ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এই মর্মান্তিক মৃত্যুর দায় কাদের?

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২২ জানুয়ারি ২০২০

এই মর্মান্তিক মৃত্যুর দায় কাদের?

বাংলাদেশে ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্র নাইমুল আবরার রাহাত একটি অনুষ্ঠান চলার কালে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মর্মান্তিকভাবে মারা যায়। অনুষ্ঠানটি ছিল ঢাকার ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিক কাল্টের’ দৈনিক পত্রিকা গ্রুপের কিশোর ম্যাগাজিনের। এই অনুষ্ঠান চলার সময়েই আবরার বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয় এবং তাকে হাসপাতলে নেয়ার পর ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অভিযোগ উঠেছে অবহেলাজনিত কারণে আবরারের মৃত্যু হয়েছে। এই অবহেলা দেখিয়েছেন অনুষ্ঠানটির আয়োজকরা। এই আয়োজক ছিলেন ওই কিশোর ম্যাগাজিনের কর্তৃপক্ষ। এটি ছিল একটি গান-বাজনায় আনন্দ উৎসব। এই উৎসবে এসে আবরারের মর্মান্তিক মৃত্যু শুধু তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য নয়, দেশের মানুষের জন্যও গভীর শোকের কারণ। যদি কারও ইচ্ছাকৃত অবহেলায় এমন একটি তরতাজা কিশোর প্রাণ অকালে ঝরে গিয়ে থাকে, তাহলে অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি পাওয়া উচিত। আর অনিচ্ছাকৃতভাবে এটা হলে এটি হত্যাকান্ড নয়, দুর্ঘটনা। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে লঘুপাপে যেন গুরু শাস্তি না হয়। মৃত্যুমাত্রই শোকাবহ। আবরারের মৃত্যু আরও শোকাবহ এ জন্যই যে, তার একটি মহা সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত ছিল। ব্যক্তি বা সমষ্টির অবহেলায় যদি এই মৃত্যু হয়ে থাকে, তাহলে তো তাদের বিচার হওয়া উচিত। অভিযোগ করা হয়েছে আবরারের মৃত্যু ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে ঘটেছে। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল এবং আবরার বিদ্যুতস্পৃষ্ট হওয়ার পরও তাকে কাছের হাসপাতালে না পাঠিয়ে দূরের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া আবরারের মৃত্যুর পরও অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়নি। এই অভিযোগে কিশোর পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশকসহ দশজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এই কিশোর পত্রিকার সম্পাদক একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। প্রকাশক ‘নিরপেক্ষ সাংবাদিক কাল্টের’ দৈনিক পত্রিকাটির সম্পাদক। পত্রিকাটি ঢাকার তথাকথিত সুশীল সমাজেরও মুখপত্র। এটি তাদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ। অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই অনুষ্ঠানের অংশীদার ছিল ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। অনুষ্ঠানে তাদের একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প ছিল। ওই ক্যাম্পের ডাক্তারদের পরামর্শেই আবরারকে ইউনিভার্সাল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। আর আবরারের মৃত্যুর খবর পাওয়ার আগেই অনুষ্ঠানটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ কান্ডজ্ঞান বলে, এই মৃত্যু হত্যাকান্ড নয়। ইচ্ছাকৃত অবহেলায় এই মৃত্যু ঘটেছে কিনা তাও বিচার্য বিষয়। ফলে ১০ জন সাংবাদিক ও সাহিত্যিকের বিরুদ্ধে অবহেলা ও অব্যবস্থা দ্বারা মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে এদের বিরুদ্ধে সমন জারি না করে