ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

ছহি বড় মাকাল নামা

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১৫ জানুয়ারি ২০২০

ছহি বড় মাকাল নামা

বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা আন্দোলনকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ছিলেন আইয়ুবের নিযুক্ত ময়মনসিংহের বটতলার উকিল মোনায়েম খাঁ। তার আমলেই বঙ্গবন্ধুকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়’ প্রধান আসামি করে মৃত্যুদ- দেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছিল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু পারতপক্ষে তার বক্তৃতা বিবৃতিতে মোনায়েম খাঁর নাম উচ্চারণ করতেন না। তাকে বলতেন ‘পাটোয়ারি সাহেব।’ আমি একদিন তার কারণ জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের এত বড় সর্বনাশ যে দিনের পর দিন করে চলেছে তার নাম উচ্চারণে আমার ঘৃণা হয়।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঘৃণা এখন দেখছি আমার মনেও সংক্রমিত হয়েছে। তবে তা মোনায়েম খাঁর বিরুদ্ধে নয়, এই ঘৃণা বঙ্গবন্ধুরই এককালের এক অনুসারীর বিরুদ্ধে। মোনায়েম খাঁ এখন মৃত। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর থাকাকালে তিনি পশ্চিমা সামরিক জান্তার সেবাদাসের ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই সাবেক অনুসারী কাদের সেবা দাস হয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ছুরি হাতে বৃদ্ধ বয়সে রাজনীতির মাঠে নেমেছেন তা আমি জানি না। তিনি অত্যন্ত চাতুর্য্যরে সঙ্গে একটা মুখোশ ধারণ করেছিলেন। এই মুখোশটি ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর এবং তার অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অনুসারী সেজেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও তিনি একটানে মুখোশটি খোলেননি। ধীরে ধীরে খুলেছেন। বহুদিন সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রেখেছিলেন যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় তিনি দল ছাড়লেও বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির অনুসারী রয়ে গেছেন। জনসাধারণের মনে এই বিভ্রান্তিটা ধীরে ধীরে কেটেছে। তিনিও ধীরে ধীরে মুখোশটি উন্মোচন করেছেন। বর্তমানে তার এই মুখোশটি সম্পূর্ণ উন্মোচিত হতেই দেখা যাচ্ছে তার আসল রূপ। তার এই আসল রূপটি হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির অনুসারীর। গত সাধারণ নির্বাচনের সময় তিনি অর্ধেক ঘোমটা খুলে বিএনপি-জামায়াতের ফ্রন্টের নেতা হয়েছিলেন। এখন তার ফ্রন্ট শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ায় ঈর্ষায় ও রাগে অন্ধ হয়ে মুখোশের বাকি অর্ধাংশ খুলে ফেলেছেন। এখন তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর দলের বিরোধী নন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শেরও ঘোরবিরোধী। সম্ভবতঃ খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব (গত সাধারণ নির্বাচনের সময়) মেনে নেয়া এবং দুর্নীতির দায়ে দ-িত খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করার পর এখন তিনি তারেক রহমানেরও খলিফা হবেন। তার পাঠানো ওহি অনুযায়ী রাজনীতি করবেন। এখন এটাই দেখার রইল। জুলিয়াস সীজার ছুরিকাঘাতে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তার অত্যন্ত আপনজন ব্রুটাসকে রক্তাক্ত ছুরি হাতে দেখে বলেছিলেন, ব্রুটাস, তুমিও! বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে তার বিশ্বস্ত অনুসারীর কাজ দেখে ও কথাবার্তা শুনে বলতেন, ‘...তুমিও!’ অথচ বঙ্গবন্ধুই তাকে পাকিস্তানে থাকাকালে কার্যকলাপের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন। নইলে আমার এক বন্ধু মোনায়েম সরকারের ভাষায় ‘নুরুল আমিন ও মাহমুদ আলীর’ মতো পাকিস্তানেই তার কবর হতো। বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জুনিয়র উকিল হিসাবে কাজ করে আইনজীবী হিসেবে তার খ্যাতি লাভ। পাকিস্তানে থাকাকালীন কার্যকলাপের জন্য বঙ্গবন্ধু তাকে ক্ষমা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার জন্য শেরে বাংলার পুত্র একে ফায়জুল হক এবং সাংবাদিক শহীদুল হককে (দু’জনেই এখন প্রয়াত) পশ্চিম পাকিস্তানে নেয়া হয়েছিল। তারা বলে গেছেন, বঙ্গবন্ধুর মামলায় তারই অনুসারী সাক্ষ্য দেবেন। তারা শুধু তাকে সহযোগিতা জোগাবেন বলে তাদের বলা হয়েছিল। তিনি একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে বন্দী হননি। তিনি স্বেচ্ছায় তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তিনি লাহোরে বন্দী ছিলেন না। ছিলেন গুলবাগে সিন্ধি শ্বশুর এক জেনারেলের বাড়িতে। আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় এসে যখন ইরানের শাহকে পাকিস্তানে এনেছিলেন কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান এক রাখার ব্যাপারে সম্মত করার চেষ্টা করতে, তখন সেই বৈঠকে তিনিও ছিলেন এবং তিনিও বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। এসব খবর ও অভিযোগ কি সত্য? বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৩ সালে যখন তার আত্মজীবনী লেখার কাজে সাহায্য জোগাতে প্রত্যহ গণভবনে যাই, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এসব অভিযোগ কি সত্য। বঙ্গবন্ধু জবাব দিতে চাননি। বলেছিলেন, ‘ও খুব ভীরু। তবে এন ইয়ং ট্যালেন্ট। তাকে দেশের কাজে লাগানো দরকার। সুতরাং ওসব কথা থাকে।’ বঙ্গবন্ধু তাকে আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছিলেন। তিনি সংবিধানের এক লাইনও না লিখে সংবিধান প্রণেতা হয়েছেন। কারণ, বঙ্গবন্ধু তাকে ’৭২-এর সংবিধান রচনার কমিটির সভাপতি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাকে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি নিজগুণে পরাজিত হয়েছেন। তারপর তিনি ধীরে ধীরে দল ছেড়ে স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি রাজনৈতিক দল গঠন তার উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য কখনও কাদের সিদ্দিকী, কখনও বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত। হাসিনা-বিদ্বেষ তাকে অন্ধ করে ফেলেছে। পতন ও পচনের কোন্্ পর্যায়ে তার চরিত্র এসে দাঁড়িয়েছে তা তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে ‘বাঙালীর কলঙ্ক’ মোনায়েম খাঁর নামোচ্চারণ করতে চাইতেন না। আমারও দীর্ঘকাল ধরে নীতিহীন এবং বিপদ দেখলেই বিদেশে পলায়নে পারদর্শী এই ব্যক্তির নামোল্লেখ করে কিছু লিখতে ইচ্ছা হয় না। তাকে আমি বহুকাল আগে চিনতে পেরেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম মাকাল হোসেন। তখন শেখ রেহানা আমার ওপর রাগ করেছিলেন। পরে যখন মাকাল হোসেন স্বরূপে আবির্ভূত হন তখন শেখ রেহানাকে বলেছিলাম, তোমাদের বিগ্্ আঙ্কলের এ কী হলো মা? যাহোক, অতীতের কাসুন্দি আর ঘাটতে চাই না। মাকাল হোসেনকে নিয়ে আমার এই লেখার উদ্দেশ্য, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র পদে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তাতে এক আসনে ব্যারিস্টার শেখ তাপস এবং অন্য আসনে সিটিং মেয়র আতিক দাঁড়িয়েছেন। বিএনপি এই নির্বাচনে যোগ দিয়েছে। দুই মেয়র পদে দাঁড় করিয়েছে আবদুল আউয়াল মিন্টুর এবং সাদেক হোসেন খোকার পুত্রকে। বিএনপির নির্বাচনে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন। নির্বাচন বর্জন করে চলা যে রাজনীতিতে আত্মঘাতী নীতি এটা এতদিনে তারা বুঝতে পেরেছেন। আমার ধারণা সিটি কর্পোরেশনের এই দুটি আসনই আওয়ামী লীগের জন্য নিরাপদ। ব্যারিস্টার তাপস এমপি হিসেবে