ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের আংশিক পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ২২ জানুয়ারি ২০২০

  পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের  আংশিক পর্যবেক্ষণ

(গতকালের পর) বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী তার রায়ে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন : ১। (ক) বাংলাদেশ রাইফেলসের নিরাপত্তাবিষয়ক ইউনিট RSU বিজিবির মেধাবী, সৎ ও চৌকস সদস্যের সমন্বয়ে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো এবং ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটনাকালীন সময়ে দায়িত্বে থাকা জঝট এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা। (খ) ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ রাইফেলসের মহা-পরিচালকের দরবারে সশস্ত্র আক্রমণ এবং পিলখানায় মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনার পূর্বাভাস সংগ্রহে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থাসহ দায়িত্বে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ২। (ক) মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২৪/০২/২০০৯ তারিখে পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলসের কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেছেন, অথচ সরকারের সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা বাহিনী ও নিরাপত্তা কর্মীদের বাহ্যিক তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও ভেতরে অন্তঃসারশূন্যতা পরিলক্ষিত হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের অধিকতর সতর্ক করা। (খ) বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ এবং প্রকাশ্যে লিফলেট বিতরণ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ কমান্ডিং অফিসারদের নজরে আসা সত্ত্বেও তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ গ্রহণ না করে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য সংশ্লিষ্টদের মনোযোগী ও সতর্ক হওয়া। ৩। (ক) মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মেধাবী, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দক্ষ, ত্বরিত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী, উপযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে বিজিবির মহা-পরিচালকসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (খ) বিজিবির অফিসারসহ সকল পদের সদস্যদের মানবিক গুণাবলী, দায়িত্ব, কর্তব্য, বিভাগীয় আইন ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৪। (ক) সামরিক/বেসামরিক সকল শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ব্রিটিশ আমলের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করে সকলকে সেবার মানসিকতা নিয়ে দেশ প্রেমের সঙ্গে কাজ করার প্রশিক্ষণ প্রদান করা। (খ) ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়া এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সংগ্রামে পেশা, পদবী, সামাজিক পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে সংবিধানে উল্লিখিত মূলনীতি অনুসরণ করে সকলের প্রতি মানবিক আচরণ ও সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতায় বাহিনীকে গড়ে তোলা। ৫। (ক) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিজিবিসহ অধীনস্থ সকল বাহিনীর সদস্যদের সুবিধা/অসুবিধা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (খ) বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির পূর্বেই কর্তৃপক্ষকে আইনসম্মত ও সম্মানজনক উপায়ে তার সমাধান খুঁজে বের করা। ৬। (ক)। বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে চাকরি বিধি মতে মর্যাদার পার্থক্য যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং সকলকে সংবিধান সম্মত উপায়ে আইনানুগভাবে সম্মানের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের চাকরি করার সুযোগ সৃষ্টি করা। (খ) বিজিবির সদস্যদের পদোন্নতি, বেতন, ভাতা, রেশন, ছুটি, আবাসিক সমস্যা, চিকিৎসা ও সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের সুবিধাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যা দ্রুত সমাধানে মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৭। (ক) আইনানুগ কোন বাধা না থাকলে অন্যান্য বাহিনীর ন্যায় বিজিবির সদস্যদের জাতিসংঘের শান্তি মিশনে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (খ) বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের প্রতি সম-আচরণ করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার কর্তৃক অধীনস্তদের প্রতি আত্মমর্যাদা হানিকর যে কোন আচরণ থেকে বিরত থাকা, কারণ তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। ৮। (ক) ২৫/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে পিলখানায় নিহত সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। (খ) সেনা কর্মকর্তাসহ নিহতদের সন্তান বা পরিবারের উপযুক্ত সদস্যদের আর্থিক, সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা বিধানে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। (গ) সামরিক কর্মকর্তাসহ নিহতদের সম্মানে পিলখানাসহ দেশের সকল সেনানিবাস, বিজিবির সকল সেক্টর হেড কোয়ার্টারে নাম ফলক নির্মাণ করা। ৯। (ক) পুনর্গঠিত বিজিবি সংবিধান ও নেতৃত্বের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে দেশের সীমান্ত রক্ষাসহ তাদের ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পেশাদার বাহিনী হিসেবে দেশপ্রেম, সততা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে পালনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিজিবির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা। (খ) দেশের সীমান্তরক্ষী হিসেবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রাথমিক নিরাপত্তা বাহিনীর (First Defence Force) দায়িত্বে থাকা বিজিবিকে শক্তিশালী বাহিনী রূপে গড়ে তোলার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১০। (ক) সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীকে ‘অপারেশন ডাল ভাতের ন্যায় অন্য কোন আর্থিক কর্মসূচীতে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত পরিহার করা। আর্থিক লেনদেন ও লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের মধ্যে অহেতুক বিভেদ ও নৈতিক স্খলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ রাইফেলসের ক্ষেত্রে ‘অপারেশন ডালভাত’ উৎকৃষ্ট উদাহরণ। (খ) পিলখানা হত্যাকান্ডে ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা’ উদঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য জনস্বার্থে সরকার প্রয়োজন মনে করলে আইনানুগভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ১১। (ক) সমাজের সকল স্তরে নৈতিকতা পুনরুদ্ধার ও জাতিগঠনের জন্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় বাধ্যতামূলক নীতিশাস্ত্র (Ethics) শিক্ষাদান অতি জরুরী। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজের প্রতিটি স্তুরে অসম প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় নীতিশাস্ত্রের (Ethics) অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক হওয়া অপরিহার্য। (খ) রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের বসবাস উপযোগী উন্নত ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে নিজ নিজ ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুশাসনে শিশুদের চরিত্র গঠনের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার বিশুদ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত জরুরী। মামলার ক্রমিক অনুযায়ী প্রত্যেক আপীলকারীর জন্য পৃথক পর্যবেক্ষণ ডিএডি তৌহিদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী সশস্ত্র বাহিনীর ৫৭ জন মেধাবী অফিসারসহ ৭৪ জন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে নির্মম ও বর্বরোচিতভাবে হত্যাকান্ডের সঙ্গে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা প্রমাণিত হলে দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি হবে, এটাই আইনের বিধান, কারণ কেউই আইনের উর্ধে নয়। সেক্ষেত্রে আদালতের কাছে ন্যায়বিচারের দাবি উভয়ের জন্য সমভাবে বিবেচ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। ডিএডি তৌহিদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/১১৪/৩৪/১২০-বি ধারায় অভিযোগ গঠিত হয়েছে। সে কারণে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষ্য পর্যালোচনার পূর্বে প্রয়োগিক আইন পর্যালোচনা আবশ্যক। চলবে... লেখক : হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি
×