ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোরসালিন মিজান

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

বাঙালীর বারো মাসে, একটু কম করে ধরলেও, তেরো পার্বণ। কিন্তু নির্বাচন? নির্বাচনও কি এসব উৎসব পার্বণের মধ্যে পড়ে? বর্তমান ঢাকা, খেয়াল করুন, তা-ই বলছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘিরে এখন শহরজুড়ে উৎসব। মেয়রপ্রার্থীদের প্রচারে শীত মোটামুটি পালিয়েছে। ভোট উৎসবে মেতেছে অলিগলি রাজপথ। যেদিকে চোখ যায়, পোস্টার। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অসংখ্য পোস্টারে ঢাকা পড়েছে রাজধানী। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলছে স্লোগান। মাইকে গান হচ্ছে। গানে গানেও চলছে ভোট প্রার্থনা। নিজ নিজ প্রার্থীর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার পাশাপাশি বাহাসও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরস্পর বিরোধীদের বক্তব্য উত্তাপ ছড়াচ্ছে কখনও কখনও। এভাবে বেশ জমে উঠেছে সিটি ভোটের প্রচার। মেয়র প্রার্থীরা মাইলের পর মাইল হাঁটছেন। সাধারণ নাগরিকদের বুকে জড়িয়ে ধরছেন তারা। পথচারীরাও হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এবারের নির্বাচনে আগেভাগে আলোচনায় এসেছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলাম। প্রচার চালাতে চালাতে টং দোকানে ঢুকে পড়ছেন তিনি। সেখানে বসে নিজ হাতে চা বানাচ্ছেন। একে ওকে চা করে খাওয়াচ্ছেন। দুপুরে পেটে ক্ষুধা নিয়ে ঢুকে পড়ছেন যে সে রেস্তরাঁয়। খেতে খেতেই অন্যদের পাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন মেয়রপ্রার্থী। অনভ্যস্থ চোখে আতিকুল ইসলামের এমন কর্মকা- দেখে নিন্দুকেরা বলছেন, ভোটের জন্য, বুঝি বুঝি, লোকে এমন অনেক কিছুই করে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রপ্রার্থী আতিকুল ইসলামও তা-ই করে চলেছেন। নির্বাচনে পাস করে আসুক সব ভুলে যাবেন। এমন আরও নানা আলোচনায় সামনে থাকা আতিকুল ইসলামকে অনুসরণ করার সুযোগ হয়েছিল গত বুধবার। এদিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এসেছিলেন তেজগাঁওয়ে। নৌকার পক্ষে প্রচার চালানোর পাশাপাশি খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের ভোটারদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। একটি চাইনিজ রেস্তরাঁয় আয়োজিত সভায় আতিক জোর দিয়েই বলছিলেন, ঢাকা শহর হবে সবার। সকল সম্প্রদায়ের মানুষের হবে। মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান সবাইকে নিয়ে সবার ঢাকা কল্পনা করি আমি। আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। তখন তাকে নিয়ে নানা আলোচনার কথা তুলে ধরা হলে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জবাব দেন তিনি। পূর্বের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘সবাই মিলে সবার ঢাকা’ আমার স্লোগান। আমার কাছে ঢাকা শহর চা ওয়ালারও। তাই চা দোকানে বসে চা বানাতে আমার বাধেনি। তাছাড়া আমি সব সময়ই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে থাকতে চেয়েছি। ‘জাত গেল জাত গেল’ সমস্যা থেকে আমি ইনশাআল্লাহ মুক্ত। আমার গার্মেন্টস কর্মীদের সঙ্গে মেঝেতে বসে লাঞ্চ করি আমি। আর মেয়র থাকাকালীন সময়ও তো আামি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে কাটাইনি। এমনকি নিজ হাতে ড্রেন পরিষ্কার করে, রাস্তার পাশ থেকে ময়লা কুড়িয়ে পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সকলকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি। আমাকে যারা চেনেন তারা এভাবে মাঠে নামা দেখে অবাক হননি। হচ্ছেন