সরাসরি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি সঙ্গত হয়েছে কিনা, এই ব্যাপারে আদালতের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তুলতে চাই না। কিন্তু বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে দুটি কারণে। এক. আবরারের মতো উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যুতে। তাতে তার সহপাঠী ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা অনুষ্ঠানে বিদ্যুত ব্যবস্থাপনার ত্রুটির সমালোচনা করেন। দৈনিক পত্রিকাটির অফিসের সামনে মানববন্ধনও হয়। দুই. সরকারও এই মর্মান্তিক মৃত্যু এবং তাতে জনমনের বিক্ষোভকে গুরুত্ব না দিয়ে পারেনি। পুলিশের রিপোর্টেও বলা হয়েছে, সঠিকভাবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা না করে এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না রেখেই এই অনুষ্ঠানটি করা হয়েছে। তদন্তকারী পুলিশ অফিসার বলেছেন, এই মৃত্যুকে একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়ার জন্য তার ওপর চাপ প্রদান করা হয়েছিল। কারা চাপ প্রদান করেছিল, সেকথা তিনি বলেননি। এই মৃত্যু জনমনে যে বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছে তাকে সরকার গুরুত্ব না দিয়ে পারেনি, সেকথা আগেই লিখেছি। এই মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে কেবিনেট কার্যালয়ে আলোচনা হয়েছিল তা নিয়েও একটি মহল গুজব ছড়াচ্ছে। সরকারের ইঙ্গিতেই নিম্ন আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। বলা হচ্ছে, সম্ভবত এই গুজবের ওপর ভিত্তি করেই এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেছে, মামলাটি যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে এবং বাক স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা হয়। একই সঙ্গে ৪৭ জন বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক এক যুক্ত বিবৃতিতে এই মামলায় কেবল দৈনিক পত্রিকাটির সম্পাদককে অভিযুক্ত করার প্রতিবাদ করেছেন। এটাকে তারা উদ্দেশ্যমূলক বলেছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, হামিদা হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, শাহদীন মালিক প্রমুখের নাম দেখে বুঝতে বাকি থাকেনি, এরা অধিকাংশই দৈনিক পত্রিকাটির তত্ত্বাবধানে গঠিত ‘নিরপেক্ষ কাল্টের’ লোক। দৈনিক পত্রিকাটির সম্পাদকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাত্র জারি হয়েছে। তিনি গ্রেফতার হননি। আর তাতেই তারা কাতর হয়ে পড়েছেন। তাদের কাতর হওয়াও উদ্দেশ্যমূলক। তারা দেশে বাক স্বাধীনতা তালগোল বলে রব তুলেছেন। একজন সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কোন মতপ্রকাশের জন্য নয়, একটি মর্মান্তিক মৃত্যু অবহেলাজনিত কারণে ঘটানোর অভিযোগে যদি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তা কি বাক স্বাধীনতা রোধের জন্য ব্যবস্থা? সম্পাদক বা সাংবাদিকরা কি আইনের উর্ধে? ইতোপূর্বে এই দৈনিক সংশ্লিষ্ট আরেকটি সাপ্তাহিকে ধর্ম সম্পর্কে কটাক্ষ করে একটি কার্টুন প্রকাশিত হওয়ার পর ওই সাপ্তাহিকের সম্পাদক অথবা প্রকাশক হিসেবে মৌলবাদীরা একই সম্পাদকের কল্লা নিতে চেয়েছিল। তৎকালীন সরকার তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। কেবল হুমকিটি দিয়েছিলেন বায়তুল মোকাররম মসজিদের তখনকার খতিব। সম্পাদক ছুটে গিয়ে খতিবের কাছে অপরাধ স্বীকার করে তওবা করেন এবং নতুন করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। কই, তখন তো তার কাল্টের সদস্যদের একটি কথাও বলতে শোনা যায়নি। মৌলবাদী হুঙ্কারে দেশে