ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

মুজিববর্ষ ও উন্নয়নের বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:১২, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

মুজিববর্ষ ও উন্নয়নের বাংলাদেশ

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিগত ৮ জানুয়ারি, ২০২০ সালে ’৭৫ পরবর্তী সময়ে চতুর্থবারের মতো সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ভাষণে বলেছিলেন : আগামী ১৭ মার্চ, ২০২০ইং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালনের অংশ হিসেবে এই তারিখে বর্ণাট্য উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সূচনা হবে। সরকার ইতোমধ্যেই ২০২০-২০২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী তথা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠানমালা যুগপৎভাবে চলতে থাকবে। এই উৎসবের লক্ষ্য জাতীয় জীবনে নতুন জীবনী শক্তি সঞ্চারিত করা, জাতিকে নতুন মন্ত্রে দীক্ষিত করা এবং সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় একধাপ এগিয়ে যাওয়া, যার টার্গেট সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে অধিষ্ঠিত তার সরকারের প্রধান কর্মসূচীগুলো ছিল দারিদ্র্য/প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু করা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ফেরা, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ইত্যাদি। আবার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর দেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছে, যা পরবর্তীতে ২০১৪ এবং ২০১৯ নির্বাচনে জয়লাভের পর অব্যাহত রয়েছে। যেমনÑ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮.৩ শতাংশ, দারিদ্র্য হার ২১.৮ শতাংশ, মাথাপিছু আয় (২০১৮) বেড়েছে ১৯০৯ মার্কিন ডলার, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ নিচে, শিশুমৃত্যুর হার ১২ জন, মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১০৫, নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষার হার শতকরা ৭৩ ভাগ, গড় আয়ু ৭২ বছর, চাল উৎপাদনে বিশ্বের ৪র্থ স্থান, মাছ ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থান ইত্যাদি যা দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও উন্নত দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান দিয়েছে। রূপকল্প ২০২১ অনুসারে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হবে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে যাওয়ার স্বপ্ন রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি যথা গণতন্ত্র, সামাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক কাঠামো অর্থাৎ জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ, যা নোবেল বিজয়ী বাঙালী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য কুমার সেন ও জার্মান অর্থনীতিবিদ রিচার্ড এইচ যাপারের মানবিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর সমাজকল্যাণ ধারণার সম্প্রসারিত রূপ হলোÑ সম্পদের সুষম বণ্টন ও সম্পদ সৃষ্টি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষায় বিনিয়োগ, কৃষি ও শিক্ষার সংস্কার ও গণমুখী বাধ্যতামূলক সমবায় প্রতিষ্ঠা। তার মূলভিত্তি ছিল সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিক উন্নয়নের মাধ্যমে মাটি ও মানুষের সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ১৯৭২ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট জাতির জনককে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার শক্তি কোথায় এবং এর জবাবটি ছিলÑ আমি আমার জনগণকে খুব ভালবাসি, তারপর আমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও আত্মীয়স্বজন। তারই উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশের রাজনীতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী, আদর্শিক নেতাকর্মীদের ভরসা, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক নীতিকে ধরেই ধারাবাহিকভাবে সফল রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তার বদৌলতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৩৩তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশ যার জিডিপি আকার ২০১৯ সালে ৩১৭.৪৭৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটের আকার পূর্বের চেয়ে সাড়ে আটগুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) আকার দাঁড়ায় ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকায় যার ৯০ ভাগই বাস্তবায়ন হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে। এরই মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষের ঘরে বিদ্যুত ও ৯৭ শতাংশ মানুষ উন্নত স্যানিটেশনের আওতায় এসেছে। ৮৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় রয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১১ বছরে এই সরকারের আমলে স্বাস্থ্যসেবার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, যা মানবিকতার স্বাক্ষর। শিক্ষার ক্ষেত্রেও এসেছে গতিশীলতা। যেমন প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষায় উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ও এমপিওভুক্তকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা, গৃহদান, সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দান ইত্যাদি। এই ধরনের সাহসী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ার মতো উৎসাহ তিনি পেয়েছেন পিতার কাছ থেকে। বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্রও