ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালে রিপন পাঁচ শতাধিক, সিরাজগঞ্জে আনিসুর দুই শতাধিক

বাল্যবিয়ে বন্ধে রেকর্ড

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

  বাল্যবিয়ে বন্ধে রেকর্ড

যে জাতি গুণীজনদের সমাদরে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়, সে জাতি আলোর পথ খুঁজে পায় না। সমকালীন মনীষীদের সঠিক মূল্যায়নে আমরা সচেতন নেই বলে অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্য ব্যক্তিরাও সম্মান কুড়ায় এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা বা সমাজের সফল ব্যক্তিরা থেকে যান পর্দার আড়ালে। বর্তমান সমাজে অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যাদের মেধা, শ্রম ও ত্যাগ দেশ, সমাজ ও জাতি বিভিন্নভাবে উপকৃত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন বরিশালের শৌলজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি, ইউনিয়ন পরিষদ ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভপতি মোঃ মাহমুদ হোসেন রিপন। ২০১১ সাল থেকে অদ্যাবধি তিনি পাঁচ শতাধিক বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে রেকর্ড গড়েছেন। তার হস্তক্ষেপে এসব বাল্য বিয়ে বন্ধ হয়েছে। বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পাওয়া কিশোরীরা এখন সুশিক্ষিত হয়ে দেশ ও সুন্দর জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। মাহমুদ হোসেন রিপন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার আগে ওই ইউনিয়নে বাল্যবিয়ে একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছিল। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী জেএসসি/জেডিসি কিংবা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। বাল্যবিয়ের কারলে বিয়ে বিচ্ছেদসহ নারী নির্যাতন ও যৌতুক সংক্রান্ত মামলাও ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। মাহমুদ হোসেন রিপন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর বাল্যবিয়ে নিরোধ, মাদক নির্মূল ও যৌন হয়রানিসহ বন্ধসহ অপরাধ দমনে কঠোর হস্তক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার মান-উন্নয়নে এলাকায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য বিবাহ রেজিস্ট্রার (কাজীদের) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অপ্রাপ্ত ছেলেমেয়েদের বিয়ের রেজিস্ট্রি করলে তার শাস্তি সম্পর্কে ধারণা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে ধারণা, ইউপি সদস্য ও মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে ও মাদকের কুফল এবং আইন সম্পর্কে সচেতন করা, গণমাধ্যম কর্মীদের সভার মাধ্যমে বাল্যবিয়ের সকল বিষয়ে অবহিত করে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছেন। ফলে গত দশ বছরে শৌলজালিয়া ইউনিয়নে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে সমাজের ভয়াবহ ব্যাধি বাল্যবিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আইডির মাধ্যমে গণশুনানির ব্যবস্থা চালু করে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন মাহমুদ হোসেন রিপন। এখানে জনগণ তাদের অভিব্যক্তি, মতামত, অভিযোগ এবং পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতন এলাকাবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনার শিশুকে স্কুলে পাঠিয়ে শিক্ষিত করুন, বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। সকল উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে সরকারকে সহযোগিতা করুন, সরকারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে সহযোগিতা করুন, মাদকমুক্ত থাকুন ও মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন, সরকারী ভূমি অবৈধ দখল থেকে বিরত থাকুন, সরকারী রাস্তার পাশে কোন অবৈধ অবকাঠামো নির্মাণ করবেন না, খাজনা পরিশোধ করে ইউনিয়নসহ দেশের উন্নয়নে সহায়তা করুন, শৌলজালিয়া ইউনিয়ন ভ্রমণে আমাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করুন, ইউনিয়নের উন্নয়ন ও সার্বিক কর্মকা-ে দলমত নির্বিশেষে আমাদের সহায়তা করুন। এ ব্যাপারে মাহমুদ হোসেন রিপন বলেন, বিয়ে বন্ধ, বহুবিবাহ, নারী নির্যাতন ও যৌতুক সংক্রান্ত মামলার মূলেই রয়েছে বাল্যবিয়ে। তাই যেমন করেই হোক সকলের সহযোগিতায় বাল্যবিয়ে ও মাদক বন্ধ করাসহ অন্যান্য অপরাধ দমন এবং এলাকার উন্নয়ন করে শৌলজালিয়াকে অপরাধমুক্ত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি মডেল ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত করাই হচ্ছে আমার মূল লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক ও রাজনীতিবিদদের সৎ ও সহনশীল হতে হবে। আমার জন্ম মানুষের কল্যাণের জন্য। যতদিন বেঁচে থাকব মানুষের সেবায় কাজ করে যাব এবং বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন এমডিজি, এসডিজি অর্জনে নিরলস চেষ্টা করে শৌলজালিয়া ইউনিয়নকে বাংলাদেশের অনুকরণীয় ইউনিয়ন হিসেবে গড়ে তুলব। মাহমুদ হোসেন রিপন ২০১১ সালে শৌলজালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি ছয়বার জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হিসেবে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীনে