ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের আংশিক পর্যবেক্ষণ

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ১৬ জানুয়ারি ২০২০

পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের আংশিক পর্যবেক্ষণ

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ঐতিহাসিক কারণেই উল্লেখ করা যায় যে, ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলা এদেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রে তৎকালীন ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদ জেলায় পলাশীর আম্রকাননে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। সুদীর্ঘ ২১৪ বছর পর পলাশীর আম্রকানন থেকে মাত্র ২৩ মাইল দূরে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে (মুজিবনগর) ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলার মুকুটহীন সম্রাট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলার অস্তমিত সূর্য পুনরায় উদিত হয়। উল্লেখ্য, এসপি মাহবুবের নেতৃত্বে ইপিআর-এর ১২ জন জোয়ানসহ আনছার সদস্যরা নবগঠিত সরকারকে প্রথম গার্ড অব অনার প্রদান করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। প্রবাসী সরকার জেনারেল এমএজি ওসমানীকে রণাঙ্গনের প্রধান (সেনাপ্রধান) নিযুক্ত করে। আইনানুগভাবে শুরু হয় বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। কুষ্টিয়া জেলা শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানের জন্য ইপিআরের মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে রণাঙ্গনের ৮নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের জোয়ানরা অসামান্য অবদান রেখেছে। অনুরূপভাবে ইপিআর বাহিনীর নেতৃত্বে খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্মুখ প্রতিরোধে পাকবাহিনী পরাজিত ও পিছু হঠতে বাধ্য হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) নামকরণ করেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ১৬ মার্চ বাংলাদেশ রাইফেলসের খাকি পোশাক পরিবর্তন করে তিন রঙের সংমিশ্রণে ছাপা কাপড়ের ইউনিফর্ম প্রবর্তন করা ছাড়াও আধুনিক সমরাস্ত্রে বাহিনীকে সুসজ্জিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে সামান্য সংখ্যক প্রাচীন অস্ত্র নিয়ে তৎকালীন ইপিআর বাহিনী এক অসামান্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। আধাসামরিক বাহিনী হয়ে ইপিআরের বীর সৈনিকবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস রচনা করে জাতিকে গৌরবান্বিত করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইপিআরের সাড়ে ১২ হাজার বাঙালী সৈনিক সরাসরি অংশগ্রহণ করে। অপরিসীম বীরত্বের জন্য শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ পদক প্রদান করা হয়। এছাড়া এ বাহিনীর ৮ জন বীর উত্তম, ৩২ জন বীর বিক্রম ও ৭৮ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ৮১৭ বাঙালী সৈনিক (বীর মুক্তিযোদ্ধা) শহীদ হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর বাঙালী সৈনিকদের অপরিসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল, দেশপ্রেম ও চরম আত্মত্যাগ বাঙালী জাতি তথা সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। দেশমাতৃকার সেবায় পরিবর্তিত বিজিবির সৈনিকরা ভবিষ্যতেও থাকবে নিবেদিত প্রাণ, সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী, জাতি এটাই প্রত্যাশা করে। দেশ রক্ষায় এই বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। তাদের মেধা, দক্ষতা আর সুযোগ্য নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, আইলা, সিডর, নার্গিস ও নানাবিধ দুর্ঘটনাসহ স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে, সাধারণ মানুষের সেবায় নিবেদিত থাকায়। আন্তর্জাতিক পরিম-লে তাদের সাফল্য প্রশংসিত হয়েছে। বিডিআর সদস্যদের উচ্চাভিলাষ ২১৮ বছরের অধিককালের ঐতিহ্যবাহী আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে বিডিআরের নেতৃত্ব শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। ফলে সাধারণ জোয়ান ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মর্যাদা, শৃঙ্খলা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ক্রমান্বয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে বিডিআর সদস্যদের মধ্যে সেনা অফিসারদের কর্তৃত্ব মেনে না নেয়ার এক প্রচ্ছন্ন মানসিকতা নীরবে সক্রিয় ছিল। উপরন্তু এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতায় পুষ্ট হয়ে বাংলাদেশ রাইফেলসের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য ও একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উস্কানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকগণ প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়ে একই উদ্দেশ্যে বিদ্রোহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। বিদ্রোহীদের রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর কাছে অপরাধ গোপন ও ধৃষ্টতা প্রদর্শন বিচারপতি সিদ্দিকী পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের প্রতিনিধি দল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সরকারী বাসভবন যমুনায় বৈঠকে বসে ডিজিসহ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যাসহ নানাবিধ অপরাধ কর্মের কথা সম্পূর্ণভাবে গোপন করে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে। বিদ্রোহীরা একদিকে দাবি আদায়সহ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার জন্য সরকারের প্রধান নির্বাহীকে চাপ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে পিলখানার অভ্যন্তরে তাদের সহযোগীরা দরবার হলসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিহত সামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষতবিক্ষত ও বিকৃত রক্তাক্ত লাশ পিকআপ ও ট্রাকে তুলে বিডিআর হাসপাতালের মরচুয়ারী ও পার্শ¦বর্তী এলাকায় একত্রিত করে। বিদ্রোহীরা নিহত সেনা অফিসারদের রক্ত পানি দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজে নিয়োজিত হয়। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি এবং জাতীয় সংসদের হুইপ মির্জা আজম এমপি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহের কারণ জানার জন্য ধানমণ্ডির ২নং রাস্তা দিয়ে সাদা পতাকা ও হ্যান্ডমাইক নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় পিলখানার ৪নং গেটে অবস্থিত সশস্ত্র বিদ্রোহীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার এ্যাকশনে দেখা যায়। সরকারী প্রতিনিধিদ্বয় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে মাইকে কথা বলতে বলতে ৪নং গেটের সন্নিকটে উপস্থিত হয়ে তাদের দাবি দাওয়াসহ তারা কেন বিদ্রোহ করেছে তা জানতে চাইলে বিদ্রোহীরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ কণ্ঠে বলতে থাকে, তারা প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কথা বলবে না। বিদ্রোহীরা ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলে, প্রধানমন্ত্রীকে পিলখানায় পাঠান, নইলে তারা বিদ্রোহ চালিয়ে যাবে ইত্যাদি। জাহাঙ্গীর কবির নানক ও মির্জা আজম মাইকযোগে তাদের মোবাইল ফোনের নম্বর দেয়ায় বিদ্রোহীরা তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে এবং এক পর্যায়ে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হেয়ার রোডের সরকারী বাসভবন যমুনায় যেতে সম্মত হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসসহ নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহীদের ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন যমুনায় যায় এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে যমুনার গেটে ডিএডি তৌহিদের প্রেস ব্রিফিংয়ের দৃশ্য অবলোকন করায়। ডিএডি তৌহিদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের পক্ষে আলোচনাকালে তাদের দাবি সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করে এবং প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা প্রেস ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করে বলে, ‘সরকার আমাদের দাবি মেনে নিয়েছে।’ তিনি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ নিয়ে তারা পিলখানায় ফিরে অস্ত্র সমর্পণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে কালক্ষেপণ করতে থাকে। ১৪ সদস্যের প্রতিনিধি দল অস্ত্র সমর্পণ প্রক্রিয়া শুরুর অজুহাতে আরও অধিক সংখ্যক নেতৃস্থানীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পিলখানার ৪নং গেটের সন্নিকটে হোটেল আম্বালায় দফায় দফায় আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করতে থাকে। তাছাড়া বিদ্রোহীরা নিরাপত্তার নামে পিলখানার চারদিকে ভারি অস্ত্র স্থাপনসহ সশস্ত্র অবস্থায় নিজেদের নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে। একই সঙ্গে তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সমগ্র পিলখানা এলাকায় সশস্ত্র অবস্থায় টহল অব্যাহত রাখে। ভারি অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন গেটসহ উঁচু দালানের ছাদে অবস্থান নেয় এবং সমগ্র পিলখানা এলাকায় নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসে। চলবে... লেখক : হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি
×