ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের আংশিক পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ২১ জানুয়ারি ২০২০

 পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের আংশিক পর্যবেক্ষণ

(গতকালের পর) পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এরূপ ভয়াবহ ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকারের পতন হলে সঙ্গত কারণেই লাভ/ক্ষতির হিসাব বিবেচনার দাবি রাখে। সরকার চলমান থাকলে এবং নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে কারা বা কোন গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হতো? তাহলে কি সরকার পতনে যাদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তারাই এরূপ ভয়াবহ ঘটনার পিছনে ছিল? গবেষণা ও বিশ্লেষণ দেখা যায় বিডিআর বিদ্রোহে সরকার পতন হলে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের লাভবান হওয়ার বিষয়টিই স্পষ্টভাবে সর্বাগ্রে দৃশ্যপটে চলে আসে। মামলায় সংরক্ষিত প্রাসঙ্গিক দলিলাদি পরীক্ষাসহ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা’ খোঁজ করলে এরূপ একটি নির্মম চিত্র পরিস্ফুটিত হয়। ঘটনার পিছনের ঘটনা উদঘাটনে তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ তদন্তে মনোনিবেশ না করায় মামলার তদন্ত সঠিক হয়নি একথা আইনের দৃষ্টিতে বলা যায় না, কারণ দেশের প্রচলিত প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক আইনসহ মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য, ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মামলার তদন্ত ও বিচারিককার্য সম্পাদনে আইনের কোন ব্যত্যয় ঘটেছে একথা বলা যায় না। উচ্চ আদালতে নিষ্পত্তিকৃত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে হত্যা মামলা, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দ্রিরা গান্ধী হত্যা মামলা, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমান রাজিব গান্ধী হত্যা মামলাসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তে ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা তদন্তের মাধ্যমে বিচারামলে বা দৃশ্যপটে আসেনি। কেবলমাত্র যারা সরাসরি ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং সাক্ষ্য দ্বারা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে, কেবল তারা অভিযুক্ত হয়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে এবং অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তারা সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। সুতরাং ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা তদন্তে উদঘাটিত না হওয়ায় তদন্ত আইনানুগ হয়নি বা তা ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান মতে তদন্ত সঠিক হয়নি বা অন্য কোনভাবে আইনের ব্যত্যয় ঘটেছে, আপীলকারী পক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলিগণের এরূপ বক্তব্য যৌক্তিক, নৈতিক বা আইনানুগ ভাবে গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণে সরাসরি নাকচ করেছেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা সম্পর্কে আপীলকারীগণের কৌঁসুলির বক্তব্যের সঙ্গে আদালতের দ্বিমত পোষণ করার সঙ্গত কোন কারণ নেই। বাংলাদেশ রাইফেলসের বার্ষিক কুচকাওয়াজে প্রজাতন্ত্রের প্রধান নির্বাহী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। অনুরূপ অবস্থায় বাংলাদেশ রাইফেলসের জঝট নামে একটি নিরাপত্তা ইউনিট থাকা সত্ত্বেও তারা বিদ্রোহের ষড়যন্ত্রের কোন পূর্বাভাস দেয়নি অথবা জঝট স্বেচ্ছায় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিভাগীয়ভাবে উক্ত ব্যর্থতার ঘটনা উদঘাটনসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি অগ্রহণযোগ্য নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন রাষ্ট্রীয় বা অন্য যে কোন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন তখন যাতায়াতসহ অনুষ্ঠান স্থলে নিñিদ্র ও কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলাসহ শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের যে সকল সংস্থা পালন করে থাকে তাদের ব্যর্থতা থাকলে আইনের নির্দেশনা অবজ্ঞা করার সুযোগ আইন অনুমোদন করে না। সে কারণ দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দেশের প্রচলিত আইনই নির্দেশ করে। কারণ তাদের অবহেলা, অমনোযোগিতা, কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা এবং অযোগ্যতার কারণে এদেশের সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে গড়ে ওঠা ৫৭ জন নিরস্ত্র সামরিক কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন মানুষকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছে যা কোন অবস্থায় কাক্সিক্ষত নয়। উল্লিখিত পর্যালোচনার আলোকে উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘ঘটনার পিছনের ঘটনা’ উদঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে আইনসম্মতভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে এই মামলাসহ জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মামলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার দৃষ্টান্ত বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকীর পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্ত, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিবেচনায় পিলখানা হত্যা মামলাটি রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ফৌজদারি মামলা। প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় সংবিধানসম্মতভাবে আইনের শাসন সমুন্নত রাখা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে মামলাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় এই মামলায় প্রদত্ত রায়কে