ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকারী কর্মকর্তার দখলে ৬০ কোটি টাকার ভূমি

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২২ জানুয়ারি ২০২০

 সরকারী কর্মকর্তার দখলে ৬০ কোটি টাকার ভূমি

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে বিএনপির আশীর্বাদপুষ্ট প্ল্যানিং কমিশনের জয়েন্ট চীফ (যুগ্ম প্রধান) সরকারী জায়গায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করাচ্ছে গত ১২ জানুয়ারি থেকে। এমন অভিযোগ পেল ৯৯৯ দ্রুত সেবা। সরকারী গাছ ও টিলা কেটে বিশালাকার ভাড়াঘর নির্মাণের অভিযোগ পরিদর্শনে গিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনে চুপসে গেছে ১০০ গজ দূরে থাকা পরিবেশ অধিদফতরের মহিলা পরিদর্শকের টিম। এদিকে গত ১৫ জানুয়ারি অবৈধ কাজে বাধা দিয়েছেন চট্টগ্রামের কাট্টলী ভূমি দফতরের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ তোহিদুল ইসলাম। সরকারী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামানের স্বার্থে আঘাত আসায় পরিবেশ ও ভূমি কর্মকর্তাদের মোবাইলে হেনস্থা করার অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার আগারগাঁওর পরিকল্পনা কমিশনে কর্মরত জয়েন্ট চীফ (যুগ্ম প্রধান) সাইদুজ্জামান অবৈধভাবে তার দখলে রেখেছেন জেলা প্রশাসনের ৬০ কোটি টাকা মূল্যের পরিত্যক্ত গেজেটভুক্ত সরকারী ৬০ গ-া ভূমিকে। ১৯৮৩ সালে ভূমি রেজিস্ট্রি অফিসের বালাম বইয়ের ৭২ নং পাতা ছিঁড়ে ও ভুয়া দলিল তৈরির মাধ্যমে এই আমলা সরকারী ভূমি অবৈধ দখলে রেখেছে। ভুয়া বিএস খতিয়ান তৈরি করায় ২০০৯ সালে তৎকালীন চান্দগাঁও ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল কাদের এই বিএস খতিয়ান বাতিলের আদেশ দিলেও দীর্ঘ ১১ বছরেও কার্যকর হয়নি। অভিযোগ কয়েক কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে ধামাচাপা দিয়েছে এই আদেশ। এর আগে ২০০১ সালে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এ ভূমি পরিত্যক্ত ঘোষণা করায় সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট মামলা দায়ের অভিযোগ রয়েছে এই আমলাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে। এদিকে, বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ায় এই খবর প্রকাশিতের পর এনএসআইয়ের রিপোর্টেও এই আমলা অবৈধভাবে সরকারী ভূমি দখলের প্রমাণ মিলেছে ২০১২ সালের তদন্ত রিপোর্টে। এ ব্যাপারে কাট্টলী ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার তোহিদুল ইসলাম জানান, ৩৩৩ দ্রুত সেবার অভিযোগের ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশনের জয়েন্ট চীফ মোহাম্মদ সাইদুজ্জামানের জেলা প্রশাসনের জায়গায় অবৈধ ভাড়াঘর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তার সহোদর নুরুজ্জামানকে সতর্ক করা হয়েছে। সরকারী গাছ কাটার বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর। এদিকে, এ বিষয়ের সত্যতা জানতে পরিকল্পনা কমিশনের জয়েন্ট চীফ মোহাম্মদ সাইদুজ্জামানকে কয়েক দফায় ফোন করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বিবিধ মামলা পিও-১৬/৭২-এর পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এই আমলার অবৈধ দখলে থাকা ভূমি। কারণ লট-৯ পাহাড়তলী মৌজার এই বিএস খতিয়ান ৮৫ ও ৯৫ এই ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করা ১ একর ১২ শতক ভূমির মধ্যে ৫৬ শতক ভূমি অ-বাঙালী হাসিনা ইব্রাহিমের নামে ১৯৬৪-৬৪ সালে রেকর্ডভুক্ত ছিল। আরএস ৫৫ দাগের আওতায় নামজারি মোকদ্দমা ২১৯ অনুযায়ী রেকর্ডীয় মালিকের স্থলে পিএস ২৮ নং খতিয়ান তৈরি হয়। এই খতিয়ানের আওতায় পিএস ৬০ ও ৬২ দাগের অধীনে বিএস দাগ নং ৭০, ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫, ৭৬, ৭৮ ও ৭৯। তবে এই দাগগুলো রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের পিও ১৬/৭২-এর আওতায় পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালের ২ সেপ্টেম্বর সহকারী কমিশনার ভূমি ও ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম বেনজামিন রিয়াজী। এদিকে, উচ্চ আদালতের তথ্য অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের এই ভূমি পরিত্যক্ত ঘোষণাকে স্থগিত করতে সাইদুজ্জামান, সহোদর নুরুজ্জামানসহ আটজন ২০০১ সালের ২২ নবেম্বর উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন (৬৫৯০/২০০১) দায়ের করে। চট্টগ্রাম আদালতের তথ্য অনুযায়ী, এই আমলা স্থানীয় রওশনারা বেগম গংয়ের বিরুদ্ধে আদালতে পক্ষ হয়ে এই আমলা চারটি মামলা দায়ের করে হয়রানি করছে ২০০৪ সাল থেকে। চান্দগাঁও ও কাট্টলী ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, সরকারী আমলা সাইদুজ্জামানের দখলে থাকা বিএস দাগ নং ৭১, ৭৬, ৭৮, ৭৯ ও ৮২ দাগের পিএস দাগ নং-৭১ এবং বিএস ৭২, ৭৩, ৭৪ ও ৭৫ দাগের পিএস দাগ নং ৭৩। ১৯৮৮ সালের ২৬ ডিসেম্বরের অতিরিক্ত গেজেট অনুযায়ী উল্লেখিত বিএস দাগদ্বয় এপি তালিকাভুক্ত আছে। এমনকি ৮৫ ও ৮৬ নং খতিয়ানে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয় নাই। বিএস ৯৫ ও ১১১ নং খতিয়ানে বাংলা ১৪০০ সাল পর্যন্ত খাজনা আদায় করা হলেও এপি গেজেটের আওতায় উক্ত ভূমি পরিত্যক্ত ঘোষণার পর খাজনা আদায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এদিকে, ২০০৮ সালের ২২ জুন চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আব্দুল কাদের স্বাক্ষরিত এক তথ্য বিবরণীতে উল্লেখ্য করা হয়েছে এসব ভূমি পরিত্যক্ত। এমনকি এই সহকারী কমিশনার ২০০৯ সালের ১৩ জানুয়ারি এক সিদ্ধান্তে সরকারী আমলা সাইদুজ্জামানের অবৈধ বিএস খতিয়ান বাতিল করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন। এদিকে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জানা গেছে, শহীদ সরণি আবাসিক এলাকার ২ নং সড়কের উন্নয়ন কর্মকান্ডে সরকারী আমলা সাইদুজ্জামান বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়েছে। উন্নয়ন কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত তিন বছর ক্ষেপণ করেছেন। পরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করে র‌্যাব ও পুলিশের উপস্থিতিতে ১২ ফুট প্রশস্থ ও আড়াই শ’ ফুট দৈর্ঘ্য ইট সলিংয়ের রাস্তা করতে বাধ্য হয়। আরও অভিযোগ রয়েছে, সরকার ঘরে ঘরে শতভাগ বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করলেও বিএনপির আশীর্বাদপুষ্ট এই আমলা ২০১৯ সালের শুরুতে সরকারী কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এই আমলা বিদ্যুত মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিএসের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদ্যুত বিভাগের উন্নয়ন বন্ধ করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে চট্টগ্রামে পিডিবির প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মোতালেব, প্রকৌশলী ইকবাল করিম থেকে। বিদ্যুত ভবনের নির্বাহী প্রকৌশলীকেও ফোনে হেনস্থা করার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে এই আমলা। এমনকি প্রয়োজনে আকবর শাহ শহীদ সরণি আবাসিক এলাকা বিদ্যুতবিহীন করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছেন এই আমলার সাঙ্গপাঙ্গরা। এ ব্যাপারে পিডিবির তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল মোতালেব জানান, প্ল্যানিং কমিশনের অফিস প্রধান সাইদুজ্জামান ফোনে সরকারের এ উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়ন করতে নিষেধ করেছেন। ফলে আমরা বিদ্যুতের উন্নয়ন বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি।
×