ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৃক্ষপ্রীতি

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ২৫ জানুয়ারি ২০২০

বৃক্ষপ্রীতি

এখানে কে গাড়ি পার্কিং করেছে? ড্রাইভার কে? সরাতে বল। সহকর্মী কনস্টেবলদের নির্দেশ দিলেন ওয়্যারলেস হাতে পুলিশ কর্মকর্তা। সিদ্ধেশ্বরীর এ গলিটায় যানজট লেগেই থাকে! সবজি ভ্যান ছাড়াও ব্যক্তিগত গাড়ি পার্ক করা থাকে সরু এ রাস্তায়। গাড়ি আটকিয়ে গেলেই সর্বনাশ! তার মধ্যে অসংখ্যক রিক্সা! তবে আজকের যানজটটা ভিন্ন কারণে। শীতের সকালেই শিবমদের বাসার সামনে প্রচ- ভিড়! পথচারীও চলাচল করতে পারছে না। রিক্সা, ভ্যান, গাড়ি একটির সঙ্গে অন্যটি লেগে আছে। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ। সবাই বলছে কেন শিশুদের এই মানববন্ধন? ফেস্টুন ও ব্যানার শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে! তাতে লেখা গাছ নিধন বন্ধ কর বন্ধ কর। আলো চাই বাতাস চাই নইলে মোদের রক্ষা নাই। পরিবেশবান্ধব বাড়ি চাই, ঘর চাই। ৩৫ জন শিশু। সবাই সারিবদ্ধভাবে রাস্তার প্রান্তে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সকলেই একটি বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। নেতৃত্বে শিবম। নূর, জারিফ, ওয়ারসি, অনন্ত, সাকিব, আইয়ান, দীপংকর, তামিম, আহিয়ান ও অনেকে। পুলিশ শিবমদের জানালো রাস্তা ছেড়ে দিতে। নূর বলল। -আমাদের দাবি একটাই এ মহল্লায় আর গাছ কাটা যাবে না! দীপংকর দেখতে বেশ লম্বা! হাতে লেখা একটি দরখাস্ত ওর হাতে। গাছ আমাদের বাতাসের মাধ্যমে অক্সিজেন দেয়। বৃক্ষ নিধন করে এলাকায় প্রচুর উঁচু ইমারত তৈরি হয়েছে। আকাশ দেখা যায় না। পাখিরা নেই। সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় নেই তেমন খেলার মাঠ। পরিবেশবান্ধব এলাকা প্রয়োজন। সুন্দর ও সবল স্বাস্থ্য গঠনে মুক্ত বাতাস জরুরী। ইত্যাদি তথ্যসহ দীপংকর চিঠিটি এগিয়ে দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে বলল। - এই নিন স্যার আমাদের কথা! ইউনিফর্মে আফসার নামের স্টিকারের পুলিশ কর্মকর্তাটি অবাক হয়ে গেলেন দরখাস্তের হস্তাক্ষর দেখে! বললেন - এটা কী তোমার হাতের লেখা? বেশ সুন্দরতো! দীপংকর নিশ্চুপ। ব্যানার শক্ত করে ধরে অনন্ত অত্যন্ত সজোরে বলে উঠে - না স্যার শিবমইমায় লেকছে! এ কথা শুনে বন্ধুরা হো হো করে হেসে ওঠে! বাচ্চারা স্লোগান দিচ্ছে ‘গাছ কাটা চলবে না চলবে না! আমাদের দাবি আমদের দাবি মানতে হবে মানতে হবে!’ এলাকায় পুলিশ দেখে নির্মাণ শ্রমিকরা ভয় পেল! পুলিশ নির্মাণাধীন ভবনের ঠিকাদারকে ডেকে কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। আর দরখাস্ত পড়ে শিবম বাহিনীকে আশ^স্ত করলেন। বললেন গাছ কাটা হবে না। এখানে বিল্ডিং হবে তবে গাছ নিধন না করে। এ কথা শুনে শিবম ও বন্ধুরা মানববন্ধন কর্মসূচীর ইতি টেনে একে একে রাস্তা ছেড়ে সবাই চলে গেল। বাসায় ঢুকেই শিবম মাকে জড়িয়ে ধরে। - তুমি না বলেছ আমরা মুক্তিযুদ্ধে শত্রু মোকাবেলা করে দেশ স্বাধীন করেছি! আজ আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে পেরেছি। শত্রু মোকাবেলা করে এলাকা স্বাধীন করেছি। জান মা আজকে আমাদের বিজয় দিবস! আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশের গাছটি আর কাটা হচ্ছে না। পুলিশ আঙ্কেল আমাদের কথা দিয়েছে! মাও বিষয়টি জানেন। মানববন্ধনের ধারণা ও পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ দিদির। দিদি মানে শিবমের বোন জয়ীর। ফেস্টুন ও ব্যানারের ভাষা এবং তা প্রস্তুত করে দেয়া জয়ীর কাজ। মিতব্যয়ী অধ্যাপক বাবার কাছ থেকে টিফিনের কথা বলে টাকা নিয়েছে জয়ী। নূরদের বাসায় বিকেলে বসে বড় বোন মেঘনা, জয়ী, শিবম, সাকিব ও আহিয়ানরা কিভাবে গাছ কাটা বন্ধ করবে তা নিয়ে পরামর্শ করেছে। জয়ী ও মেঘনা বান্ধবী। ওরা বিজ্ঞানের ছাত্রী। নামকরা স্কুল থেকে দুজন মেট্রিক পরীক্ষা দেবে এবার। শিবমদের বাসার বিল্ডিংটা ছয়তলা। ওদের বাসার ওপরে ছাদ। সেখানে সে মাকে নিয়ে আখসহ নানা ফুলের গাছ লাগিয়েছে। পরিবেশ পরিচিতি বইয়ে শিবম জেনেছে গাছ জীবন বাঁচায়। পরিবেশ ও সকল প্রাণীদের রক্ষা করে বৃক্ষ। ড্রয়িং রুমটা ওদের বেশ বড়। বাবা যতক্ষণ বাসায় থাকে প্রায় সময়টাই বাবার হাতে থাকে মোটা মোটা বই! শিবম বাবাকেও নানা প্রশ্ন করে। বই পাঠে নিমগ্ন থাকেন বাবা! ওর প্রশ্নের উত্তর কখনও দেন, কখনও দেন না। স্কুল শেষ করে শিবম ঝকঝকে সকালের আলোয় জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। পাশেই একটি বড় আমগাছ। আগে তিনটি গাছ ছিল। সে গাছের ডালে পাখিদের আড্ডা! তা দেখে শিবমের ভাললাগে। মাও ওর সঙ্গে এসে মাঝে মাঝে জানালার পাশে এসে দাঁড়ান। স্বচ্ছ আলো আর নির্মল বাতাস ওদের মন ভরিয়ে দেয়। ওদের বিল্ডিং লাগোয়া দোতলা ছাদ। ছাদে কবুতরদের বাসা। ওদের নানা খাবার দেয় শিবম। লিফট ছাড়া শিবমদের বাসা। সবারই উঠানামা করতে বেশ কষ্ট হয়। ভাড়াও অনেক বেশি। পুরনো দালান! পোকামাকড়ের বসতি। মাঝে মাঝে রান্না ঘরের ভাঙ্গা জানালা দিয়ে ইঁদুরও ঢোকে। গভীর রাতে ঘুম ব্যাঘাতে ছাদ ঢালাই মেশিনের উৎকট শব্দ! বাসার কোনকিছু বিকল বা নষ্ট হলে বাড়িওয়ালা ঠিক করে দেন না। মা, দিদি ও শিবমের প্রচ- টিকটিকি ভীতি! বাবাকেও বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে! দিদির পরীক্ষা শেষে সমস্যায় জর্জরিত বাসাটি বাবা পাল্টাবেন এমন সিদ্ধান্ত পাকাই। তাছাড়া বাসার পাশে গাছ কেটে বিল্ডিং উঠবে। আলোর বদলে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাবে বাসাটা! কাজ শেষে রাতে বাসায় ফিরলেন বাবা। নিচে প্রতিবেশীদের কাছে শিবম ও তার বন্ধুদের আজকের মানববন্ধনের ঘটনাটি জেনেছেন। শিবম দুপুরে বাবাকে ল্যান্ড ফোনে জানিয়ে ছিল! ছেলেমেয়ের বীরোচিত খবরে বাবার মহানন্দ! ফেরার পথে বাবা নিয়ে এসেছেন শিবমের প্রিয় চিকেন বার্গার, জয়ীর ভাঁপাপিঠা আর মার জন্য বার্টার লোফ! মা বললেন, -ও তুমি জেনে গেছ তাহলে? বাবা মাথা নাড়ান। বলেন -আমি তোমাদের একটি সুখবর দেই। জয়ী বলল - আমি জানি বাবা তুমি কি বলবে? নিশ্চয়ই নতুন বাসার এ্যাডভান্স করে এসেছ! - না! তা নয়! শুনেছি পাশের বাসাটা আর আটতলা হচ্ছে না। চারতলার অনুমোদন পেয়েছে ওরা। গাছও নিধন হচ্ছে না। এত ছেলেমেয়ের বিজয়! তাই আলো বাতাস ভরপুর এ বাসাতেই থাকছি আমরা। বাবার কথায় শিবম বেজায় খুশি! কিন্তু বাবার চোখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন মা! অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×