ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিন শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই, দেড় হাজার গৃহহীন

রূপনগরের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড

প্রকাশিত: ১০:৩১, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

  রূপনগরের চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার রূপনগরের চলন্তিকা বস্তি ফের ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অন্তত তিন শতাধিক টং ঘর ভস্মীভূত। গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় দেড় হাজার মানুষ। তারা এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। অগ্নিকান্ডের সময় হুড়োহুড়িতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। দু’জন কিছুটা দগ্ধ হয়েছেন। স্থানীয়দের সহায়তা ও ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতার কারণে কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত বলে বস্তিবাসীদের দাবি। বস্তির বাসিন্দাদের অনেকেই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। অগ্নিকান্ডের সময় তাপে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে বস্তির অনেক বাসিন্দাই জানিয়েছেন। ফলে ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলক অনেক বেশি হয়েছে। ঢাকা উত্তরের সিটি কর্র্পোরেশনের আওয়ামী লীগের পক্ষের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি বস্তিবাসীদের সান্ত¦না দেন। পাশাপাশি তাদের খাবারের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় প্রভাবশালীরা, কাউন্সিলর প্রার্থীরা সম্মিলিতভাবে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা গৃহহীনদের মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দফতরের তরফ থেকে। কমিটিকে দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। শুক্রবার ভোর চারটার দিকে ঢাকার রূপনগরের ৬ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের তিন রাস্তার মোড়ের বাম দিকের ঢালেই অবস্থিত চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ডিউটি অফিসার আব্দুস সামাদ আজাদ জনকণ্ঠকে জানান, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। ভোর পৌনে ছয়টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। এরপর আগুন সকাল ৯টা নাগাদ সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা হয়। আগুনে দুই শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি। অগ্নিকা-ের কারণ জানতে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের তরফ থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক দেবাশীর্ষ বর্ধনকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন, সহকারী পরিচালক (অপারেশন্স) আব্দুল হালিম, সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ফায়ার সার্ভিসের মিরপুর জোনের কমান্ডার আনোয়ার হোসেন ও মিরপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে। কমিটিকে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের মহাপরিচালক বরাবর দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রায় দশ বিঘা জমির ওপর বস্তিটি গড়ে উঠেছে। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ জায়গাটিতে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পুুুড়ে যাওয়া বস্তির পাশেই গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাইনবোর্ড লাগানো রয়েছে। তার উত্তর পাশ ঘেষেই বিশাল বস্তিটি গড়ে উঠেছে। বস্তির বাসিন্দারা বলছিলেন, আগে এখানে পানি ছিল। তখন পানির ওপরেই বস্তি ছিল। পরে আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে যায়। দেখা গেছে, এখন খুব একটা পানি নেই। কাঁদামাখা মাটিতেই বাঁশ টিন দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল বস্তিঘরগুলো। আর রাস্তার পাশেই ঢাল ঘেঁষে বস্তিটির ঘরগুলো তোলা হয়েছে পাঁকা করে। প্রতিটি ঘর দোতলা। পুড়ে যাওয়া বস্তিটিতে অন্তত ১৬টি দোতলা পাঁকা বস্তির ঘর ছিল। বস্তিতে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস ছিল। পুরো বস্তি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শুধু মাঝে মধ্যে দু’একটি দোতলা বাড়ির শুধু দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। আগুন লাগার বিষয়ে বস্তির বাসিন্দা রহিমা বেগম (৪৫) বলছিলেন, আমি চল্লিশ বছর ধরে বস্তিটিতে বাস করছি। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন পিতামাতার সঙ্গে এই বস্তিতে আসি। এখানেই আমার বিয়ে হয়েছে। তিন মেয়ে আছে আমার। দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। এক মেয়ে আমাদের সঙ্গে থাকে। আমাদের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার ঢামুড্যা থানা এলাকায়। বাড়িতে বসতভিটা নেই। তাই কোনদিনই বাড়িতে যাই না। গিয়ে কি লাভ! একটু থাকার জায়গাও নেই। তিনি বলছিলেন, প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়েছি। ভোর ৪টার দিকে আচমকা আগুন আগুন বলে চিৎকার শুনতে পাই। আমার ঘরটি বস্তির প্রায় মাঝমাঝি জায়গায়। ঢালের রাস্তা থেকে কিছুটা ভেতরে। তখন বস্তির প্রায় সবাই গভীর ঘুমে ছিল। আচমকা আগুন আগুন চিৎকারে বস্তিবাসীরা জেগে ওঠেন। দেখি, বস্তিটির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় আগুন জ্বলছে। আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে কারও পক্ষে আগুন নেভানো সম্ভব ছিল না। এজন্য যে যার যার মতো জীবন নিয়ে রক্ষা পেতেই ব্যস্ত ছিল। আমিও রিক্সাচালক স্বামী তবিউল্লাহ আর ছোট মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেই। এরপর ঘরের আশা ছেড়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে হাতের কাছে যা কিছু ছিল তাই নিয়েই তাড়াতাড়ি রাস্তায় উঠে যাই। মিনিট ১৫ পরে বিকট শব্দে কি যেন ফাঁটল। এরপর আবার আগুন বেপারোয়াভাবে পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। বস্তিতে অনেকই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করেন। সেসব গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে হয়ত আগুন ছড়িয়ে পড়তে পারে। চোখের পলকে সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকে। শত শত মানুষ চিৎকার করতে করতে সামনের উচু রাস্তায় আশ্রয় নেন। সেখান থেকে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছিল। আগুনের তীব্রতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, আশপাশের বাড়ির বাসিন্দারা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে নিচে নেমে যান। রহিমা বেগম বলছিলেন, এই বস্তিতে ঠিক কতবার আগুন লেগেছে, তা হিসেবে করতে বলতে পারব না। তবে কম করে হলেও ছোট বড় দশটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বস্তিটিতে। তার মেয়ে আকলিমার সঙ্গে কথা হয়। চৌদ্দ বছর বয়সী এই কিশোরী জানায়, আগুন এতটাই দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, অনেকে শীতের কাপড় পর্যন্ত বের করতে পারেনি। আমার গায়ে যা ছিল তাই নিয়ে বের হয়েছি। আর মাথার কাছে একটি পুরনো সোয়েটার ছিল তাই নিয়ে বেরিয়ে যাই। কথা বলার সময় বিকেলের হিমেল হাওয়ায় কিশোরী শীতে কাঁপছিল। রূপনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, চলন্তিকা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পারভীন (৪০) নামের বস্তির এক নারী বাসিন্দা দগ্ধ হয়েছেন। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। বস্তিতে বাড়ি হিসেব করলে দুই শতাধিক বাড়ি পুড়ে গেছে। আর ঘর হিসেব করলে তিন শতাধিক ঘর পুড়েছে। কারণ অনেক বাড়িতে একাধিক ঘর ছিল। ওসব বাড়ি দোতলা ছিল।
×