ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ চার্জশীট দাখিল

পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার সগিরা মোর্শেদ

প্রকাশিত: ১১:২৫, ১৬ জানুয়ারি ২০২০

পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার সগিরা মোর্শেদ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আজ বহুল আলোচিত সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার চার্জশীট দাখিল করতে যাচ্ছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মিস মামলাটির সুষ্ঠু তদন্ত করে পিবিআই। তদন্তে ত্রিশ বছর পর উন্মোচিত হয়, সগিরা মোর্শেদ ছিনতাইকারীদের হাতে নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার জন্য একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর যেভাবে জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছিল, ঠিক একইভাবে সগিরা মোর্শেদকে হত্যার পর ছিনতাই নাটক সাজানো হয়েছিল। ছিনতাই নাটক সাজাতে সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার আলামত গায়েব ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পর্যন্ত গায়েব করে ফেলা হয়। কাকতালীয় হলেও সত্য, দুইটি মামলারই আলামত গায়েবের সঙ্গে দুই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জড়িত। বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্ত ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিলেন। ওই সময়ের আরেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান খুনের মামলার তদন্ত ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে ছিনতাই নাটক সাজিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১০ নবেম্বর মামলার সন্দেহভাজন আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে (৫৯) ঢাকার রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক গত ১২ নবেম্বর ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী (৭০) ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে (৬৪) ধানম-ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক গত ১৩ নবেম্বর মোঃ মারুফ রেজাকে (৫৯) বেইলি রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাকৃতরা আদালতে সগিরা হত্যায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেন। এজন্য এ চারজনকে অভিযুক্ত করে সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার চার্জশীট দাখিল করা হচ্ছে। তবে আগের তদন্তকারী কর্মকর্তা যেহেতু মিন্টু নামে এক ছিনতাইকারীকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট দিয়েছিলেন, এজন্য তার নামও চার্জশীটে রাখা হচ্ছে। তবে তদন্তে সগিরা মোর্শেদ হত্যাকা-ের সঙ্গে মিন্টুর কোন সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া যায়নি। ত্রিশ বছর পর সগিরা মোর্শেদ হত্যার রহস্য উন্মোচন করা তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জনকণ্ঠকে জানান, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে মোসাম্মৎ সগিরা মোর্শেদ সালাম (৩৪) তার ভিকারুননিসা স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে সারাহাত সালমাকে (৮) আনতে যান। স্কুলের সামনে পৌঁছামাত্রই অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা তার হাতে থাকা স্বর্ণের বালা টেনে খুলে নেয়ার চেষ্টা করে। বালা নিতে না পেরে সগিরার কাছে থাকা হাতব্যাগ নেয়ার চেষ্টা করে। এতে বাধা দিলে ধস্তাধস্তি হয়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তাকে গুলি করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সগিরার মৃত্যু হয়। সগিরার পোস্টমর্টেম হয়। এ ঘটনায় সগিরার স্বামী আব্দুস ছালাম চৌধুরী বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি খুনের মামলা দায়ের করেন। মামলার আলামত হিসেবে সগিরার হাতে থাকা স্বর্ণের বালা ও হাতব্যাগ জব্দ করা হয়। তা পুলিশের করা জব্দ তালিকায় দেখানো হয়। ১৯৯০ সালে ডিবির পরিদর্শক আব্দুল জলিল শেখ ছিনতাইকারী মিন্টুর বিরদ্ধে আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। আদালতে মামলার চার্জশীটের সঙ্গে আলামত হিসেবে স্বর্ণের বালা, হাতব্যাগ, গুলির খোসা ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেয়া হয়। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থার এক উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, সগিরা মোর্শেদ হত্যাকা-ের ঘটনার তদন্তের সঙ্গে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের অনেক মিল আছে। সগিরা মোর্শেদ হত্যাকা-ের তদন্ত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মতো নানাভাবে প্রভাবিত করা হয়েছে। অনেকটা হুবহু মিলও আছে। সগিরা মোর্শেদ নিছক ছিনতাইয়ের শিকার বলে প্রথমে প্রচার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত ছিনতাই মামলা সাজিয়ে আদালতে চার্জশীটও দিতে বাধ্য করা হয়েছে। ছিনতাই মামলা সাজাতে যা যা করণীয় সবই করা হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা সগিরা মোর্শেদের হাতের বালা ও হাতব্যাগ শেষ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে গায়েব করে ফেলা হয়েছে। আলামত চূড়ান্তভাবে