ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্মৃতির পাতায় বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ১৮ জানুয়ারি ২০২০

 স্মৃতির পাতায় বঙ্গবন্ধু

(গতকালের পর) ॥ পাঁচ ॥ আমি তখনও বরিশালে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার এবারের সাক্ষাতটা খুব একটা সুখকর ছিল না। আমি বৃহত্তর বরিশালের দায়িত্বে। আর্মস রিকভারির উদ্দেশ্যে আমার টু-আই-সি এক মেজরকে এক কোম্পানি সৈন্যসহ পটুয়াখালী অঞ্চলে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। আর্মস রিকভারি একটি দুরূহ কাজ। কারণ, কেউ তার হাতে থাকা অস্ত্র জমা দিতে চায় না। যেহেতু স্বেচ্ছায় কেউ অস্ত্র জমা দেয় না, সে কারণে তা উদ্ধার করার জন্য মাঝে মধ্যে উদ্ধারকারীরা থার্ড ডিগ্রী মেথড এ্যাপ্লাই করে থাকেন। তখন সমগ্র বরিশালে সর্বহারা, গণবাহিনীর তৎপরতা ছিল। এক কথায় নানা ধরনের অপরাধীদের অভয়াশ্রম ছিল অঞ্চলটি। এদের তৎপরতায় সাধারণ মানুষ ছিল অতিষ্ঠ ও আতঙ্কগ্রস্ত। এ অবস্থায় আর্মস রিকভারি করতে গিয়ে পটুয়াখালীতে ট্রুুপসদের ভূমিকায় কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিস্তারিত জানতে আমাকে গণভবনে তলব করা হয়। সেদিন গণভবনে উপস্থিত ছিলেন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ, একজন মন্ত্রী ও কয়েকজন নেতা। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে বিস্তারিত শুনলেন। কিছুক্ষণ শোনার পর দীর্ঘায়িত না করে বঙ্গবন্ধু অন্যদের বললেন, তোমরা যাও, আমি বিষয়টি দেখছি। আমাকে বললেন, তুই বস। তোর সঙ্গে কথা আছে। সবাই চলে যাবার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, বাসায় চল। আমি প্রথমে তাঁর কথা বুঝতে পারিনি। পরে তাঁর পেছনে পেছনে এলে তিনি বললেন, গাড়িতে ওঠ। ছোট্ট একটি গাড়ি। গাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কষ্ট হচ্ছিল। আমি গাড়িতে বসে বঙ্গবন্ধুকে বললাম স্যার, আপনি এত ছোট্ট গাড়ি ব্যবহার করছেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, বড় গাড়িতে তেল খরচ বেশি হয়। দেখতেই তো পারছিস, দেশে তেল সঙ্কট চলছে। আমি বললাম, স্যার আপনি একা সাশ্রয় করলেই কি হবে? তিনি বললেন, আমার দেখাদেখি দেখিস অনেকেই তা করবে। আমাকে অনুসরণ করবে। তিনি আমাকে নিয়ে এলেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। বাসার তৃতীয় তলায় বসার জায়গায় বসতে বললেন। এই বাড়িতে আমার এই প্রথম আসা। মিনিট কয়েক পর বঙ্গবন্ধু এলেন। আমাকে দু-একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার পর তিনি প্রসঙ্গ আনলেন বরিশালের পরিস্থিতি নিয়ে। আবারও জানতে চাইলেন বৃহত্তর বরিশালে সর্বহারা ও গণবাহিনীর তৎপরতা এবং তাদের কাছে অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে। আমি তাঁকে বললাম, সেনাবাহিনী মাঠে নামার পর গণবাহিনী এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। আর সর্বহারারা অস্ত্রসহ আত্মগোপনে। তারপরও আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি আমাকে এই বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিলেন। সেদিন আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বাসায় চলে আসি। ॥ ছয় ॥ সালটা ১৯৭৫, প্রথম দিকের কথা। বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম সফরে এলেন। আমি তখন বিডিআর-এর সেক্টর কমান্ডার। বঙ্গবন্ধু ভিজিটে আসায় আমাকে সেখানে যেতে হলো। বিকেলে তিনি হিমছড়িতে গেলেন। সেখানে ঝাউগাছ বেষ্টিত বাগানে বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে গল্প করছিলেন। আমি কাছাকাছিই বসেছিলাম। নানা কথার মাঝে বঙ্গবন্ধু এক পর্যায়ে আক্ষেপ করে তাঁর মন্ত্রিসভার এক সিনিয়র মন্ত্রীকে বললেন, দেখ...‘পরশ্রীকাতরতা’ শব্দটি একমাত্র আমাদের বাংলা ডিকশনারিতেই আছে। আর কোন ভাষার অভিধানে নেই। উল্লেখ্য, ওই মন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য কারও বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। কথাটি আজও আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। সেদিনের আরেকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। বঙ্গবন্ধু আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বললেন, শোন, আইয়ুব খানের আমলে আমি যখন হুলিয়া নিয়ে দেশের নানা স্থানে ঘুরে বেড়াই, তখন এই পাহাড়ের পূর্বদিকে এক চৌকিদারের ঝুপড়ি ঘরে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ডিসিকে উদ্দেশ করে বললেন, দেখ তো তাঁকে খুঁজে বের করা যায় কিনা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে আনা হলো। তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কথা বললেন এবং ডিসিকে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দিলেন তার জন্য কিছু খাস জমির ব্যবস্থা করার জন্য। ॥ সাত ॥ ৬ জুলাই ১৯৭৫। