ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৩২ বছর পর শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টার রায়

৫ পুলিশের ফাঁসি ॥ চট্টগ্রামে গণহত্যা মামলা

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ২১ জানুয়ারি ২০২০

৫ পুলিশের ফাঁসি ॥ চট্টগ্রামে গণহত্যা মামলা

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বহুল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলা’র রায় ঘোষিত হয়েছে সোমবার। রায়ে তৎকালীন ৫ পুলিশ সদস্যকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে (চার্জশীট হওয়ার পর এরা সকলেই চাকরিচ্যুত)। বিকেলে চট্টগ্রামের বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মোঃ ইসমাইল হোসেন এই রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত আসামিদের মধ্যে চারজন কারাগারে এবং একজন পলাতক রয়েছেন। রায় প্রদানকালে দ-িত ৪ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এ মামলায় অপর একটি ধারায় ৫ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর করে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি তৎকালীন ৮ দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার একটি বড় ধরনের টার্গেট ছিল বলে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পান। ঘটনাস্থল এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাণ হারান ২৪ আওয়ামী লীগ কর্মী। আদালত প্রাঙ্গণের পাদদেশে যাদের নামে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়ে আছে। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতরা হলেন সিএমপির কোতোয়ালি থানার তৎকালীন পেট্রোল ইন্সপেক্টর (পিআই) জেসি ম-ল (পলাতক), কনস্টেবল মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, শাহ মোঃ আবদুল্লাহ ও মমতাজ উদ্দিন। মামলায় চার্জশীটেড ছিলেন ৮ আসামি। তন্মধ্যে বিচার চলাকালীন তৎকালীন সিএমপি কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কনস্টেবল বশির উদ্দিন ও আবদুস ছালাম মারা গেছেন। মামলার বাদী এ্যাডভোকেট শহীদুল হুদাও প্রয়াত। উল্লেখ করা যেতে পারে, নানা প্রতিবন্ধকতায় থমকে গিয়েছিল এই মামলা। বিচারকাজ পড়েছিল দীর্ঘসূত্রতায়। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে এ মামলার দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। চট্টগ্রামের আইনজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করার তাগিদ দেন। আক্ষেপ করে চট্টগ্রামের আইনজীবী নেতা এ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলের সঙ্গে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ের ফলক উন্মোচনে ভিডিও কনফারেন্সে বলেছিলেন, ‘দুঃখ এ মামলার বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য বছর দুয়েক আগের। অবশেষে ৩২ বছর পর মামলার রায় প্রদান করা হলো। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাদীপক্ষের কৌঁসুলিরা। অপরদিকে, হতাশা ব্যক্ত করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীগণ। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্ধারিত জনসভা ভন্ডুল করতে নির্বিচারে গুলি চালালে এ ২৪ জন আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হন। সেদিন যা ঘটেছিল ৩২ বছর আগে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘি মাঠে সমাবেশের আয়োজন করে তৎকালীন ৮ দলীয় জোট। স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। জোটের এ সমাবেশ সফল করতে মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিলে মিছিলে যোগ দিতে থাকে তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। দুপুর হতেই লালদীঘি মাঠ এবং আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। প্রধান স্লোগান ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের পদত্যাগ। বিপুল লোক সমাগমে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে পুলিশ প্রশাসন, চলে গতিরোধের চেষ্টাও। বেলা ১টার দিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও ৮ দলীয় জোটনেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে গাড়িবহর বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন অতিক্রম করে আদালত ভবনের দিকে যাচ্ছিল। বহনকারী ট্রাকে ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ, যার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, এম এ মান্নান, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ। আদালত ভবনে প্রবেশের সড়কের কাছাকাছি যখন নেতৃবৃন্দকে বহনকারী ট্রাকটি আসে, ঠিক তখনই সিএমপির তৎকালীন কমিশনার রকিবুল হুদার ওয়াকিটকিযোগে প্রদত্ত নির্দেশে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের পক্ষে চালানো হয় এলোপাতাড়ি গুলি। প্রতিক্রিয়ায় লালদীঘি ও সংলগ্ন এলাকায় বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রক্তাক্ত অসংখ্য দেহ লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়। নারকীয় এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৪ আওয়ামী লীগ কর্মী। