ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আগে শুধু দিনের বেলায় হালচাষ করা যেত, এখন যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় রাতেও হালচাষ করা যায়, বদলে গেছে কৃষকের জীবনযাত্রার মান, এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সারাদেশে

বিদায় লাঙ্গল-এলো ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

বিদায় লাঙ্গল-এলো ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার

এক জোড়া গরু অথবা মহিষের কাঁধে জোয়াল তুলে দিতে তাতে লাঙ্গল লাগিয়ে শত বছর ধরে হালচাষ করে আসছিল উত্তরাঞ্চলের জেলার লালমনিরহাটে কৃষক। শুধু উত্তরাঞ্চল বলে ভুল হবে হালচাষে গরু মহিষই ছিল একমাত্র ভরসা। তাই সচ্ছল কৃষক পরিবারগুলোর প্রত্যেক বাড়িতে ছিল গরু মহিষের একাধিক হাল। শুধু হালচাষ নয়, গরু মহিষ ব্যবহার হতো গাড়ি চালাতে। এখনো মাঝে মাঝে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ি, গরুর গাড়ি ও মহিষের গাড়ি কৃষিপণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার হতে দেখা যায়। তবে হালচাষে গরু ও মহিষের ব্যবহার নেই বলেলেই চলে। গরু মহিষের হালচাষের জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার। সারাদেশে কৃষিতে যান্ত্রিক ব্যবহার বেড়েছে। লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। ফসল চাষেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এখন সারা বছরে জমিতে কোন না কোন ফসল ফলাচ্ছে কৃষক। একই জমিতে ১২ মাসে ৩/৪টি ফসলও ফলছে। এখন ফসলের জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে দিনরাত জমি চাষ করা যায়। গরুর বা মহিষের হালে সেটা সম্ভব ছিল না। গরু বা মহিষের হালে একজন কৃষি শ্রমিক এক দুপুর জমি চাষ করতে পারত। রাতে লাঙ্গলের চাষ ছিল অসম্ভব ব্যাপার। গত ১০/১২ বছর আগেও গরু অথবা মহিষের হালচাষের দৃশ্য প্রতিটি গ্রামে দেখা যেত। গরু দিয়ে হালচাষ এক সময় ছিল গ্রামবাংলার চিরায়িত চিত্র। ভোর হলেই গ্রামাঞ্চলের কৃষক অথবা কৃষিশ্রমিকরা কাঁধে লাঙ্গল- জোয়াল নিয়ে গরু মহিষ হাঁকিয়ে জমিতে হাল চাষের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। এক দুপুরে দুই বিঘা জমি একচাষ করা ছিল খুবই কষ্টের ব্যাপার। ঘুরে ঘুরে চাষ করতে হতো। বর্তমানে অত্যাধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে হালচাষ ও কৃষিতে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। হালচাষ, বীজরোপণ, ধানের চারারোপণ, বীজ ছিটানো, ধানকাটা, ধান মাড়াই, শস্য পরিবহন, ধান সিদ্ধ শুকনো ও ধানভাঙ্গাতে ব্যবহার হচ্ছে আধুনিক যন্ত্রপাতি। এমন কি জমির আগাছা মুক্ত করতেও ব্যবহার হচ্ছে যন্ত্রপাতি। কৃষি বিজ্ঞানীরা কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। ফলে কৃষকদের জীবনেও এসেছে নানা পরিবর্তন। চাষবাদে সময় কমে এসেছে, যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে উৎপাদন খরচ কমে এসেছে। সাশ্রয় হয়েছে কৃষকের শ্রম ঘণ্টা। আগে শুধু দিনের বেলায় হালচাষ করা যেত। এখন যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় রাতেও হালচাষ করা যায়। বদলে গেছে কৃষকের জীবনযাত্রার মান। এই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সারাদেশের ন্যায় লালমনিরহাট জেলার গ্রামগঞ্জে। এখন আর কৃষকদের কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল ও হাতে জোড়া গরুর দড়ি দেখা যায় না। বিলুপ্ত হয়ে গেছে গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষের পদ্ধতি। এক সময় গ্রামগঞ্জে গাঁথা পদ্ধতিতে (কয়েকজন মিলে) গরু ও মহিষ দিয়ে হালচাষ করা হতো। এখন এ প্রচলন উঠে গেছে। গরু, মহিষের হালচাষ বিলুপ্ত হলেও গ্রামে গরু মহিষ প্রতিপালন কিন্তু কমেনি। বরং বেড়েছে। লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে খামার করে মধ্যবিত্ত কৃষকেরা গবাদিপশু পালন করছে। মাংস ও দুধের জন্য এই খামার স্থাপন হয়েছে। অনেকে আবার গরুর খামারকে লাভজনক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কৃষিতে এখন বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। ফসল চাষেও এসেছে বৈচিত্র্য। কৃষকেরা এখন প্রচলিত কৃষি পণ্যের পাশাপাশি সবজি, ফলমূলসহ নানা শস্য উৎপাদন করছে। এখন গবাদিপশু পালনকে অনেকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। এতে আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কৃষিতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। যন্ত্রপাতির পাশাপাশি কৃষিতে লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। কৃষির এই পরির্বতনে কৃষি বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি কৃষক নিজেই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে নতুন কৃষি প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি বানিয়েছে। এমন কি উচ্চ ফলনশীল জাতও কৃষক আবিষ্কার করেছে। কৃষিতে মান্ধাতা আমলের ধ্যানধারণা পাল্টে গেছে। লালমনিরহাট কৃষি অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিধু ভূষণ রায় জানান, বর্তমানে কৃষিতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। কৃষি কাজেও প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। যে কৃষি জমিতে বছরে দুই খন্দের আবাদ করা হতো সেই জমিতে এখন তিন/চার খন্দেরও আবাদ করা হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ এখন লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষের পরিবর্তে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করছে। প্রাণী দিয়ে হালচাষ করার পদ্ধতি উঠে যাওয়ায় জমি চাষে কৃষিতে খরচ কমেছে। সময় বেঁচে যাচ্ছে। -জাহাঙ্গীর আলম শাহীন, লালমনিরহাট থেকে
×