বটে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে সমুদ্র বিজয়, ছিটমহল সমস্যার সমাধান ও রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য প্রধানমন্ত্রী মাদার অব হিউম্যানিটি উপাদিতে ভূষিত হয়েছেন। পিপলস এ্যান্ড পলিটিক্স বিশ্বের পাঁচ সৎ রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানকে চিহ্নিত করেছে, যাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর শান্তি বৃক্ষ, নারীর ক্ষমতায়নের গ্লোবাল সাউথ সাউথ ডেভেলপমেন্ট এক্সপো ২০১৪, টেকসই উন্নয়নে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ ২০১৫ অর্জনসহ পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ ৩৭টি পদকে ভূষিত হয়েছেন। অতিসম্প্রতি ভারতের পশ্চিম বাংলায় বর্ধমানে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রীতে ভূষিত করেছে এবং বোলপুরে অবস্থিত বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলাদেশ ভবন স্থাপন করেছে, যেখানে বাংলাদেশের ছাত্ররা রবীন্দ্র সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের ওপর উচ্চতর গবেষণার সুযোগ পাবেন ভারত সরকারের বৃত্তি পেয়ে। বাংলাদেশ রূপকল্প ২০২১ এবং সংশ্লিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা (২০১০-২০২০), বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্তকরণ, অষ্টম পঞ্চমবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ শুরু ইত্যাদি সরকারের উল্লেখযোগ্য কাজের স্বাক্ষর। তারপর রয়েছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ, রূপপুর ২৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, মেট্রোরেল, কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণকাজ, নতুন রেলপথ নির্মাণ ও নতুন ট্রেন চালু, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রধানমন্ত্রীর ভাবনা দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখেছে উন্নততর জীবনযাপনের, যার জন্য সরকার কাজ করে চলেছে। এই বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশ শান্তির সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক উদ্ভিজ ও টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক রেজ্যুলেশনসহ রোহিঙ্গাবিষয়ক বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। অতি ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ এরই মধ্যে বহির্বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন ইত্যাদি অনুসরণের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব দৃষ্টান্ত নিয়েই আমরা একটি নতুন বছরে উন্নীত হয়েছি অর্থনীতিতে কতগুলো আশাবাদ নিয়ে, যেমন- মাথাপিছু আয় বাড়বে দুই হাজার (২০০০) মার্কিন ডলার, সুদের হার নয় ছয়ে নামবে, এক জায়গায় নতুন সেবা, ব্যবসায়ে পরিবেশ উন্নতি, শেয়ারবাজারে নতুন আশা, উন্নয়নশীল দেশের পথে (২০২১ সালের মার্চে স্বীকৃতি পাওয়ার পর্যালোচনা), বিনিয়োগ জমি (২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরসহ সরকারের কয়েকটি অর্থনীতি অঞ্চলে আরও বিনিয়োগ উপযোগী জমি), হবে চামড়া শিল্পনগরী, বন্দরে নতুন টার্মিনাল ও ব্যাংক যাবে বাড়ির কাছে (ব্যাংকগুলো শাখা ব্যাংকিংয়ের বদলে এজেন্ট ব্যাংকিং বেশি মনোযোগী হবে) ইত্যাদি। মরগ্যান স্টারলির গ্লোবাল ম্যাক্রো আউটলুক (২০২০) বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলছে, এ বছরে মূল চালিকা শক্তি হবে বাণিজ্য যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস, মুদ্রানীতির শিথিলতা, ভোক্তার ব্যয় বৃদ্ধি, বাণিজ্য বাধা কমলে বাড়বে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রফতানি আয় ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থনীতিও এই বৈশ্বিক পূর্বাভাসের বাহিরে না থাকলেও এর সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন বিনিয়োগ স্থবিরতা, খেলাপী ঋণের প্রাদুর্ভাব, দুর্নীতির প্রবণতা, জলবায়ু পবিবর্তন অভিঘাতসহ সুশাসনের স্বল্পতা। এখানে উল্লেখ্য, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে এরইমধ্যে অভিযান ঘোষণা করেছে যা আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে। বর্তমান সরকারপ্রধান খুবই সফলতার সঙ্গে তার রাজনৈতিক দলের সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছে এবং এরই মধ্যে দলে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটিগুলোর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হযেছে, যা প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতারই প্রমাণ। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার অন্তর্নিহিত দর্শনগুলো হলো এদেশের মানুষ অসাধারণ পরিশ্রমী, উদ্ভাবন ক্ষমতাসম্পন্ন, অল্পতেই সন্তুষ্ট, বিনয়ী ও আদর্শিক চিন্তার অনুসারী। মুজিববর্ষের শুরুতেই যে সকল প্রত্যাশাগুলো জাতি লালন করছে যেমন বিজ্ঞান প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশ, মানবিক ও নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক, সুশৃঙ্খল, প্রগতিশীল, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ ইত্যাদি তা সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বহির্প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী আশা করেছেন জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে দল-মত-নির্বিশেষে সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা গড়তে এগিয়ে আসবে। এ দেশের সহজ সরল মানুষের শপথ নেয়ার সময় এসেছে। লেখক : গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি; [email protected]
×