গায়েব করার আগে হাতের বালায় এবং হাতব্যাগ নিয়ে টানাটানি করায় খুনীদের যে হাতের ছাপ ছিল, তাও মুছে ফেলা হয়েছে। যাতে কোনদিনই কে বা কারা হত্যা করেছে তার ন্যূনতম ক্লু না থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে সগিরা মোর্শেদের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি গায়েব করে ফেলা হয়। মামলাটির চার্জশীটের সঙ্গে দেয়া সগিরা মোর্শেদের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি বিচারকের কাছে যাওয়ার আগেই গায়েব করে ফেলা হয়। এখানেও একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের মতোই পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামানা বাবর যেমন পুলিশকে দিয়ে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আলামত থেকে শুরু করে তদন্ত বিভিন্ন খাতে ঘুরিয়ে দিয়ে জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছিলেন, ঠিক তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানও প্রভাব খাটিয়ে হত্যা মামলার তদন্ত ভিন্ন দিকে প্রভাবিত করে ছিনতাই নাটক সাজিয়েছিলেন। ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার আরও জানান, হত্যা মামলাটির বিচার চলাকালে নানাভাবে সাক্ষীদের জবানবন্দীতে মারুফ রেজার নাম আসে। মামলাটি ২৬ তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করেন। সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ চলতি বছরের ১১ জুলাই ক্রিমিনাল মিস মামলাটি খারিজ করে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়। মামলাটির তদন্তের এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে ঘটনাটি ছিনতাই নয়, পরিকল্পিত হত্যাকা-ে। হত্যাকা-ে জড়িতদের নামও ওঠে আসে। গত বছরের ১০ নবেম্বর মামলার সন্দেহভাজন আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ানকে ঢাকার রামপুরা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক গত বছরের ১২ নবেম্বর ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনকে ধানম-ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক গত বছরের ১৩ নবেম্বর মোঃ মারুফ রেজাকে বেইলি রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাকৃতরা আদালতে সগিরা হত্যায় নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দেন। পারিবারিক কলহের জেরে হত্যাকা-টি ঘটে বলে জবানবন্দীতে এবং তদন্তে বেরিয়ে আসে। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আসামি ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন। অপর দুই আসামি আনাছ মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান ও মোঃ মারুফ রেজা পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যায় অংশ নেয়। পিবিআই প্রধান জানান, ঢাকার রাজারবাগ পেট্রোল পাম্পের কাছের ৯৫৫ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের পৈত্রিক বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বসবাস করত সগিরা। তৃতীয় তলায় থাকত মাহমুদা শাহীন। উপর থেকে ময়লা ফেলার প্রতিবাদ করায় এবং সগিরার গৃহকর্মী জাহিনুর বেগম একদিন ভুলবশত মাহমুদা শাহীনের দরজার সামনে থু থু ফেললে দুই পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য শাহীনের স্বামী ডাঃ হাসান আলী তার রোগী তৎকালীন সিদ্বেশ্বরী এলাকার নামকরা সন্ত্রাসী মারুফ রেজাকে বলেন। মারুর রেজা তৎকালীন এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসানের আপন ভাগ্নে। ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফ রেজাকে ২৫ হাজার টাকা দেয়। ডাঃ হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজোয়ানকে মারুফ রেজার সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পাঠান। ঘটনার দিন আনাস মাহমুদ রেজওয়ান ও মারুফ রেজা মোটরসাইকেলযোগে সগিরার পিছু নেয়। রিক্সাযোগে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের সামনে গেলে মোটরসাইকেল দিয়ে তারা রিক্সা অবরোধ করে। মারুফ রেজা সগিরার হাতে থাকা স্বর্ণের বালা ও হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। সগিরা আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলে ধমক দেন। এ সময় মারুফ রেজা সগিরার হাতব্যাগ ছেড়ে দিয়ে সগিরাকে কোমর থেকে রিভলভার বের করে গুলি করে। প্রথম গুলিটি সগিরার হাতে লাগে। দ্বিতীয় গুলিটি বাম বুকে বিদ্ধ হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সগিরার মৃত্যু হয়। মারুফ রেজা আরও দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে মোটরসাইকেলযোগে দু’জনই পালিয়ে যায়। পিবিআই প্রধান জানান, হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী রিক্সাচালক ছালাম মোল্লাকে শেষ পর্যন্ত শনাক্ত করা হয়। তিনি রিক্সাচালক সগিরা খুনের বিষয়ে আদালতে জবানবন্দী দেন। তারই ধারাবাহিকতায় উন্মোচিত হয় সগিরা মোর্শেদ হত্যার রহস্য উদঘাটিত হয়। মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর দক্ষিণ বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত তদন্তে মামলার আলামত হিসেবে জব্দ হওয়া সগিরা মোর্শেদের হাতের স্বর্ণের বালা ও হাতব্যাগের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
×