তার নির্বাচনী এলাকায় যে খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তাতে মেয়র পদে জয়লাভ তার পক্ষে কষ্টকর হবে না। অন্যদিকে মেয়র আতিক, ডেঙ্গুজ্বর ম্যানেজমেন্টে শৈথিল্য প্রদর্শন ছাড়া তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ শুনিনি। সুতরাং তিনিও তার নির্বাচনে উতরে যাবেন বলে অনেকের বিশ্বাস। কেবল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মী আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জেতানোর নামে অতি উৎসাহ না দেখালেই হয়। দেখালে এই নির্বাচনও বিএনপি বিতর্কিত করার সুযোগ পাবে। ব্যারিস্টার তাপসের ও মেয়র আতিকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং দলের জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিএনপির এক প্রার্থী অথবা দুই প্রার্থীই যদি নির্বাচিত হন, তাতে গণতন্ত্রের জয় হিসেবে অভিনন্দন জানাতে হবে। সকলেই জানাবে। মজার ব্যাপার যে, এই দুই প্রার্থীর উপস্থিতিতে মাকাল হোসেন এক সংবাদসভা করেছেন এবং বলেছেন, তিনি বিএনপির দুই প্রার্থীকে সমর্থন জানাবেন। মাকাল হোসেন অথবা তার দলের প্রার্থীরা যদি দলীয় টিকেটে নির্বাচনে দাঁড়ান, তাহলে শুধু পরাজিত হওয়া নয়, জামানতও হারান। এই অবস্থায় তার সমর্থনে বিএনপি প্রার্থীরা জয়ী হবেন, না তাদের জয়লাভের যেটুকু সম্ভাবনা আছে তাও হারাবেন, তা এখন দেখার রইল। আগেই বলেছি, মাকাল হোসেনের ব্যক্তিগত ও দলীয় আনুগত্য আওয়ামী লীগের প্রতি কখনই ছিল না, এখনও নেই। এখন তিনি স্বরূপে ধরা পড়লেন। সংবাদ সম্মেলনেই তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার মামলায় তিনি আইনজীবী হিসেবে তার পক্ষে লড়বেন। এতদিন কেন তিনি খালেদা জিয়ার পক্ষে লড়েননি, কেবল পেছনে বসে আইনগত পরামর্শ দিয়েই চুপ থেকেছেন, তার কোন কৈফিয়ত তিনি দেননি। যাহোক এখন তিনি কচ্ছপের মতো কল্লা বের করেছেন, তা ভাল। শেখ হাসিনা যখন এক এগারোর সময় হাজতে বন্দী এবং তার বিরুদ্ধে বানোয়াট দুর্নীতির মামলা করা হয়েছে, তখন তিনি হাসিনার পক্ষ নিয়ে আদালতে দাঁড়াতে চাননি। কাগজে খবর বেরিয়েছিল, তিনি বলেছেন, আমি দুর্নীতিবাজদের পক্ষ নিয়ে আদালতে দাঁড়াব নাকি? শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হয়নি। কিন্তু এখন যে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে এবং তিনি দ-িত হয়েছেন, তার পক্ষে মাকাল হোসেন আদালতে দাঁড়াবেন। আশ্চর্য তার নীতিবোধ। এখন দেখার রইল কবে তিনি তারেক রহমানের পক্ষে ওকালত নামায় সই করেন। এই ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ আইনজীবী আদালতে দাঁড়ালেই মামলায় জেতেন, এটা সঠিক না মিথ্্? এই জয়লাভের প্রলোভন দেখিয়েই তিনি ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে মামলায় নামিয়েছিলেন। মামলায় পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে এই অর্ধ নোবেল জয়ীকে উঁচু মাথা নত করতে হয়েছিল। এখন দেখা যাক কী জাদুমন্ত্রে মাকাল হোসেন তার দ-িত রাজনৈতিক মক্কেলকে জেল থেকে মুক্ত করেন। ইতোপূর্বে কাদের সিদ্দিকী গত নির্বাচনের সময় দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে জিতে নিজে তালা খুলে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনব।’ এখন সেই কাদের সিদ্দিকীকে দূরবীণ দিয়ে রাজনীতির মাঠে খুঁজতে হয়। শেখ হাসিনাকে শাবাশ জানাই। এত কিছুর পরেও তার বিগ্ আঙ্কল মাকাল হোসেনকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের অনুষ্ঠাতে দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং তিনিও লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে শেখ হাসিনার পাশে এসে বসেছিলেন। এটা শেখ হাসিনার জন্য উদারতা। কিন্তু তার জন্য কী? [লন্ডন, ১৪ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০২০]
×