ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সঙ্কট নিরসনে সরকারী চার ব্যাংককে বিনিয়োগের নির্দেশ ;###;বেসরকারী ব্যাংকগুলোকেও বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ;###;বৈঠকে বসছে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন

উল্টোপথে শেয়ারবাজার ॥ অন্যসব সূচকেই এগিয়ে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

উল্টোপথে শেয়ারবাজার ॥ অন্যসব সূচকেই এগিয়ে বাংলাদেশ

অপূর্ব কুমার ॥ ২০১০ সালের পর স্মরণীয় দরপতনের কারণে নিত্যদিন পুঁজি হারাচ্ছেন শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা। গত সাত দিনে প্রধান শেয়ারবাজারে সূচক কমেছে ৪০০ পয়েন্ট। শুধু চলতি বছরের দুই সপ্তাহেই বাজার মূলধন কমেছে ২৭ হাজার কোটি টাকা। কমতে কমতে ঢাকা স্টক একচেঞ্জের সূচক নেমেছে ৫৬ মাসের সর্বনিম্ন ৪ হাজার ৩৬ পয়েন্টে। অতীতের চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়ানো এই পতনের কারণে প্রতিদিনই মুখে কাপড় বেঁধে রাস্তায় নামছেন বিনিয়োগকারীরা। তবে মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। শেয়ারবাজার নিয়ে সরকারী চার ব্যাংককে বিনিয়োগের নির্দেশসহ অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণ হিসেবে চাওয়া ১০ হাজার কোটি টাকা পাওয়ার আশ্বাসও মিলেছে। তীব্র তারল্য সঙ্কট, সুশাসনের অভাব, স্বার্থানেষী মহলের গুজব, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপ, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণেই বর্তমানে শেয়ারবাজার দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সূচকগুলোর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্য সব সূচকেই এগিয়ে বাংলাদেশ। কিন্তু উল্টোপথে হাঁটছে শেয়ারবাজার। শেয়ারবাজারকে সঠিক পথে আনতে সরকারের সাদামাটা উদ্যোগ ছাড়া বড় কোন প্রচেষ্টা এর আগে লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, খাদের কিনারে দাঁড়ানো শেয়ারবাজারকে বিশেষভাবে গুরুত্ব না দিয়ে কোন উপায় নেই। অন্যদিকে যেখানে বিনিয়োগকারীরা নিজেদের পুঁজি হারাচ্ছেন নিয়মিত সেখানে ঢাকা স্টক একচেঞ্জের পরিচালনা পর্ষদ এমডি পদে নিয়োগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন। ডিএসইর নেতাদের এই দ্বন্দ্বও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভুল বার্তা দিচ্ছে। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানসহ কমিশনারদের তৃতীয়বারের মতো নিয়োগের পর আস্থার পরিবেশ না সৃষ্টি করার কারণে আস্থায় চিড় ধরেছে। এছাড়া মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে চাওয়া ১০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিশেষ চাপ সৃষ্টির জন্য শেয়ারবাজারকে হাতিয়ার বানানোর অপচেষ্টাও রয়েছে। একইসঙ্গে গ্রামীণফোন ও রবির মতো বহুজাতিক কোম্পানির সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে শেয়ারবাজারকে নীতিগত সাহায্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও চার ব্যাংককে শেয়ার কেনার আদেশ দেয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে এমন ক্রেতা সঙ্কটের কারণ হিসেবে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, যেটা ঘটার কথা না সেটাই ঘটে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা বিমুখ হয়ে গেছেন। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের কোন আস্থা নেই। আস্থা ফেরানোর জন্য কোন চেষ্টা চলছে কি না, কে জানে। আর চললেও তা কাজে আসছে না। তিনি বলেন, যে হারে দরপতন হচ্ছে তাতে এটা স্পষ্ট বাজারে ক্রেতা সঙ্কট আছে। বিদেশীরা দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ার বিক্রি বেশি করছে। তবে এমন পতনের বাজারে যারা শেয়ার বিক্রি করছেন তাদের আচরণও স্বাভাবিক না। মোট কথা সার্বিক বাজারের আচরণ এখন অস্বাভাবিক। স্বাভাবিক হলে তো দরপতন হতো না। বিক্রির বদলে তারা শেয়ার কিনত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাকাউন্টিং এ্যান্ড পাবলিক পলিসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বাজারের ওপর অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা এত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে যে তারা আর কোন ভরসা পাচ্ছেন না। সর্বশেষ ডিএসইর এমডি নিয়োগ নিয়ে বোর্ড সভায় যে ঘটনা ঘটছে তা পত্রিকা মারফত আমরা জানতে পেরেছি। এগুলোও বিনিয়োগকরীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে যে, যারা কারসাজি করে, যারা মার্কেট নষ্ট করে তারা খুব তৎপর। ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে আমরা অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। গ্রামীণফোনসহ জটিল বিষয়গুলো আমরা বৈঠকে তুলে ধরেছি। এসব বৈঠক সুফল বয়ে আনেনি। বাজারের মূল সমস্যাগুলো আমরা চিহ্নিত করতে পারলেও তার সমাধান হয়নি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। গ্রামীণফোনের সমস্যার সমাধান হয়নি। এতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের যে দরপতন হয়েছে, তাতে আমাদের কিছু করার ছিল না। