ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পরিযায়ী পাখি গণনা চলছে সারাদেশেই

শীতে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে অতিথি হয়ে এসেছে ৫৪ হাজার পাখি!

প্রকাশিত: ১০:০৮, ২৩ জানুয়ারি ২০২০

শীতে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে  অতিথি হয়ে এসেছে    ৫৪ হাজার পাখি!

মোরসালিন মিজান ॥ টাঙ্গুয়ার হাওড় এমনিতেই অপরূপ। সুনামগঞ্জের এ হাওড়ে কত কি যে দেখার আছে! তবে পাখিদের বিপুল উপস্থিতি আর ওড়াউড়ির ছবিটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে এখানে পাখিরা আসে। পরিযায়ী পাখিদের ডানায় আকাশ ঢেকে যায়। এবারের শীতেও অতিথি হয়ে এসেছে নানা জাতের পাখি। কিন্তু সংখ্যায় কত? সাধারণ চোখে দেখলে যে কেউ বলবেন, ‘অগণিত’। ‘অসংখ্য’ বলবেন। তবে প্রকৃত সংখ্যাটি জানারও সুযোগ আছে। জানার লক্ষ্যে এখন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে চলছে পাখি শুমারি। গণনার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। স্যাটেলাইট রিং পরানো হচ্ছে পাখির পায়ে। ১০ দিনব্যাপী কার্যক্রম গত ১৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। কাজটি করছে প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, ওয়াইল্ড বার্ড মনিটরিং, বাংলাদেশ বন বিভাগ ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব। বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইনাম আল হক, আইইউসিএন’র গবেষক সাকিব আহমেদ, জেনিন আজমিরী, রিবাউন্ড বার্ড ক্লাবের সদস্য পল থমসন ও যুক্তরাজ্যের পাখি পর্যবেক্ষক জেমস পেন্ডার প্রমুখ এ কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছেন। সম্মিলিত উদ্যোগে পাওয়া প্রাথমিক তথ্য বলছে, এবারের শীতে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ৫৪ হাজারের মতো পরিযায়ী পাখির উপস্থিতি গণনা করা সম্ভব হয়েছে। একই কার্যক্রমের শুরুতে ৩৫ প্রজাতির ৫১ হাজার ৩৬৮টি জলচর পরিযায়ী পাখি গণনা করা হয়েছিল। পরবর্তী দিনগুলোতে বাকি পাখিগুলোর সন্ধান মেলে। পাখিপ্রেমী ও বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে ইনাম আল হক গত কয়েকদিন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে কাটিয়েছেন। পাখি দেখে, গুনে গবেষণা করে ঢাকায় ফিরেছেন তিনি। বুধবার জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, পাখিদের সঙ্গে সময় কাটাতে আমার সব সময়ই ভাল লাগে। আমি প্রথম তিনদিন সেখানে ছিলাম। পাখি দেখেই কাটিয়েছি। গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ৯৫ ভাগই পরিযায়ী পাখি। শীতপ্রধান দেশগুলো থেকে ওরা উড়ে আসে। এবারও এসেছে। গোটা এলাকা ওদের কলকাকলিতে মুখর এখন। গণনার পাশাপাশি কিছু দুর্লভ পাখি দেখার কথা জানান তিনি। বলেন, ফায়ার থ্রোট নামের একটি পাখি সারা পৃথিবীতেই দুর্লভ। খুব ছোট একটি পাখি। ২০১২ সালে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে এর সন্ধান পেয়েছিলাম আমরা। এর পর অনেক বছর দেখা যায়নি। দেশে পাখিটি আছে কিনা, এ নিয়ে একটা বিরোধ চলছিল। আর তার পর এবার সেখানে গিয়ে আমরা পাখিটিকে পেয়ে গেলাম! বিশ্বব্যাপী বিপন্ন ফায়ার থ্রোট বাংলাদেশের শুধু টাঙ্গুয়ার হাওড়েই আছে বলে জানান তিনি। এছাড়াও খয়রা এবং কাস্তেছড়া নামের দুটি দুর্লভ পাখি এবার দেখা গেছে। এমন তথ্য দিয়ে ইনাম আল হক বলেন, পাখি দুটি দেশ থেকে প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। সারা বিশ্বে এরা বিপন্ন নয় বটে, বাংলাদেশে দুর্লভ। বহুদিন কোথাও দেখা যায়নি। উপস্থিতি প্রায় শূন্যের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এ অবস্থায় গত কয়েকদিন আগে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে খুঁজে পাওয়া গেছে পাখি দুটিকে। এমন ফিরে পাওয়ার কথা ভীষণ আনন্দের সঙ্গেই উল্লেখ করেন সারাজীবন পাখি ভালবেসে যাওয়া ইনাম আল হক। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের পাখির মোট সংখ্যা সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাখির সংখ্যা কোন বছর একটু বেশি হতে পারে। কোন বছর কম হতে পারে। সেটা বিশেষ বিবেচ্য হবে না। কারণ এ আসা যাওয়া চলতে থাকে। তবে ১০ বা ২০ বছরের হিসাবে যদি পাখির সংখ্যা কমছে বলে মনে হয়, তাহলে সেটা ভাল কথা নয় এবং গত ১০ বা ২০ বছরে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে পাখির সংখ্যা কমেছে বলেই জানান তিনি। এর পেছনে একটি দুটি কারণ নয়, বৈশ্বিক নানা কারণে পাখির সংখ্যা কমছে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে, টাঙ্গুয়ার হাওড়ের পাখিশুমারি আগামী শনিবার শেষ হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে কাছাকাছি সময়ে দু’বার পাখি গণনা করা হয়। সে অনুযায়ী, কয়েকদিন পর দ্বিতীয় দফা গণনা শুরু হবে। জানা যায়, তারও আগে উপকূল অঞ্চলের পাখি গণনার মাধ্যমে এ বছরের পাখি শুমারি শুরু হয়। এর পর পাখি গণনা করা হয় শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে। এরই ধারাবাহিকতায় এখন চলছে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। পরে শুমারি হবে হাকালুকি হাওড়ে। সেখান থেকে দলটি যাবে সোনাদিয়া দ্বীপে। সব শেষে গণনা করা হবে সেন্টমার্টিনে। উপকূলীয় অঞ্চলেও দ্বিতীয় দফায় শুমারি করা হবে বলে জানা যায়। আরেকটি সূত্র মতে, চলতি বছর সর্বাধিক ৯ হাজার ৯২৫টি পাতি কুট পাখি গণনা করা সম্ভব হয়েছে। লাল মাথার ভুতিহাঁস পাওয়া গেছে ৮ হাজার ৩৯৪টি। পাতি তিলিহাঁসের সংখ্যা ৭ হাজার ২৭৮টি। লেঞ্জাহাঁস পাঁচ হাজার। ইউরেশীয়-সিঁথিহাঁস ৪ হাজার ৮৪৬টি। ফেব্রুয়ারিতে পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। তবে ইনাম আল হকের কথাটিই বিশেষ করে মনে রাখতে হবে। পরিযায়ী পাখির বেলায় নিয়মিত আসা যাওয়ার হিসাবটি বড় নয়, প্রকৃত সংখ্যাটি কমছে। এটা সত্যি খুব বেদনার। এ বেদনা যে করেই হোক কমাতে হবে। আমরা সেভাবে ভাবছি তো?
×