ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিনভর ঘুড়ি ওড়ানো কাটাকাটি, রাতে আলোর উৎসব

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

দিনভর ঘুড়ি ওড়ানো কাটাকাটি, রাতে আলোর উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ বিদায় নিল পৌষ। মঙ্গলবার ছিল শেষ দিন। আর পৌষের শেষ দিন মানেই পৌষসংক্রান্তি। এখন আগের মতো উদ্যাপিত হয় না। তবে হারিয়েও যায়নি। লোকায়ত জীবন ও সংস্কৃতির যে আবেদন, নাগরিক জীবনে এর প্রভাব কিছুটা হলেও পরিলক্ষিত হয়। এবারও পৌষসংক্রান্তির দিন ঢাকার বিভিন্ন বাসাবাড়িতে পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়। আচার পালনেও ব্যস্ত ছিলেন অনেকে। তবে পৌষসংক্রান্তি উদ্যাপনে সবচেয়ে এগিয়ে পুরান ঢাকা। সেখানে একই উৎসব সাকরাইন নামে উদ্যাপিত হয়। এবারও হয়েছে। সকাল থেকে চলে ঘুড়ি ওড়ানো। আর রাতে আতশবাজি। পটকা ফোটানো। দেখে মনে হয়েছে, আনন্দনগরী! ঠিক কবে থেকে সাকরাইন উদ্যাপিত হয়ে আসছে সে তথ্য নিশ্চিত করে জানা যায় না। যতদূর তথ্য, মোগল আমলে বাংলায় উৎসবটির প্রচলন করা হয়। ঢাকার নবাবরা এর সূচনা করেন। পৌষ সমাপনী এবং মাঘের শুরুর ক্ষণে খাজনা আদায় শেষে নবাবরা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব করতেন। চলত খাবার দাবারের আয়োজন। পৌষসংক্রান্তিতে জামাইরা শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসতেন। তখন তাদের পিঠাপুলি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। একইসঙ্গে হাতে তুলে দেয়া হয় ঘুড়ি ও নাটাই। সে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পুরান ঢাকা। সদরঘাট, নবাবপুর, সূত্রাপুর, হাজারীবাগ, মিলব্যারাক, লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, ওয়ারী ও পোস্তগোলা এলাকার মানুষ এখনো ঘটা করে সাকরাইন উদ্যাপন করে। শুধু ঢাকাতেই নয়, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে পৌষসংক্রান্তির উৎসব হয় বলে জানা যায়। ভারতে আয়োজনটিকে বলা হয় মকরসংক্রান্তি। নেপালে উদ্যাপিত হয় মাঘি নামে। থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও। মিয়ানমারে থিং ইয়ান। কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদ্যাপিত হয়। ঢাকার কথায় আসা যাক। পৌষ বিদায়ের দিনে গোটা পুরান ঢাকাই ছিল উৎসবে মুখর। গে-ারিয়া তাঁতিবাজার লক্ষ্মীবাজার চকবাজার লালবাগ সূত্রাপুরসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে, বলা চলে, আকাশ দেখা যায়নি। ঘুড়ি উড়ছিল শুধু। সকাল হতেই প্রতিটি বাড়ির ছাদে ছোট ছোট সমাবেশ ঘটে। স্থানীয় তরুণ ও শিশু কিশোররা মায়ের বা বোনের হাতে তৈরি পিঠাপুলি নিয়ে ছাদে উঠেছিল। আরও ছিল চালের রুটি। হাঁসের মাংস। খেতে খেতে ঘুড়ি ওড়ানো। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ঘুড়ির সংখ্যা। কিছু ঘুড়ি পাতলা কাগজ দিয়ে তৈরি। কোনকোনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে পলিথিন। বাঁশের পাতলা চটি অথবা নারকেলের শলা দিয়ে মূল কাঠামোটি গড়ে নেয়া হয়েছে। নক্সা অনুযায়ী নাম। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু ঘুড়ির নাম জানা সম্ভব হয়। রায়সাহেব বাজারে কথা হচ্ছিল অনির্বাণ নামের এক তরুণের সঙ্গে। তিনি এক নিশ্বাসে কয়েকটি ঘুড়ির নাম বলে যান। এই যেমনÑ পঙ্খীরাজ, চাপালিশ, চোখদ্বার, মালাদ্বার, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চানদ্বার...। ঘুড়ির মতো নাটাইয়েরও আলাদা আলাদা নাম আছে। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়াÑ আরও কত কত নাম! ঘুড়ির ‘লেঞ্জা’ তৈরিতেও সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটানো হয়েছিল। ঘুড়ির লেজ বা লেঞ্জা আকাশের বুকে ঢেউ তুলেছিল। ঘন হয়ে উড়তে থাকা রং বেরঙের ঘুড়ি আকাশের রং বদলে দেয়। উৎসবের রঙে সাজায়। নিচে থেকেও ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য উপভোগ করেছেন অনেকে। পথচারীদের আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটতেও দেখা গেছে এদিন। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জানালার গ্রিল ধরে ঘুড়ির ওড়াওড়ি দেখেছেন এমনকি বুড়োরা। অবশ্য সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো মূল কথা নয়। কাটাকাটিতেই যত আনন্দ। এটি বলা চলে প্রধান আকর্ষণ। না, ঝগড়াঝাটি নয়। শত্রুতা নয়। এ লড়াই চলে হাসিমুখে। প্রথমে কাছাকাছি অবস্থান করা দুটি ঘুড়ির সুতোয় প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছিল। তার পর নিজ নিজ দক্ষতা অভিজ্ঞতা ও কৌশল কাজে লাগিয়ে কাটাকাটি খেলা। যুদ্ধে পরাজিত সুতা কাটা ঘুড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দূরে আরও দূরে চলে যাচ্ছিল। অন্য কোন বাসার ছাদে বা মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল। সুতো কাটা ঘুড়িকে অনুসরণ করছিল পাড়ার দূরন্ত ছেলে মেয়েরা। গে-ারিয়ার একটি বাসার ছাদে কথা হয় অরিত্র ও জোহার সঙ্গে। সম্পর্কে দু’জন চাচাত ভাই। তারা জানান, সাকরাইন উৎসবের জন্য সারাবছর অপেক্ষা করে থাকেন তারা। এবারও বাজার ঘুরে ভাল ঘুড়ি কিনে এনেছিলেন। এ কারণে দু’টি ঘুড়ির সঙ্গে লড়েও তাদেরটি টিকে আছে বলে জানান তারা। সন্ধ্যার দিকে একে একে সব ঘুড়ি নেমে আসে। গুটানো হয় নাঠাই। অন্যদিকে শুরু হয়ে যায় আতশবাজি। বিপুল জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে টুকরো টুকরো আলো। ঘুড়ির জায়গায় দেখা যায় অসংখ্য ফানুস। শব্দ করে পটকা ফুটে। মুখ দিয়ে কেরোসিন ছুড়ে আগুনের সঙ্গে খেলতেও দেখা যায় এদিন। সান্ধ্য আয়োজনে যোগ হয়েছিল নাচ গানও। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটি দিন। নতুন ঢাকার মানুষও এদিন পুরান ঢাকার বন্ধুদের বাসার ছাদে কাটিয়েছেন। ভাগাভাগি করে নিয়েছেন আনন্দ।
×