ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এখনই চাই মানবিক উদ্যোগ

মাঘের হাড় কাঁপানো শীত, ফুটপাথে বিপর্যস্ত জীবন

প্রকাশিত: ১১:২০, ১৬ জানুয়ারি ২০২০

মাঘের হাড় কাঁপানো শীত, ফুটপাথে বিপর্যস্ত জীবন

মোরসালিন মিজান ॥ পৌষেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শীত। আর এখন তো মাঘ! শীতের তীব্রতা বাড়ছে বৈ কমছে না। বৈরী আবহাওয়া মহাদুর্ভোগে ফেলেছে হতদরিদ্রদের। ঢাকার রাস্তার ধারে, ফুটওভারব্রিজের নিচে, আহারে, কী কষ্টের জীবন! সে জীবনকে আরও তছনছ করে দিচ্ছে শীত। এত উন্নতি করছে একটি দেশ, অর্থনীতির আকার বড় থেকে আরও বড় হচ্ছে, অট্টালিকায় ঢাকা পড়ছে আকাশ, ঠিক তখন এই মানুষগুলো ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়ানো খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। মানবিক মানুষের ভালবাসাই ওদের এই শীত থেকে বাঁচাতে পারে। এবার পৌষের একেবারে শুরু থেকেই শীতের প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কামড়ে ধরেছিল শীত। বার্তা দিয়েছিল, ঠা-া ক্রমশ বাড়বে। তাই হয়েছে। পৌষের বিদায়বেলায় ঘন কুয়াশায় ডুবে ছিল দেশ। সূর্যের আলো তেমন দেখা যায়নি। তদুপরি ছোবল দিয়েছিল শৈত্যপ্রবাহ। এসবের প্রভাবে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। যান্ত্রিক ঢাকাও শীতে যারপরনাই কাবু হয়ে যায়। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল ১১ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। আর তারপর মাঘের শুরু হলো। ঠা-ার মাত্রা এ মাসে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। এবার সে আশঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে। বুধবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়ায়, ৭.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ঢাকায় ছিল ১৪.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। হ্যাঁ, কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ওই যে মাঘের কথা বললাম, মাঘ নামের সেই বাঘটি যে কোন মুহূর্তে হানা দিতে পারে। তাছাড়া তাপমাত্রা সামান্য বাড়লেও, রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা মানুষের কষ্ট তাতে কমবে না। গত কয়েকদিন ঢাকার অলিগলি ফুটপাথ ঘুরে এমন ধারণা হয়েছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায়। বড়লোকদের ভদ্রলোকদের পায়ের কাছে মৃতের মতো পড়ে থাকে মানবসন্তান। গায়ে জড়ানোর মতো এক টুকরো কাপড় সবার নেই। ঠা-া বাতাসে গা ধুয়ে যায় তাদের। ঘুমোতে দেয় না। কেউ খড়কুটো খুঁজে নিয়ে আগুন জ্বালায়। গা ছ্যাঁকে নেয়ার চেষ্টা করে। বাকিরা জেগে কাটিয়ে দেয়। সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে শিশুরা। মঙ্গলবার রাতে বিজয় সরণি এলাকার ফুটওভারব্রিজ দিয়ে পার হওয়ার সময় একটি দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াতে হলো। ব্রিজের ঠিক নিচে শয্যা পেতেছেন ১০ থেকে ১৫ জনের মতো ছিন্নমূল মানুষ। কেউ শুয়ে আছেন। বসে আছেন কেউ কেউ। অদূরে আগুন জ্বালিয়ে শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন অন্যরা। ঘরের ভেতরেই যখন টেকা যায় না তখন বাইরে ওরা কি করে বেঁচে থাকবে? ভাবতেই মন বিষণœ হয়ে যায়। একইসময় পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল একটি নতুন মডেলের চকচকে গাড়ি। গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলো মুহূর্তের জন্য ফুটপাথে পড়তেই দেখা গেল ফুটফুটে একটি শিশু মুখ! মিষ্টি দেখতে শিশুটির বয়স তিন থেকে চার বছরের বেশি হবে না। ছেঁড়া লেপ গায়ে মুড়িয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। উপরে ফুটওভারব্রিজ থেকে পথচারীদের জুতোর ধুলো এসে বাচ্চার গায়ে পড়ছিল। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন যারা, একটু অসতর্ক হলে তাদেরও পা হয়তো শিশুটির গায়ে ওঠে যাবে! এর চেয়ে করুণ ছবি আর কী হতে পারে? সন্তানের ছবি তুলতে গেলে পাশ থেকে এগিয়ে এলেন মা। তার প্রথম প্রশ্ন : ‘বিডিও কইরা কী করবেন? আমরা তো আর মানুষ না...।’ অভিমানী মা পরে জানান, গত কয়েকদিনের শীতে বাচ্চাটির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে একটি ছেঁড়া লেপ কুড়িয়ে এনে বাচ্চার গায়ে জড়িয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। তাতেই শান্তিতে ঘুমোচ্ছে সন্তান। মায়ের গায়ে এক টুকরো কাপড়। পুরো শরীর ঢাকা যায় না। তাই বসে কাটিয়ে দিচ্ছেন! প্রায় একই ছবি দেখা গেল কারওয়ানবাজারের ফুটপাথে। সরকারী-বেসরকারী অনেক ভবন এখানে। সুউচ্চ অট্টালিকার নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অসহায় মানুষ। মৃতের মতো পড়েছিলেন তারাও। পাতলা চাদরে নাক মুখ ঢেকে রাতটুকু পার করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। সত্তর বছরের বৃদ্ধ মোঃ আমিনুল শীতে এত কাবু হয়েছিলেন যে কথা বলতে পারছিলেন না। অনেক চেষ্টা করে জানা গেল, বাড়ি ঘর বলতে কিছু তার নেই। সন্তান আছে না থাকার মতোই। তাই তীব্র শীতের রাতে ফুটপাথে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘শীতের আগে মোটামুটি ধরেন খায়া না খায়া কাটায়া দিছি। এখন আর পারতেছি না। কথা শেষ করার আগেই কাঁশতে শুরু করলেন তিনি।’ না, এক দুই স্থানে নয়। ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাথে অলিতে গলিতে এমন বেদনায় ভরা জীবনের ছবি ভেসে উঠছে। কেউ দেখছেন। কেউ এড়িয়ে যাচ্ছেন। অথচ একটু উদ্যোগী হলে, মানবিক হলে অসহায় মানুষগুলোর শীতের কষ্ট কিছুটা হলেও কমানো যায়। আমরা কি সে চেষ্টা করব না? যদি করতে হয় তবে এখনই সময়। সামর্থ্য মতো হাত বাড়িয়ে দিন। শীতার্তদের পাশে দাঁড়ান।
×