তিনি ১০টি রাষ্ট্র সফর করছেন। আটটি স্বর্ণপদকসহ বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ ফোরাম থেকে এলজিএসপিতে শ্রেষ্ঠ হওয়ায় তিনি দুইবার স্বর্ণপদক, আইনশৃঙ্খলা, কমিউনিটি পুলিশিং, মাদক, সন্ত্রাস বাল্যবিবাহ বন্ধ এবং ইভটিজিং প্রতিরোধে বিশেষ অবদান রাখায় তিনি পুলিশ মহা-পরিদর্শক একেএম শহিদুল ইসলামের বিশেষ সম্মাননা পদক ২০১৬ পেয়েছেন। -খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে বাল্যবিয়ে বন্ধ এবং বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে মাঠে কাজ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন একজন সরকারী কর্মকর্তা। সরকারের অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একজন সহকারী কমিশনারের এমন অবদান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সিরাজগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আনিসুর রহমান এ জেলায় দায়িত্ব পালনকালে গত ২২ মাসে ২০৩টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। বাল্যবিয়ে বন্ধে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের একটি প্যারামিটার। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ সদরের প্রায় সকল উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, মাদক ও জুয়ার ক্ষতিকর বিষয়গুলো অবহিত করে এ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়া বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা পাওয়া অসহায় গরিব ৩ ছাত্রীর পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন এই সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমান। এজন্য ২০১৯ সালের ২৩ জুন আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস দিবসে সদরের এই সহকারী কমিশনার (ভূমি) কে বাল্যবিয়ে বন্ধে অবদান রাখায় বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেরার সহকারী কমিশনার (ভূমি) দায়িত্ব পালনকালে এক বছর আড়াই মাসে ১৬৯টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেন। একদিনে ৭টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করারও অনবদ্য রেকর্ড রয়েছে। চৌহালী উপজেলায় কর্মকালীন ৩৩ সপ্তাহে ৩৪টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছেন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ পৌরসভায় ৩২টি, ইউনিয়ন পর্যায়ে খোকশাবাড়ীতে ১১টি, সয়দাবাদে ১৬টি, কালিয়া হরিপুরে ১৯টি, বাগবাটিতে ২৬টি, রতনকান্দিতে ২৯টি, বহুলীতে ১৩টি, শিয়ালকোলে ১০টি, ছোনগাছায় ১০টি, কাওয়াখোলায় ৩টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এদের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ৪ জন, ৪র্থ শ্রেণীর ২ জন, পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী ৬ জন, ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ১০ জন, সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ২১ জন, অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ৫৮ জন, নবম শ্রেণীর ছাত্রী ৩৭ জন, দশম শ্রেণীর ছাত্রী ২৭ জন, একাদশ শ্রেণীর ৪ জন। ২০১৭ সালের শেষ দিকে বদলি হয়ে যমুনা নদীবিধৌত সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায়। এরপর বদলি হয়ে আসেন সদর উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে। তার এ অর্জন ইতিবাচকভাবে দেখছে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন। দুটি ইলিশ প্রজনন মৌসুমে তিনি নিয়ম ভঙ্গকারী ১২৪ জন জেলেকে কারাদ- প্রদান করেন। এছাড়া এ বছর মা ইলিশ রক্ষা অভিযানে সিরাজগঞ্জ সদরে ১১৬ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রদান করে ইলিশ রক্ষায় অবদান রাখেন। যা এখনো চৌহালীবাসীর মুখে মুখে। বাল্যবিয়ে বন্ধে বছরওয়ারি হিসেব অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ সদরে ২০১৯ সালে জানুয়ারি মাসে ২টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ২টি, মার্চ মাসে ১০টি, এপ্রিল মাসে ২২টি, মে মাসে ৮টি, জুন মাসে ১৫টি, জুলাই মাসে ১৭টি, আগস্ট মাসে ২৭টি, সেপ্টেম্বর মাসে ২৩টি, অক্টোবর মাসে ১৭টি, নবেম্বর মাসে ১৬টি, ডিসেম্বর মাসে ৫টি এবং জানুয়ারি ৩৯; ২০২০ মাসে ৫টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। এসময়ে বাল্যবিয়ে বন্ধে সদর উপজেলায় বার লাখ ৪৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং ৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রদান করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বর ও কনের বাবার মুচলেকা নেয়া হয়। তিনি চৌহালী উপজেলায় ৩৪টি ও সদর উপজেলায় ১৬৯টিসহ মোট ২০৩টি বাল্যবিয়ে নিজে উপস্থিত হয়ে বন্ধ করেছেন। তিনি বাল্যবিয়ে বন্ধে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মা-বাবাকে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে সচেতন করেছেন। সিরাজগঞ্জ সদরের প্রায় সকল উচ্চ বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের বাল্যবিবাহ, যৌন হয়রানি, মাদক ও জুয়া সম্পর্কে সচেতন করেন এবং সামাজিক এ ব্যাধিগুলো দূর করার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহযোগিতা চান। -বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে
×