ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অবশেষে ঋণের বিপরীতে সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২১ জানুয়ারি ২০২০

 অবশেষে ঋণের বিপরীতে সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যাংক ঋণের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার অবশেষে কার্যকর হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকারের নিজস্ব অর্থের ৫০ শতাংশ বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখার বিধান রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়নে আর কোন বাধা থাকল না। যুগান্তকারী এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দেশের উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও ব্যাংক ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছে। এতে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। এছাড়া সরকারের এই ঘোষণায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, ঋণের বিপরীতে উচ্চ সুদের কারণে দেশে খেলাপী ঋণ বাড়ছে, উদ্যোক্তারা দেউলিয়া হয়ে পড়ছেন। নতুন শিল্পকারখানা স্থাপনে বিনিয়োগকারীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। উচ্চহারের সুদকে কেন্দ্র করেই গত দু’দশক ধরে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এ কারণে বহু উদ্যোক্তা দেউলিয়া হয়ে পড়ছেন। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ সেভাবে বাড়ছে না। সিঙ্গেল ডিজিট সুদহারের দাবিও উদ্যোক্তাদের নতুন নয়। গত এক দশক ধরে সুদহার কমানোর জন্য ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা দাবি জানিয়ে আসছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সভা-সেমিনারে বলা হয়েছে। কিন্তু কোনভাবেই সুদহার না কমে বরং তা বাড়ছিল। সর্বশেষ ঋণের বিপরীতে ১৮-২৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ গুনেছেন বিনিয়োগকারীরা। সুদহারের পাশাপাশি রয়েছে সার্ভিস চার্জ। বিভিন্ন নামে সার্ভিস চার্জ কাটায় গ্রাহকরা বিরক্ত। এ অবস্থায় ঋণের টাকা শোধ করতে না পারায় অনেক প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা খেলাপী হয়েছেন। উচ্চ সুদের কারণে খেলাপী ঋণের অঙ্ক শুধু বাড়ছেই। এই সঙ্কট উত্তরণে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ধরনের ঋণের বিপরীতে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর করার নির্দেশনা দিয়েছেন। একইভাবে ব্যাংকগুলোও যাতে ব্যবসা করে টিকে থাকতে পারে সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করার ঘোষণা দেন। জানা গেছে, ব্যাংক খাত শক্তিশালী রাখতে ইতোমধ্যে চলতি বাজেটে কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের আমানত বেসরকারী ব্যাংকে নিয়ে আসতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়েছে। ব্যাংকের আর্থিক গতিপ্রবাহ ঠিক রাখতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। সব ধরনের আমানতের সুদ হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া সরকারী অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দেশের বেসরকারী খাতে ব্যাংকগুলোতে আমানত হিসেবে রাখা হবে। এতে করে দেশের ব্যাংকিং খাতের তারল্য সঙ্কট আর থাকছে না। বেসরকারী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ঋণের বিপরীতে সিঙ্গেল ডিজিট অবশ্যই কার্যকর করতে হবে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে সরকারী অর্থের ৫০ শতাংশ আমানত বেসরকারী ব্যাংকগুলো পাবে। এক্ষেত্রে সুদের হার হবে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ পর্যন্ত। এতে করে দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। এদিকে, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) এবং পরিচালন বাজেটের আওতায় প্রাপ্ত অর্থ, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং সরকারী মালিকানাধীন কোম্পানির নিজস্ব তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যাংকিং ব্যবসায় নিয়োজিত বেসরকারী ব্যাংক অথবা অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান অথবা উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। সে প্রেক্ষিতে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, উল্লেখিত উৎসসমূহের উদ্বৃত্ত অর্থ সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ শতাংশ সুদ হারে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং মোট উদ্বৃত্ত অর্থের ৫০ ভাগ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদহারে বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকে মেয়াদী আমানত রাখা যাবে। তবে প্রতিষ্ঠানসমূহের ভবিষ্যত তহবিলের অর্থ, পেনশন তহবিলের অর্থ এবং এন্ডাউমেন্ট ফান্ডের অর্থ এর আওতাবহির্ভূত থাকবে।’ প্রসঙ্গত, আগামী ১ এপ্রিল থেকে সব ধরনের ব্যাংক ঋণে সুদ হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ এবং আমানতে সুদ হার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে ব্যাংক ব্যবসায়ের উদ্যোক্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ঋণের বিপরীতে সুদহার ৯ শতাংশ কার্যকর হবে। এর আগেও কয়েকবার সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকর করার ঘোষণা দিলেও আমলে নেয়নি বেসরকারী ব্যাংকগুলো। তবে এবার ঋণের বিপরীতে সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়ন না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করার ঘোষণা রয়েছে। এ কারণে আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ পর্যন্ত দেয়া হবে। যদিও বেশি আমানতের আশায় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন নামের অফার দিয়ে আসছে। মূলত সুদ বেশি দিয়েই ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করতে চায়। ভবিষ্যতে এ ধরনের অফার যেসব ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আরও জানান, ব্যাংকের সুদ হার বেঁধে দেয়ার পর আমানতকারীদের সবাই যাতে সরকারী ব্যাংকের দিকে ঝুঁকে না পড়েন, তা ঠেকাতে বেসরকারী ব্যাংকে ডিপোজিটে মুনাফা বেশি থাকবে। যদি সরকারী ও বেসরকারী উভয় ব্যাংকে ডিপোজিটের ক্ষেত্রে যদি সুদ হার ছয় শতাংশ করে দেয়া হয়, তাহলে সবাই সরকারী ব্যাংকে টাকা রাখবে। তাই সরকারী ব্যাংকে ডিপোজিটের সুদ হার হবে সাড়ে ৫ শতাংশ এবং বেসরকারী ব্যাংকে ডিপোজিটের ক্ষেত্রে সুদ হার হবে ৬ শতাংশ। এজন্য আমরা এক্ষেত্রে আধ শতাংশ পার্থক্য রাখছি। এর আগে ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল সরকারের নিজস্ব অর্থের ৫০ শতাংশ বেসরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখার বিধান রেখে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে ওই প্রজ্ঞাপনে আমানত রাখার ওপর সুদের হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। এমনকি সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকে সুদের পার্থক্যও রাখা হয়নি। নতুন প্রজ্ঞাপনে এগুলো স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এদিকে, সরকারের এই ঘোষণায় খুশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে কয়েক দফা সুদ কমানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছে। পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ থেকে বরাবরই ঋণের বিপরীতে উচ্চ হারের সুদ কমানোর বিষয়ে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে। সংগঠনটির সভাপতি রুবানা হক জনকণ্ঠকে বলেন, এত সুদ দিয়ে শিল্পায়ন করা সম্ভব নয়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে সহনীয় সুদহার কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা সিঙ্গেল ডিজিট সুদহারের কথা বলে আসছেন, কিন্তু তাদের এই দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। অথচ শিল্পায়নে সহজ শর্তে ও স্বল্পসুদের অর্থায়ন একটি জরুরী বিষয়।
×