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে দ্বিতীয়বার যাওয়া। আমি তখন চট্টগ্রামে বিডিআরের সেক্টর কমান্ডার। ঢাকায় হেড কোয়ার্টারে এসেছিলাম একটি কাজে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল। এক পর্যায়ে সুযোগও পেলাম। আমি আর বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাসায় তৃতীয় তলায় দক্ষিণের বারান্দায় বসে কথা বলছি। বঙ্গবন্ধু দেশের পরিস্থিতির পাশাপাশি আমার কাছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার (বার্মা) সীমান্তের চোরাচালান সংক্রান্ত বিষয়াদি জানতে চাইলেন। আমি যেহেতু ওই অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার তাই আমাকে তিনি কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। সাক্ষাতের এক পর্যায়ে শেখ কামাল এলেন। সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে তার সঙ্গে আমার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুকে সেদিন খুব বিষণœ মনে হয়েছিল। তাঁকে চিন্তিত মনে হয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ের কথাবার্তায় কখনও মনে হয়নি আমি একজন রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলছি। আসার সময় তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘ভাল থাকিস।’ সেই দেখাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই ভূখ-ে জন্মগ্রহণ করেছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া নামক এক অজপাড়াগাঁয়ে। তারপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা হয়েছেন। হয়েছেন ইতিহাসের মহানায়ক, সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে ছিলেন খাঁটি বাঙালী। তাঁর চলনে বলনে বেশভূষায় বাঙালিত্বের ছাপই লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণ জীবন যাপনে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। তাঁর মতো সাহসী রাজনীতিবিদ ইতিহাসে খুবই কম। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও দেশপ্রেমে অটল ছিলেন তিনি। ছিলেন আপোসহীন ও নির্ভীক। দু’বার ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি ছিলেন দূরদর্শী, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে। এদিন তিনি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এড়িয়ে গিয়ে এমন বক্তব্য দিলেন, যা স্বাধীনতার ঘোষণারই শামিল। মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতেন, যার প্রমাণ আমি নিজেও। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। হিমছড়ির সেই চৌকিদারের কথা নামসহ মনে রাখা এবং তাকে সহায়তা এর বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে। বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতি তিনি ছিলেন উদার। তাঁর কূটনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে অল্পসময়ে সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে পৃথিবীর বহু দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের কারণেই স্বাধীনতার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা বিরল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালে। অথচ আজও বিদেশী সৈন্য রয়ে গেছে জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন্স, জাপানসহ পৃথিবীর বহু দেশে। শুধু তাই নয়, দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ প্রক্রিয়াটিও হয়েছিল তাঁরই ব্যক্তিত্বের কারণে। এই গুণের কারণে বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে হয়ে উঠেছিলেন জাতির প্রতীক। স্কুল জীবন থেকেই ধাপে ধাপে এ পর্যায়ে এসেছেন তিনি। হঠাৎ করে নেতা হননি বা ক্ষমতায় আসেননি তিনি। বড় নেতা তারাই যারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বড় হতে থাকেন। তাদের হত্যা করে সমাজ থেকে নির্বাসিত করা যায় না। তারা বারবার ফিরে আসেন। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মা গান্ধীকেও কূচক্রীরা হত্যা করেছে, কিন্তু ইতিহাস থেকে মুছতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকেও বাঙালীর ইতিহাস থেকে মুছে দিতে কম চেষ্টা হয়নি, কিন্তু পারেনি। আসলে ইতিহাস কারও নির্দেশে রচিত হয় না। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতেই চলে। ইতিহাসের সত্য রক্ষার খাতিরে ইতিহাসই বঙ্গবন্ধুকে ধরে রাখবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর দ্বারপ্রান্তে আমরা। জাতির পিতা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি। আমি আজ সৌভাগ্যবান ও গর্বিত যে, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থন নিয়ে পরপর তিনবার কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি ও মেঘনা) আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে প্রধানমন্ত্রীর পাশে কাজ করছি। আমি গর্বিত একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আশ্রয় পেয়েছি। আমি জীবনের শেষ দিনটিও যেন আওয়ামী লীগ ও দেশবাসীর জন্য আত্ম-উৎসর্গ করতে পারিÑআল্লাহর দরবারে এই ফরিয়াদ আমার। (সমাপ্ত) লেখক : সংসদ সদস্য, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি
×