ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

আমরা সিনেমা হলের পথ ভুলে গেছি!

প্রকাশিত: ১২:২২, ১৬ জানুয়ারি ২০২০

আমরা সিনেমা হলের পথ ভুলে গেছি!

পাশের দেশ ভারতে যখন প্রতি সপ্তাহে একটার পর একটা বক্স অফিস কাঁপানো সিনেমা দর্শকদের জ্বর উঠিয়ে দিচ্ছে, তখন আমাদের দেশে একটার পর একটা সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। হবেই বা না কেন, বক্স অফিস তো দূরের কথা সাধারণ দর্শকদের ভেতর ন্যূনতম প্রণোদনা সৃষ্টি হয় এমন সিনেমার সংখ্যাও দিন দিন কমে গিয়ে একটা নির্জীব শিল্পে পরিণত হয়েছে, আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে বিভিন্ন উত্তাল সময়ে এই সিনেমা শিল্পই অগুনতি মানুষের কাছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার অবলম্বন ছিল। মনে পড়ে আশির দশকের কথা কিংবা নব্বই দশকের... রাজ্জাক-কবরী, শাবান-আলমগীর, সোহেল রানা-ববিতা, ইলিয়াস কাঞ্চন-দিতি, জাফর ইকবাল-চম্পা, সালমান শাহ-শাবনূর কিংবা মান্না-মৌসুমিদের সিনেমা দেখতে সময়ে সময়ে জনসাধারণের মধ্যে কি উৎসাহ-ই না ছিল। বলাকা, মধুমতি, রাজমণি কিংবা মণিহার, শঙ্খ, পিকচার প্যালেস, বর্ণালি, উৎসবসহ এমন আরও অসংখ্যা সিনেমা হলের নাম নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত আলো ছড়িয়েছে। রাজধানী শহর থেকে শুরু করে দেশের অন্যান্য বড় শহর, জেলা শহর এমনকি উপজেলা পর্যন্ত সিনেজগতের প্রভাব মানুষের মধ্যে ভীষণভাবে ছিল। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে প্রবাহিত করা বা মোহিত করার উদাহরণ ছিল অহরহ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহর থেকে ঘন বসতির বস্তি এলাকা কিংবা গলি ঘুপচির ঘিঞ্জি যাপিত জীবনে পরিবর্তন ঘটলেও, দেখা গেছে- ওই সময়টাতে মানুষের আর্থ-সামাজিকসহ অন্যান্য সঙ্কট থাকা সত্ত্বেও জীবনে একটা প্রশান্তি ছিল। খেটে খাওয়া মানুষগুলো দিনের শেষে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে, সন্ধ্যায় পরিবার নিয়ে একটু রাজ্জাক-কবরী বা শাবানা-আলমগীর দেখে পরের দিন আবার জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতো। তেমনি করে আবহমান বাংলার একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যরা মুখিয়ে থাকত কবে বাড়ির সামনে থেকে উচ্চৈঃস্বরে বলে যাবে ‘আসিতেছে আসিতেছে... সারা দিনের কাজ শেষে বউ, জাঁ, ননদ এমনকি শাশুড়ি মিলে ছোট খাট একটা দল তৈরি হতো, ওই যে আসিতেছে তার ডাকে সারা দিতে। পারিবারিক বন্ধন, সম্প্রতি, একে অপরের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব এক কথায় মানবিক গুণের সবই ছিল, সেই ভাঙ্গা গড়ার যুগে। ছিল না কেবল বর্তমান সময়ের এই আধুনিক প্রযুক্তির প্রেমহীন আগ্রাসন। এখন শহরে শহরে সেই বস্তি এলাকা নেই। ভেঙ্গে শপিংমল নয়ত বিশাল এ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে। জনসংখ্যা ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি জমি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের প্রভাবে জীবনযাত্রায় অর্থের পরিমাণ বেড়েছে তেমনি বৈষম্যও..খুব দ্রুতই সবকিছু বদলে যাচ্ছে। এই বদলে যাওয়াটা যে মানুষের জন্য সবক্ষেত্রে মঙ্গল ডেকে আনছে না, তা বোদ করি সকলে অস্বীকার করবেন না। ‘চিত্ত বিনোদন’ সে তো বহুকাল আগে থেকে মানুষ করে আসছে বা খুঁজে আসছে। যুগের সঙ্গে সঙ্গে সময় বুঝে যারা বিনোদনের বিষয়ে বদল ঘটাতে পেরেছে তারা অতীত এবং বর্তমানে সফল হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। আমরা অতীতে পারলেও বর্তমানে ব্যর্থ হচ্ছি। এর প্রধান কারণ হিসেবে অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন যারা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত তারা সময়টা ঠিক ধরতে পারছে না! বর্তমান সময়ের দর্শকদের মনোস্তত্ত্ব বুঝতে পারছে না। এমন কি নিজেদের সময়োপযোগী করে তোলার চেষ্টাও দেখছি না। যেগুলো অন্য দেশের সংশ্লিষ্টরা উপলব্ধি করছে বা করে দেখাচ্ছে। যে কারণে তারা সপ্তাহে, মাসে এবং বছরে অনেক দর্শকনন্দিত সিনেমার ফুল ফুটাতে পারছে, যার সুবাস নিজের দেশ থেকে সুদূর বিদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। আমরাও এখন নিজেদের ভুলে বিদেশী ফুলের সৌরভে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। সমাধানের পথ খুঁজতে গেলে সংশ্লিষ্ট মহল হাজারটা সমস্যা সামনে দাঁড় করিয়ে একে অন্যকে দোষারোপ করে। কাজের কাজটি করতে কেউ আন্তরিক বা অধ্যবসায়ী নয়, ফলে নিজেদের শিল্প ধ্বংসে নিজেরাই আত্মঘাতী হয়ে উঠছি। অফিস-আদালত থেকে শুরু করে, পাড়া-মহল্লা কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদে বিদেশী সিনেমা, গানের চুলচেরা বিশ্লেষণে আমাদের অবসরে প্রাণ ফিরে আসে। কিন্তু, এ প্রাণ তো আমাদের আত্মার নয়। এখানে নিজেদের কোন অস্তিত্ব নেই। যে কারণে আমরা প্রেমহীন জীবনের চর্চা ব্রত হয়েছি। হারিয়ে ফেলেছি সেই স্বপ্নের সোনালি ডানার চিল। যার ডানায় ভর করেÑ আমি, আপনি, আপনারা স্বপ্নের ভুবনে হারিয়ে যেতাম। আবার স্বপ্ন শেষে বাস্তবের দুনিয়ায় ফিরতে ফিরতে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনতেন। আমরা এখন আর সেই পথে হাঁটছি না, না কি পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
×