকে আমরা যথেষ্টরূপে আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি। আমাদের আজ সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে সঙ্ঘবদ্ধ মানসিকতা। আমাদের নগরের মানুষ এক সঙ্গে কাজ করতে জানলে খুব শীঘ্রই এ ঢাকা নগর স্বর্গে পরিণত হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জোর দিতে হবে সমষ্টিবদ্ধতার ওপর। জানতে হবে নগরবাসীর সঙ্গে কীরূপ ব্যবহার করা উচিত। সবাই মিলে কীভাবে নগরকে উন্নয়ন করা যায় সেটি ভাবতে হবে। পয়োপ্রণালীর উন্নয়ন, ভাল ভাল রাস্তাঘাট, উৎকৃষ্ট আবাসন, নির্মল পরিবেশ, সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও উপযুক্ত শিক্ষা, খেলাধুলার মাঠ এসব অর্জন করা সম্ভব যদি মিলেমিশে এক সঙ্গে কাজ করা যায়। সমন্বিত উদ্যোগে ঢাকা নগরকে সুস্থ, সবল ও প্রাণবন্ত নগরে পরিণত করা সম্ভব। সুতরাং সকলকে অভ্যুদয়ের দর্শন অনুসরণ করতে হবে। পাশ্চাত্য এ দর্শনের ভিত্তিতেই উন্নত হয়েছে। লক্ষ্য সামনে রেখেই নির্বাচনী জোয়ার তুলতে হবে। লেখক : কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক [email protected]
×