না। যারা কম চেনেন তারাও ক্রমে চিনবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। কথার এ পর্যায়ে আবারও প্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আতিক। দ্বিতীয় দফায় তাকে পাওয়া যায় বনানীর নির্বাচনী ক্যাম্পে। সেখানে প্রবেশ করে দেখা যায় মধ্যরাতেও গমগম করছে অফিস। পুরনো একটি ভবনে অনেক কক্ষ। সবটিতেই নেতাকর্মী। একদল মুক্তিযোদ্ধা পরিবেষ্টিত হয়ে বসে ছিলেন আতিকুল ইসলাম। এরই মাঝে একটি টেলিভিশনের টকশোতে তাকে যুক্ত করা হয়। সরাসরি অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে তিনি সরস্বতী পূজার দিনে নির্বাচন না করার আবেদন জানান। আতিক বলছিলেন, আজকের বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার। সব ধর্মের মানুষকে তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিতে হবে। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে নির্বাচন কমিশনের কাছে ভোটের তারিখ পরিবর্তনের আবেদন জানাই। এরপর আবারও সেই চা বানানোর গল্প। টেলিভিশনের উপস্থাপিকা এ প্রসঙ্গ তুললে আতিক বলেন, আমরা সবাই তো একটু চা পান করতে করতে গল্প আড্ডা জমাই। এটা তো আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিরও অংশ...। কথা শেষ হতে না হতেই উপস্থাপিকার পাল্টা প্রশ্ন: আপনি তো শহর ঢাকার মেয়র হতে চান। গ্রামীণ ঐতিহ্য মেনে চা বানানোর দক্ষতা অর্জন করলেও তা দিয়ে ঢাকার কী লাভ হবে? এ প্রশ্নেরও উত্তর দেন আতিক। টেলিভিশন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর একই প্রসঙ্গ তুলে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, গ্রামীণ ঐতিহ্যই তো আমাদের শক্তি। অথচ আমার কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে, এ শক্তি দিয়ে শহর ঢাকার কী লাভ হবে? গ্রামীণ ঐতিহ্য বুকে লালন করে শহর ঢাকার মেয়র হওয়া যাবে না? আপনার কি মনে হয়? মেয়রপ্রার্থীর পাল্টা প্রশ্ন। কিছুটা সান্ত¦না খোঁজার চেষ্টা করে তিনি বলেন, আমি কারও কথায় মাইন্ড করি না। জনপ্রতিনিধি হলে মন খোলা রাখতে হবে। পরদিন বৃহস্পতিবার আতিকুল ইসলামের একটি পুরনো ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, এক নিকটাত্মীয়ের বিয়েতে অতিথিদের নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করছেন তিনি। ছবিটি দেখিয়ে তার সমর্থকরা বলছেন, এই হচ্ছেন আতিক। ঘরে যেমন, বাইরেও। আন্তরিকতা থাকলে একজন মেয়রও সাধারণ মানুষকে চা করে খাওয়াতে পারেন বলে উল্লেখ করেন তারা। এদিকে আতিকুলে বিপরীতে রয়েছেন বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়াল। তিনিও প্রচারে ব্যস্ত। উত্তরের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। নাগরিকদের বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চাইছেন। একইসঙ্গে তাবিথ অভিযোগও করছেন ঘন ঘন। ঘোরতর অভিযোগ আছে তার নিজের বিরুদ্ধেও। ঘুরে ফিরেই আসছে পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির কথা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিদেশে অর্থপাচারের তথ্য ফাঁস করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল পানামা পেপার্স। সেখানে নাম ছিল তাবিথ আউয়াল ও তার পরিবারের একাধিক সদস্যের। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার মুখে তাকে পড়তে হচ্ছে। তবে জবাব তেমন দিচ্ছেন না। বলছেন, নির্বাচনী নীতিমালার কারণে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলবেন না। উত্তরের মতো ঢাকার দক্ষিণেও চলছে ভোট উৎসব। আরেকদিন দক্ষিণের কথা হবে। সে পর্যন্ত উৎসব উৎসব হয়েই থাকুক। যোগ্য মেয়র ও কাউন্সিলর খুঁজে পাক রাজধানী ঢাকা।
×