ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিববর্ষ, জনকণ্ঠ ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৮:৫৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২০

মুজিববর্ষ, জনকণ্ঠ ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

দুর্ভেদ্য সত্য হলো- মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় দীপ্যমান বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনার যোগ্যতম সঠিক নেতৃত্ব শুধু অনিবার্য নয়; অবশ্যম্ভাবী দৃষ্টান্তরূপে প্রতিভাত। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ভাষণদানকালে জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যা সংসদ নেতা দেশরত্ন শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের শাসনকালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উদ্যাপনের সৌভাগ্য অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে শতভাগ সহমত পোষণ করে বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করছি যে, শুধু সরকার বা জাতীয় সংসদ নয়, পুরো বাঙালী জাতি এই মহামানবের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনে গৌরবদীপ্ত পদাবলীতে সমান অংশীদার হতে চায়। এটিই হবে আগামী শতকের বাংলাদেশকে পরিপূর্ণভাবে উন্নয়ন বিশ্বের প্রতিমুখ প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ অধ্যায়। চমকপ্রদভাবে ধারাবাহিক যুক্ত হবে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। কী অপূর্ব, কী অসাধারণ প্রকৃতির সমীকরণ। স্পৃহনীয় অর্জনের সমসাময়িক পটভূমি বিশ্লেষণে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ‘প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি সংযোগ করতে চাই- ‘যায় মহাকাল মূর্ছা যায় প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়।/যায় অতীত কৃষ্ণকায় যায় অতীত রক্তপায় -/... যায় প্রবীণ চৈতীবায় আয় নবীন শক্তি আয়!/যায় অতীত, যায় পতীত, ‘আয় অতিথ, আয়রে আয় -/ ... গর্জে ঘোর ঝড় তুফান, আয় কঠোর বর্তমান! আয় তরুণ, আয় অরুণ, আয় দারুণ, দৈন্যতায়!/... প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়, প্রবর্তকের ঘুর-চাকায়!’ মূলত মুজিববর্ষের ক্ষণ গণনার পরিক্রমায় ১৭ মার্চ ২০২০কে আনুষ্ঠানিক বরণ করার নান্দীপাঠে অতীতের জাগরিত কিছু স্মৃতি উপস্থাপন করার দৃঢ় তাগিদ ও দায়িত্ব অনুভব করছি। স্বতঃসিদ্ধ ধারণা হচ্ছে- নতুন কিছু প্রবর্তনের ধারা এবং প্রবর্তকের স্বরূপ উন্মোচনের প্রেক্ষাপটে অতীতকে ধারণ করেই বর্তমান মুখরিত হয়। সকল দুঃসময়ে বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পূর্বাপর ভূমিকায় মহীয়সী রমণী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, স্বাধীনচেতা সত্যনিষ্ঠ গণমাধ্যম দৈনিক জনকণ্ঠ এবং প্রচণ্ড প্রণোদনা সৃজনমানস নির্ভীক কলমযোদ্ধা পরম শ্রদ্ধেয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে স্মরণ করা না হলে অবশ্যই ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সারথি হতে হবে । প্রবীণদের অভিজ্ঞতার মানদণ্ড নবীনদের পথ দেখাবে- এটিই ইতিহাস স্বীকৃত। আমরা হয়ত অনেকেই অবগত আছি যে, মহাজ্ঞানী ভলতেয়ার তাঁর অসাধারণ ক্ষুরধার লেখনির জন্য ফরাসী বিপ্লবের জন্মলগ্নে অভূতপূর্ব প্রেরণাদানকারী মহাবিরোচন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে অপরিমেয় পাঠক-ভক্তের কাছে ছিলেন অত্যন্ত উঁচুমার্গের এক বিমোহ প্রাণশক্তি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ৩০ মে ১৭৭৮ তাঁর প্রয়াণ দিনে প্যারিসের কোন গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি বা প্রার্থনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়নি। শোকাতুর একান্ত ভক্তরা শহরের এক নির্জন প্রান্তে অত্যন্ত অনাড়ম্বরে তাঁকে সমাধিস্থ করেছিলেন। অথচ মাত্র একযুগ পরেই ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শুরুতেই অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তায় তিনি পুনঃউদ্ভাসিত হন। লাখো অনুসারী পরম আবেগ ও শ্রদ্ধার উদ্দীপনে নির্জন শহরতলীতে সমাধিস্থ দেহাবশেষ বিশাল শোভাযাত্রাসহকারে প্যারিস শহরের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসেন। প্রায় ছয় লাখ সৈনিকের গার্ড অব অনার দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জ্ঞাপিত হলো। তাঁর শববাহী শকটের ওপর লেখা ছিল - ‘এই মহামানব দিয়ে গেছেন মহান প্রেরণা, আমাদের মহামুক্তির পথ তিনি উন্মোচন করেছেন।’ কারাগারে অবস্থানকালে ভলতেয়ার রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্য ‘হেনরিয়াত’। কারাগার থেকে মুক্তির পর আরেক বিখ্যাত বিয়োগান্ত নাটক ‘এডিপি’ প্রকাশিত হয়। সারা ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর সৃষ্ট দীপশিখার প্রজ্বলনে সমগ্র ইউরোপসহ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী সকল জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠে চৌকস-প্রোৎসাহে নবতর উদ্দীপ্ত। অনুরূপ ১৯৭৫- এর ১৫ আগস্ট এবং পরিবর্তীতে সমাজ-রাজনীতি-ইতিহাস বিকৃতির এক নির্মম কুৎসিত পটপরিবর্তন অবলোকন করেছে বাঙালী জাতিরাষ্ট্র। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করার নতুন শোকমঞ্জরি যেন রবিঠাকুরের ভাষায় উদ্ভাসিত হলো- ‘আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ-জীবন,/সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,/মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে।’ প্রয়াত বঙ্গবন্ধু নির্বাধ প্রাদুর্ভূত হলেন সমগ্র বাঙালী জনগোষ্ঠীর আকাশচুম্বী শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। মহাকর্ষ যে নেতার সম্মোহনী নেতৃত্বে স্বাধীন মাতৃভূমি অর্জনের লক্ষ্যে ত্রিশলাখ প্রাণ বিসর্জন ও কয়েক লাখ জননী-জায়া-কন্যা সম্ভ্রম হারিয়েছেন, স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই সভ্যতার বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন এবং প্রায় সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেছেন। সেদিন তাঁর জন্মগৃহের অনতিদূরেই যারপরনাই অবহেলিত অবস্থায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস আবার জাগ্রত হয়েছে নতুন করে দেড়যুগের স্বল্প কিছু বেশি সময় অতিক্রান্ত করে। কারবালা ও পলাশীর মতো বিয়োগান্তক ঘটনার মতো বিভ্রান্তকারীরা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হলো। আর অনধিক প্রাণিত হলো মহাকালের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ভলতেয়ারের মতো কারাগারে বসে রচনা করলেন কিংবদন্তির মহাকাব্য ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। রবিঠাকুরের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার উচ্চারণে প্রার্থিত হলো বাঙালীর আয়তলোচন – ‘কে জানে কোথা হ’তে একটি অতি সুক্ষস্বর/সবার কানে কানে বললে, চলো সার্থকতার তীর্থে।/এই বাণী জনতার কণ্ঠে-কণ্ঠে মিলিত হয়ে/একটি মহৎ প্রেরণায় বেগবান হয়ে উঠল।/পুরুষেরা উপরের দিকে চোখ তুললে,/জোড় হাত মাথায় ঠেকালে মেয়েরা।/শিশুরা করতালি দিয়ে হেসে উঠল।/প্রভাতের প্রথম আলো ভক্তের মাথায় সোনার রঙের চন্দন পরালে/সবাই বলে উঠল, ‘ভাই, আমরা তোমার বন্দনা করি।’ এই আরতি উৎসর্গক্ষেত্র নির্ধারণে উপরোল্লেখিত মনীষী এবং প্রতিষ্ঠানের অপরিমেয় অবদান অনস্বীকার্য। শহীদ জননীর নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলন, গাফ্ফার চৌধুরীর সর্বজনীন লেখনি এবং জনকণ্ঠ পত্রিকায় এসবের অতুলনীয় প্রচার-প্রসার এই যুগ সন্ধিক্ষণের অনবদ্য কারিগর হিসেবেই বিবেচিত এবং সমাদৃত। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচন ও প্রকৌশলীত ফলাফল প্রেক্ষিতের বীভৎস কিছু স্মৃতি এখনও তাড়িত করে। ভর করে অজানা আশঙ্কা-আতঙ্ক। নির্বাচনের আগে ও পরে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবউদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিপীড়ন-নির্যাতন ও ব্যভিচারের যে দৃশ্য দেখেছি, তা কখনও মুছে দেয়ার নয়। সে সময় গণমাধ্যম বিশেষ করে জনকণ্ঠে প্রকাশিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লেখাগুলোই ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা, যুদ্ধাবস্থানে অয়োময় এবং ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয়ের একমাত্র প্রধান উৎস। শাহরিয়ার কবিরের কারাগার থেকে মুক্তির পরে ঢাকা ও কুমিল্লায় তাঁকে সংবর্ধিত করতে ব্যর্থ হলে আমাকে আহ্বায়ক এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত মোঃ ইদ্রিসকে সদস্য সচিব করে চট্টগ্রামে কবির ভাইকে সংবর্ধনার আয়োজনে প্রেসক্লাবের সম্মুখে হত্যার চেষ্টায় আমাকে বোমা মারা হলে এক নিরীহ রিক্সাচালককে প্রাণ দিতে হয়। সংখ্যালঘু নির্যাতন থেকে শুরু করে এমন কোন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ছিল না, যা সে সময় সংঘটিত হয়নি। নেপথ্যে চট্টলবীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রয়াত বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী ও আমাকে আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্ব নিয়ে মানবতাবিরোধী কর্মশালা আয়োজনসহ ৩০ এপ্রিল জলিল সাহেবের ডেটলাইন ঘোষণার প্রেক্ষিতে জরিপকার্য পরিচালনায় বহুবিধ নিবর্তনের শিকার হতে হয়েছে। সুখের বিষয় হলো, এসবের প্রচার-প্রসারে জনকণ্ঠ কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট কলম সৈনিকদের অবদান চিরস্মরণীয়। এই স্বল্প পরিসরে এ ধরনের বিপুলসংখ্যক ঘটনার বর্ণানার অবকাশ নেই। ‘দলিত ও জাতি-বর্ণ বৈষম্য’ শিরোনামে (২য় সংস্করণ) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত আমার গবেষণা গ্রন্থের কিছু উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়Ñ শুধু ১৫.০৯.২০০১-১০.১২.২০০১ মাত্র প্রায় তিন মাসে সাম্প্রদায়িক বর্বরতায় নরহত্যার সংখ্যা ছিল ২৭, নারীধর্ষণ ২৬৯, শিশুধর্ষণ ১, দৈহিক নির্যাতন (পুরুষ) ২৬১৯, দৈহিক নির্যাতন (মহিলা) ১৪৩০, নারী ও পুরুষ অপহরণ ১০০, পরিবার উৎখাত ৩৮৫০০, চার্চ-মন্দির-মূর্তি ভাংচুর ১৫৫, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ৪৫৫১। ১৯৬৯ গণআন্দোলনে প্রত্যক্ষ ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ’৭০ সালে এসএসসি পাস, চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি, প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞ, নির্বাচন, বারংবার সীমান্ত পাড়ি দিতে ব্যর্থ চেষ্টা সত্ত্বেও সরাসরি অংশগ্রহণ করতে না পারার বেদনাবোধে এখনও দংশিত। সান্ত¡না এটুকু যে, স্বদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা দানু ভাইয়ের নেতৃত্বে ট্রেনিং গ্রহণ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার সুযোগ গ্রহণ করতে পেরেছি। ছাত্রলীগের বিভক্তির পর মুজিববাদী আদর্শে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ক্ষেত্র নির্মাতাদের আক্রমণে শারীরিক ও মানসিক রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের ছাত্রজীবন। ১৯৭৫, ১৫ আগস্ট জঘন্যতম পটপরিবর্তনের পর প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আমার মতো অনেকেই প্রায় প্রৌঢ়ত্বের কাঠিন্যে এখনও সত্য-সততা ও আদর্শিক চেতনার কাছে অপরাজিত থেকেছি। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, জনকণ্ঠ ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মতো অনেকেরই সঠিক মূল্যায়ন জাতি করতে পেরেছে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকীর এই পরিক্রমায়ও জনকণ্ঠের প্রতিদিনকার অবদান চিরস্মরণীয় হওয়ার দাবি জানাচ্ছি। লেখক : বঙ্গবন্ধু চেয়ার, শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×