মুক্তভাবে কথা বলাই বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল। তখন এই কাল্টের মাননীয় সদস্যরা একেবারে নিশ্চুপ ছিল কেন? আর এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল? তারা খাসোগির মতো সাংবাদিক হত্যার কোনো প্রতিকার করতে পারেন না। তুরস্কে নির্মম সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ করতে পারেন না অথবা চান না, কিন্তু বাংলাদেশে পান থেকে চুনটি খসলেই একেবারে রা রা করে ওঠেন। বাংলাদেশে আবরারের মতো কিশোরের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ সম্পর্কে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত হওয়া এবং তার মৃত্যুর পেছনে অবহেলা থাকলে এবং তা প্রমাণিত হলে অবহেলাকারীদের শাস্তি হওয়া উচিত। তাই বলে রজ্জুতে যেন সর্পভ্রম করা না হয়। আদালতের প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি, এই মামলায় অভিযুক্তরা সকলেই সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং অনুষ্ঠানটিও ছিল সাংস্কৃতিক। পুলিশও বলছে, এই মৃত্যু হত্যাকান্ড নয়, অবহেলা ও অব্যবস্থা দুর্ঘটনার কারণ। এই অবস্থায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সমন জারি করাই যথেষ্ট ছিল। দেশের সম্মানিত মানুষের এবং জনগণের মতামতের প্রতিনিধিত্ব যারা করেন, তাদের সম্মান রক্ষা করে চলা আদালতেরও দায়িত্ব। কোন গুরুতর অভিযোগ এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচারে প্রমাণিত হলে অন্য কথা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো ঢাকায় বিদ্যুত ও গ্যাস ব্যবহারে দারুণ অসতর্কতা দেখা যায়। বিবাহের অনুষ্ঠানের অনেকগুলোতে দেখেছি, বিদ্যুত ব্যবস্থায় বিপজ্জনক অনিয়ম। কিশোর পত্রিকাটির অনুষ্ঠানেও এই ধরনের অব্যবস্থাপনা ও অসতর্কতা থাকলে বিস্ময়ের কিছু নেই। রাজধানীতে এবং মফঃস্বল শহরগুলোতে এ ধরনের অনুষ্ঠানে বিদ্যুত কর্তৃপক্ষের দ্বারা বিদ্যুত ব্যবস্থা পরীক্ষা এবং এ সম্পর্কে সার্টিফিকেট গ্রহণের ব্যবস্থা করলে ভাল হয়। আবরারের মৃত্যুজনিত ঘটনায় কাউকে এ যাবত গ্রেফতার করা হয়নি। আমার ধারণা, কেউ গ্রেফতার হলেও সঙ্গে সঙ্গে যদি জামিন না পান, যদি তাদের জামিন দেয়া না হয় এবং বিচারকার্য সুষ্ঠু না হয়, তাহলে বুঝতে হবে এর পেছনে উদ্দেশ্য রয়েছে। তখন কাল্টের সদস্যরা প্রতিবাদ জানালে এমনকি আন্দোলনে নামলে ভাল করতেন। বাজে ছোবল মেরে কান নেয়ায় আগেই বাজ বাজ বলে চিৎকার করে ছোটা হাস্যকর। মূলত একজন সম্পাদককে কাল্পনিক গ্রেফতার থেকে বাঁচানোর জন্য এমন দলবেঁধে মাঠে নামার আগে ৪৭ জন বিবৃতিদাতা যদি রাজধানীসহ সকল শহরে বিদ্যুত ব্যবস্থা সুষ্ঠু ও নিয়মিত করা এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের আরও মৃত্যু রোধ করার দাবি জানাতেন তাহলে ভাল করতেন। আমাদের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এ জন্য সরকারকে সতর্ক করার আগে দেশে যারা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার নামে সৎ সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করে চলেন এবং দেশের সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক দলগুলোকে সাহায্য দানের জন্য দেশবাসীর মনে নানা বিভ্রান্তি ছড়ান, তাদেরও সতর্ক করলে বিবৃতিদাতারা বিবেকের কাছে দায়মুক্ত থাকতে পারতেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের যেমন নিরপেক্ষ থাকা উচিত, তেমনি সংবাপত্রেরও। একটি আরেকটির পরিপূরক। অন্যথা হলেই ভারসাম্য নষ্ট হয়। বিবৃতিদাতাদের একথা মনে রাখা উচিত ছিল। [লন্ডন ২১ জানুয়ারি, মঙ্গলবার ২০২০]
×