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন আরও দুই শতাধিক। নৃশংসতা এখানেই শেষ নয়, কোন মৃতদেহই প্রদান করা হয়নি স্বজনদের কাছে। সবগুলো দেহ বলুয়ারদীঘি শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয় (হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে)। লালদীঘিতে শেখ হাসিনার জনসভায় পুলিশের গুলিবর্ষণে যারা নিহত হন তারা হলেন মোঃ হাসান মুরাদ, মহিউদ্দিন শামীম, স্বপন কুমার বিশ^াস, এলবার্ট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, ডিকে চৌধুরী, সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বিকে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাশেম মিয়া, মোঃ কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ ও শাহাদাত। বেপরোয়া গুলি যখন চলতে থাকে তখন পড়ে যায় হুড়োহুড়ি। নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনা ও জোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে রক্ষার চেষ্টা করেন। একটি হত্যাপ্রচেষ্টা থেকে রক্ষা পান তিনি। ঘটনাটি সারাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। এ ঘটনার পর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। তবে এ ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে মামলা দায়ের করা যায়নি। দীর্ঘসূত্রতায় ছিল বিচার প্রক্রিয়া ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ মামলা দায়ের করেন আইনজীবী মোঃ শহীদুল হুদা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসীন থাকার কারণে সে মামলাটি গতি পায়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর চাঞ্চল্যকর এ মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। আদালতের আদেশে সিআইডি মামলাটির তদন্ত করে ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম চার্জশীট দাখিল করে। এরপর অধিকতর তদন্ত শেষে দ্বিতীয় দফায় চার্জশীট দাখিল হয় ১৯৯৮ সালের ৩ নবেম্বর। এতে সিএমপির তৎকালীন কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদাসহ মোট ৮ পুলিশ সদস্যকে আসামি করা হয়। বাকি ৭ আসামি হলেন সিএমপি কোতোয়ালি জোনের পেট্রোল ইন্সপেক্টর জে. সি ম-ল, কনস্টেবল আবদুস সালাম, মুশফিকুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, বশির উদ্দিন, মোঃ আবদুল্লাহ এবং মমতাজ উদ্দিন। ২০০২ সালের ৯ মে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে শুরু হয় বিচার কাজ। চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালতের পিপি মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী জানান, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদার নির্দেশে জেসি ম-ল তার নিয়ন্ত্রিত পুলিশ সদস্যদের দিয়ে পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। মামলার চার্জশীট ও যুক্তিতর্কে বেরিয়ে এসেছে তার প্রমাণ। আলোচিত এ মামলায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ড. অনুপম সেন, সাংবাদিক অঞ্জন কুমার সেন, হেলাল উদ্দীন চৌধুরী, আইনজীবী সুভাষ চন্দ্র লালা, অশোক কুমার বিশ্বাস, হাসনা বানু, মাঈনুদ্দিন, আবু সৈয়দসহ মোট ৫৩ জন। গত রবিবার হয় বাদীপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি। সোমবার আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানির তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু আসামিপক্ষের কৌঁসুলিরা শুনানিতে অসম্মতি জানালে বিকেলেই রায় ঘোষণার সময় নির্ধারিত হয় এবং বিকেল ৩টার দিকে বিচারক ইসমাইল হোসেন মামলার রায়ের চৌম্বক অংশ পড়ে শোনান। আদালতের বাইরে ও ভেতরে কৌতূহল সোমবার সকালে আদালতের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ঘোষণা করা হয় যে বিকেলে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। আদালতের ভেতরে এবং বাইরে সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে সর্বত্র কৌতূহল সৃষ্টি হয়। বিকেলের আগেই বিভিন্ন মিডিয়া, গোয়েন্দা সংস্থা, আগ্রহী আইনজীবী, আওয়ামী ও অঙ্গসংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ ভিড় জমাতে শুরু করেন। রায় ঘোষণার আগেই এজলাশের বাইরে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সকলের মনে কৌতূহল ছিল ৩২ বছর আগের চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় কী হতে যাচ্ছে। আসামিদের মধ্যে ৪ জনকে কাঠগড়ায় আনা হয়। একজন অর্থাৎ জেসি মন্ডল মামলার চার্জশীট হওয়ার পর থেকে পলাতক রয়েছেন। সোমবারও তার উপস্থিতি ছিল না। রায় ঘোষিত হওয়ার পর ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ স্লোগান দেন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা। মামলার বাদীপক্ষের কৌঁসুলি এ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলেন, লালদীঘি মাঠের এই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচারকাজ নানাভাবে দফায় দফায় বন্ধ করা হয়েছে। ২৪ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী সরকার চায়নি এ হত্যাকান্ডের বিচার হোক। অবশেষে ৩২ বছর পর বিচার পেয়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি।
×