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা ছাড়া বাজারের এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কষ্টকর। বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, বিএসইসির এই চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে শেয়ারবাজার ভাল করা যাবে না। আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চাই। সেই সঙ্গে পুরো কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। প্রশান্ত কুমারের নিয়ন্ত্রণে থাকা তিন প্রতিষ্ঠানের নাজুক পরিস্থিতি প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া তিন প্রতিষ্ঠান হলো সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, রহমান কেমিক্যালস ও নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। এর বাইরে আজিজ ফাইবার্স জুট মিলের নিয়ন্ত্রণও এখন তার হাতে, যেটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আজিজ পাইপসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল। সব প্রতিষ্ঠানেই পড়েছে কেলেঙ্কারির ছায়া। যার কারণে নেতিবাচক প্রবণতা পড়েছে অন্যান্য শেয়ারেও। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ছাড়া পিকে হালদারের দখল করা বাকি তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো পিপলস লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। তার নিয়ন্ত্রণে থাকা শেয়ারগুলোতে কয়েকদিন ধরেই ক্রেতা নেই। এছাড়া তার নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্রোকারেজ হাউসগুলোতেও রয়েছে বড় বড় পোর্টফলিও। এসব পোর্টফলিওতে বিক্রির চাপ বাড়লে শেয়ারবাজার আরও নাজুক হতে পারে বলে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। পিকে হালদার শেয়ারবাজারে লেনদেন করতেন নিজের ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমেই। কেএইচবি সিকিউরিটিজ ও হাল ক্যাপিটাল লিমিটেডের মালিকানা তার। এর বাইরে আরও অন্তত ১০টি ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে শেয়ার কেনাবেচা করতেন তিনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ওই ১০ প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সিকিউরিটিজ ও আইএল ক্যাপিটাল রয়েছে। এ দুটি আবার পিকে হালদারের দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সহযোগী। চার ব্যাংককে শেয়ার কিনতে নির্দেশ শেয়ারবাজারের তারল্য সঙ্কট নিরসনে সরকারী চার ব্যাংককে বিনিয়োগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে করণীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাতে এই কথা জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম। সাক্ষাতে বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ মতিন অংশ নেন। রিয়াদ মতিন সাংবাদিকদের বলেন, বিএমবিএ শেয়ারবাজারের মন্দাবস্থা দূর করার জন্য করণীয় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাত করেছে। সেখানে তাকে শেয়ারবাজারের এই অবস্থায় তারল্য সঙ্কটের বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে শেয়ারবাজারের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০ হাজার কোটি টাকার ফান্ডের বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। তিনিও এই ফান্ডের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংককে বিনিয়োগসীমা অনুযায়ী বিনিয়োগের জন্য মৌখিক নির্দেশ দিয়েছেন। আসাদুল ইসলাম জানিয়েছেন, সোনালী ব্যাংকের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তদারকি কমিটির বৈঠক ২০ জানুয়ারি শেয়ারবাজারের উন্নয়নে অর্থ মন্ত্রণালয়েরর গঠিত সমন্বয় ও তদারকি কমিটি আগামী ২০ জানুয়ারি জরুরী সভা আহ্বান করেছে। এতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব ড. নাহিদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানা গেছে। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত সচিব মাকসুরা নূরের সভাপতিত্বে দুপুর ২টায় ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদ কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ মাসুদ বিশ্বাস, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক মোঃ সাইফুর রহমান, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। স্থিতিশীলতায় কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে এ পর্যন্ত যতগুলো প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে সর্বোত্তম প্রস্তাব বাস্তবায়নে সহায়তা দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম এ কথা জানান। তিনি বলেন, মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) একটি প্রতিনিধিদল গবর্নর ফজলে কবীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে সিঙ্গেল ডিজিটের সুদহার বাস্তবায়ন, খেলাপী ঋণ, ব্যবসা সহজীকরণ, বর্তমান শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি এবং এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে আলোচনা হয়।
×