প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সর্বস্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ভবিষ্যতের জন্য একটি নির্মোহ দৃষ্টান্ত হিসেবে মন্তব্য করেছেন। রায়ে পবিত্র কোরআনসহ খ্যাতিমান দার্শনিকদের উদ্ধৃতির আংশিক তিনি পর্যবেক্ষণে বলেছেন, পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ৯৩ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, ‘ওয়ামাই ইয়াকতুল মু’মিনাম মুতাআম্মিদান ফাজাঝাউহু জাহান্নামু খালিদান ফিহা, ওয়া গাদিবাল্লাহু আলাইহি ওয়া লা আনাহু ওয়া আয়া’দ্দা লাহু আজাবান আযিমা’ অর্থ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন ইমানদারকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, সে চিরকাল সেখানেই থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’ হাদিসে এসেছে, ওহুদের যুদ্ধ চলাকালে একজন মুসলমান অপর এক মুসলমানকে ব্যক্তিগত শত্রুতার জের হিসেবে হত্যা করে। আমাদের মহানবী রাসূলে করিম (সা.) ওহীর মাধ্যমে এ সম্পর্কে অবহিত হন এবং যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে হত্যাকারীকে কিসাস করার অর্থাৎ অনুরূপ শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেন এবং তার ক্ষমা প্রার্থনাও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।’ পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারার ১৭৯ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- ওয়ালাকুম ফিল কিসাসি হায়াতুই ইয়া উলিল কাল্বাব।’ অর্থ হচ্ছে, ‘হে বুদ্ধিমানগণ কিসাসের মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা সাবধান হতে পার।’ অনেকে কিসাসের আইনের প্রভাবের দিকে লক্ষ্য না করে প্রশ্ন করে যে, হত্যাকারীকে হত্যার ফলে কি নিহত মানুষ জীবিত হবে? এবং কিসাসের ফলে আরেকজন মানুষকেই তো হত্যা করা হলো, এই প্রশ্ন সমকালীন বিশ্বে মানবাধিকারের নামে আলোচিত হচ্ছে। পবিত্র কোরআনে এ সকল প্রশ্নের জবাবে একটি মৌলিক দিকের কথা উল্লেখ করেছে যে, মানুষের জীবন ন্যায় বিচার ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব নয়। আর এ দুটি বিষয় প্রতিষ্ঠার জন্য হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। যেমনটি কোন ব্যক্তির সুস্থতার জন্য শরীরের কোন পচনশীল অংশ কেটে ফেলা জরুরী। মূলত কিসাসের বিধান ব্যক্তিগত প্রতিশোধের চেয়ে সামাজিক নিরাপত্তার জন্যই বেশি জরুরী। সূরা মায়েদার ৪৫নং আয়াতে বলা হয়েছে; ‘ওয়া কাতাবনা আলাইহিম ফিহা আন্নান নাফসা বিন নাফসি ওয়াল আইনা বিল আইনী ওয়াল আনফা বিল আনফি ওয়াল উজুনা বিল উজুনি ওয়াস সিন্না বিস সিন্নি ওয়াল জুরুহা ক্বিসাস, ফামান তাসাদ্দাকা বিহি ফাহুয়া কাফফারাতুল্লাহ, ওয়ামাল লাম ইয়াহকুম বিমা আনযালাল্লাহু ফা উলাইকা হুমুয যালিমুন’ অর্থ হচ্ছে, আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং যখমসমূহের সমান যখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম। অবশ্য হত্যার মতো অপরাধে জড়িত ব্যক্তির মতো অপরাধীদেরও সমাজের জন্য ক্ষতিকর না হলে অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া একটি পছন্দনীয় কাজ। তাই পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেছেন যারাই কিসাস বা প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অপরাধীকে ক্ষমা করবে, মহান আল্লাহও তাদের পাপ ক্ষমা করবেন। এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার : (১) আইনের দৃষ্টিতে জাতি,ধর্ম, জ্ঞানী,মূর্খ ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষ সব মানুষই সমান। (২) কিসাসের বিধান শুধু ইসলাম ধর্মেরই নিজস্ব বিধান নয়, হযরত মূসা (আঃ) এর যুগ থেকে এ বিধান প্রচলিত হয়েছে এবং এখনও তা অব্যাহত রয়েছে। (৩) শুধু অর্থ-সম্পদ দান করাই সদকা নয়, অন্যদের ভুল ও অপরাধ ক্ষমা করাও এক ধরনের সদকা। (৪) ইসলাম অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও কঠোরতার পাশাপাশি দয়া ও অনুগ্রহও দেখায়। (৫) কারাদন্ড ও অর্থদন্ড বা জরিমানা অবৈধ হত্যাকান্ডের মতো অপরাধের চালিকা শক্তিগুলোকে প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই হত্যার বিনিময়ে। মৃত্যুদন্ডের বিধান সমাজের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জরুরী। পর্যবেক্ষণে প্রখ্যাত মনীষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বিচারকের কেবলমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে, অপরাধ তথা অপরাধীকে শনাক্ত করা; শাস্তির প্রসঙ্গটি আইনের বিষয় এবং আইনই শাস্তি নির্ধারণ করে থাকে।’ লর্ড হিউওয়ার্টের মতে ‘ন্যায় বিচার শুধু করলেই চলবে না, ন্যায় বিচার যে করা হয়েছে তা প্রতীয়মান হওয়া চাই।’ সেন্ট এ্যাকুইনাসের মতে, ‘বিচার পরিচালনার কার্যে বিচারকের নিরপেক্ষ ভূমিকা যেমন ন্যায় বিচারের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়, তেমনি বিচারকের রায় আইনসম্মত পদ্ধতিতে গৃহীত হয়েছে বলেও প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক। প্রতিহিংসা কিংবা পক্ষপাতিত্ব যেন বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বিনষ্ট করে। দ-ের সঙ্গে, দ- দাতা কাঁদে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।’ অপরাধ বিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব নিয়ে ফ্রাঞ্জ আলেকজান্ডার তার গবেষণায় বলেছে, ‘পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষই জন্মগত অপরাধী। মূলত পৃথিবীতে মানুষের আগমন ঘটে অপরাধী হিসেবে, এটাই তার অনিবার্য নিয়তি। জন্মের পর শিশুর ভিতর আদিম ও সহজাত প্রবৃত্তিগুলো কার্যকর থাকে, শুধুই নিজের সুখ ও আত্মতৃপ্তি খুঁজে ফিরে সে, পরিহার করতে চায় দুঃখকে। চার থেকে ছয় বছরের শিশুর মধ্যে সামাজিক নৈতিকতার পটভূমি তৈরি হয়, ফলে সে ভাল-মন্দ অথবা অপরাধী ও নিরপরাধী সম্পর্কিত ধারণা লাভ করতে থাকে।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ চলবে... লেখক : হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি
×