ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিষেধাজ্ঞা অমান্য, রাতে চলছে অবৈধ বাল্কহেড

অরক্ষিত বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

অরক্ষিত বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা

স্টাফ রিপোর্টার, মুন্সীগঞ্জ ॥ প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই ধলেশ্বরী, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীতে রাতেরবেলা হাজার হাজার বালুবাহী বাল্কহেড অবাধে চলাচল করছে। এসব নৌযানের কারণে একাধিক নৌ দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনার পর নৌ দুর্ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন ৫ বছর আগে রাতেরবেলায় বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও তা উপেক্ষা করেই চলাচল করছে। অভিযোগ উঠেছে, সংশ্লিষ্ট জেলার নৌ পুলিশকে ম্যানেজ করেই এসব বাল্কহেড চলাচলের সাহস পাচ্ছে। এর ফলে গত ৩ বছরের ব্যবধানে ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীতে একাধিক নৌ দুর্ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল ইব্রাহিম হোসেন, লঞ্চযাত্রী খোরশেদ আলম, ট্রলার যাত্রী ও ২৩ শ্রমিকসহ ৩৯ নিহত হয়। আহত হয় অর্ধশতাধিক। অল্পের জন্য রক্ষা পায় ৫ শতাধিক লঞ্চ যাত্রী। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ বছর ধরে অবৈধ এ নৌযানগুলোর কোন ধরনের কারিগরি নক্সা ছাড়াই মিস্ত্রি ও ওয়েল্ডারের পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হচ্ছে। আর যারা এ নৌযান তৈরির সঙ্গে জড়িত, তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। অশিক্ষিত পেশাজীবী গোষ্ঠীই এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ডকইয়ার্ডগুলোরও কোন বৈধ অনুমতির কাগজপত্র নেই। এমনকি এসব নৌযানের কোন হুইল থাকে না। নৌকার মতো হালের সঙ্গে একটি লম্বা স্টিলের পাত বা কাঠের খুঁটির মতো বস্তু ব্যবহৃত হয়ে থাকে হুইলের বিকল্প হিসেবে। চালক নৌযানের ছাদে বসে কখনও পা দিয়ে, কখনও হাত দিয়ে নৌযান চালিয়ে থাকে। মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাট সূত্রে জানা গেছে, ধলেশ্বরী, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ৬ থেকে ৭ হাজার কার্গো ও বাল্কহেড চলাচল করে। মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীতে কয়েকটি বালুমহাল রয়েছে। এছাড়া ইজারাবিহীনও অবৈধভাবে দিন-রাত বালু উত্তোলন করা হয়। উত্তোলিত বালু বহন করে হাজার হাজার বাল্কহেড দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ সন্ধ্যা রাতে মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনায় ১৬ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ৬ নবেম্বর ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীর মোহনায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ও কয়লা বহনকারী বল্কহেডের সংঘর্ষে ৯ শ্রমিক আহত এবং কয়েকদিন পরই ধলেশ্বরী নদীতে বরগুনাগামী এমভি মানিক-৯ লঞ্চের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে লঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পায় ৪শ’ লঞ্চযাত্রী। ১৪ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌরুটের ধলেশ্বরী নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষে খোরশেদ আলম নামের এক যাত্রীর মৃত্যু হয় এবং অল্পের জন্য রক্ষা পায় শতাধিক লঞ্চযাত্রী। ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সদর উপজেলার চর আব্দুল্লাহপুর গ্রাম সংলগ্ন মেঘনা নদীতে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় নৌ পুলিশের ট্রলার ডুবিতে ইব্রাহিম নামের এক পুলিশ কনস্টেবলের লাশ উদ্ধার, ৩০ এপ্রিল মেঘনা নদীতে ঢেউয়ের কবলে ইট বোঝাই ট্রলারডুবিতে রফিজউদ্দিন মিয়া নামের এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ১৮ আগস্ট মেঘনা নদীর মোহনায় গ্রীনলাইন-২ লঞ্চের ঢেউয়ের কবলে ইটবাহী একটি ট্রলার ডুবে গেলে ১০ শ্রমিককে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। ২০১৯ সালে পৃথক দুটি নৌ দুর্ঘটনায় ২৩ শ্রমিক নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পর তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বাল্কহেড, কার্গো, ড্রেজার ও ট্রলারসহ নানা নৌযান তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। যেসব প্রতিষ্ঠানে এসব নৌযান তৈরি হচ্ছে, তাদের নেই বৈধ কাগজপত্র। এমনকি নৌযানের নক্সায়ও রয়েছে মারাত্মক ত্রুটি। এছাড়া এ ধরনের নৌযানকে সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন নৌ দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম কারণ হওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন বাল্কহেড সমিতির সঙ্গে এক বৈঠকে রাতেরবেলায় বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু তা অমান্য করেই রাতেরবেলায় বাল্কহেড ও কার্গো চলাচল করছে। বাল্কহেড চলাচলের ওপর পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে রাতেরবেলায় নৌ পুলিশের সঙ্গে কোস্টগার্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্র আরও জানায়, চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা তোয়াক্কা না করেই রাতেরবেলায়ও বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করছে। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে শাস্তি ও জরিমানা করা হচ্ছে। এমনকি বাল্কহেড মালিক পক্ষকে নিয়ে সভা- সেমিনার করে সতর্ক করা হলেও পরে তারাই আইন অমান্য করে অবৈধ নৌযান চালাচ্ছে। মুন্সীগঞ্জ জেলা বাল্কহেড মালিক সমিতির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সমিতি আছে, কিন্তু কার্যক্রম নেই। দুই বছর আগে সমিতির সভায় রাতেরবেলা বাল্কহেড চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে আইন আছে, বড় আকারের কার্গো বডি রাতে নৌপথে চলাচলে কোন বাধা নেই। ছোট আকারের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান তালুকদার জানান, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতেরবেলায় অবৈধ এ নৌযান চালানো হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×