ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্রয়হীন বৃদ্ধ ও অনাথ শিশুদের নিয়ে ;###;কাজ করতে চাই;###;অয়ন চক্রবর্তী

পরিবর্তনের পরিক্রমায় ত্রিরত্ন

প্রকাশিত: ১২:১৭, ১৪ জানুয়ারি ২০২০

পরিবর্তনের পরিক্রমায় ত্রিরত্ন

তিন তরুণ ছাত্র। পড়াশোনার বাইরে তাদের এখন জগতজোড়া খ্যাতি। অয়ন চক্রবর্তী হয়েছেন তৃতীয় সেরা বাংলাবিদ, শুভ কর্মকার তৈরি করেছেন রোবট, প্রদীপ্ত সুন্দর সাহা শর্টফিল্ম বানিয়ে পেয়েছেন মিনা পুরস্কার। এই তিন কিশোরের দুর্দান্ত সব সফলতার গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান নতুন প্রজন্মের কাছে শুদ্ধ বাংলা, বানান ও ব্যবহার ছড়িয়ে দিতে ইস্পাহানি আয়োজন করে বাংলা প্রতিযোগিতা ‘ইস্পাহানি মির্জাপুর বাংলাবিদ’। এ প্রতিযোগিতায় শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার, বানান চর্চা, শুদ্ধ উচ্চারণ ও ব্যাকরণের সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় শেষে চূড়ান্ত বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়। ২০১৯ সালে এই প্রতিযোগিতায় বরিশালের অয়ন চক্রবর্তী সেরা তৃতীয় বাংলাবিদ হয়েছে। লেখাপড়ার পাশপাশি সে লেখালেখি, বিতর্ক, বক্তৃতা ও উপস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অয়ন। ‘এ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট’-এর জাতীয় পর্যায়ের রচনা প্রতিযোগিতা-২০১৮ এ অয়ন পুরুস্কৃত হয়েছে। ‘ন্যাশনাল নিউজপেপার অলিম্পিয়াড’-এ বিভাগীয় চ্যাম্পিয়নের মুকুট অর্জন করেছে অয়ন। শর্টফিল্ম নির্মাণের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছে অয়ন।। বাংলাবিদ হবার শুরুর দিকে তার ফলাফল ভাল ছিল না মোটেও । ২০১৮ সালের বিভাগীয় অডিশনে সেরা চল্লিশ এ তার জায়গা হয়নি। অয়নের মনে জেদ চেপে যায়। মনে মনে সে শপথ নিয়েছিলো ২০১৯ এ অন্তত বিভাগীয় পর্যায় টিকতেই হবে। সে কথাই শোনা গেলো অয়নের মুখে, ‘২০১৮ সালে বিভাগীয় অডিশনে টিকতে না পেরে মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম ২০১৯ এ অন্তত বিভাগীয় অডিশনে টিকতেই হবে।’ ২০১৯ এ সেরা ছয়ে অয়ন জায়গা করে নেয়। তার স্বপ্নের পরিধি তখন আরও বেড়ে যায়। স্বপ্ন ছিল দেশসেরা ২০ এ নির্বাচিত হবে। বরিশাল জিলা স্কুলের ১০ শ্রেণীর ছাত্র অয়ন। পরিবারের সকলে তাকে উৎসাহ অনুপ্রেরণা যোগায়। বিশেষ করে শিক্ষিকা শ্রদ্ধেয়া মণিকা রায় ঠাকুর সব সময় তার অনুপ্রেরণার বড় উৎস বলে অয়ন জানায়। বাংলাবিদ হবার প্রক্রিয়া খুব সহজ ছিলো না। বেশ কিছুদিন অয়নকে বাংলাবিদদের ক্যাম্পে থাকতে হয়। সে সময়টা তার জীবনের স্মরনীয় ছিল। অয়ন বলেন, ‘ বাংলাবিদের সুবাদে অনেক মহৎ ব্যক্তিদের সান্নিধ্য পেয়েছি ; সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। সবাই মিলে বিজয়া দশমীর দিন পূজা দেখতে গিয়েছি। অন্তিকা, সৌমিক, প্রাপ্তি, দিহান, সন্দীপন, ইমদাদ মতো বন্ধুদের কোনদিন ভুলতে পারব না।’ অয়ন মনে করেন সফলতার জন্য চেষ্টা করতে হবে। লেগে থাকতে হবে। চেষ্টা আর ¯্রষ্টার কৃপা অয়নের কাছে সফলতার মূল মন্ত্র। অবসর সময়ে অয়ন লেখালেখি করে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে তার ভালো লাগে। অবশ্য একটা উপন্যাস ও লেখার কাজ চলছে বলে জানায়। ছোটবেলা থেকেই বাংলা অয়নের পছন্দের বিষয়। যা বাংলাবিদ হতে অন্যদের চেয়ে তাকে এগিয়ে রেখেছে। যারা বাংলাকে ভালবাসে, তারা সবাই বাংলাবিদ। বাংলাবিদ হতে হলে বাংলা ভাষার উৎপত্তি, বাংলা ভাষার বিস্তার আরা অয়নের স্বপ্নটাও এদেরকে নিয়ে। অয়ন জানালো ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন আশ্রয়হীন বৃদ্ধ ও অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করার। অয়নের প্রিয় ব্যক্তিত্ব রমা চৌধুরী। কৃষকদের সহায়তায় এই রোবট কাজে লাগানো সম্ভব শুভ কর্মকার রোবট সোফিয়াকে দেখে তার ইচ্ছে হয়। এমন একটা রোবট সেও বানাবে। ইচ্ছেটা নিজের মধ্যে চেপে রাখে সে। চুপি চুপি কাজ করে এগোতে থাকে সে। শুরুটা ২০১৮ সালে। ২০১৯ এ এসে ছেলেটি সত্যিই একটি রোবট বানিয়ে ফেলে। সাড়া জাগানো এই রোবটের নাম রবিন। যিনি এটি তৈরি করেছেন তার নাম শুভ কর্মকার। শুভর বাড়ি বরিশালের আগৈলঝড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে। বাবা সন্তোষ কর্মকার ব্যবসায়ী এবং মা দীপ্তি কর্মকার গৃহিণী। মা-বাবার দুই সন্তানের মধ্যে শুভ বড়। দশম শ্রেনির ছাত্র শুভ ছোটকাল থেকেই মেবাধী। এত অল্প বয়সে জাতীয়,স্থানীয় পর্যায়ে অসংখ্য পুরুস্কার পেয়েছে । ২০১৮ সালে বিজ্ঞান চর্চায় জাতীয় পর্যায়ে ২য় হয়ে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পায় শুভ। ২০১৯ সালে ৪০ তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায়, এ বছরই সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ বিজ্ঞান বিষয়ে বিভাগীয় পর্র্যায়ে ১ম হয়ে সেরা মেধাবী পুরস্কার লাভ করে শুভ। শুভর রোবট অবিকল মানুষের মতো কথা বলে। বাংলা ইংরেজী দুই ভাষায়ই কথা বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির নামও বলতে পারে। শুভ জানাল, কল-কারখানা, বাসা-বাড়িতে আগুন লাগলে এই রোবট কাজ করতে পারবে। কৃষকদের সহায়তার কাজেও এই রোবট কাজে লাগানো সম্ভব হবে। রোবটটিকে আরও আধুনিকায়ন করার সুযোগ আছে। এ জন্য শুভ সরকারী-বেসরকারী সহযোগিতার প্রত্যাশা করেন। শুভ এর রোবটের নাম রবিন। এ বিষয়ে শুভ বলেন, আমেরিকার একটা কার্টুন শোর সুপার হিরোর নামানুসারে এই নাম দেওয়া হয় । রোবট তৈরি করার দক্ষতা, কারিগরি জ্ঞান কিভাবে পেলে জানতে চাইলে শুভ বলেন, ‘ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে এবং ইউটিউব থেকে বিভিন্ন ভিডিও দেখেই রোবট রবিনকে এভাবে তৈরি করতে পেরেছি। আগামীতে আমি একে আরও উন্নত করতে কাজ করছি। বর্তমানে তার দৃষ্টিশক্তি নেই, আগামীতে সে সকলকে দেখতে পারবে। সেই সঙ্গে কারও সঙ্গে একবার পরিচয় হলে তাকে পরবর্তীতে দেখলে চিনতে পারবে এবং বিভিন্ন সমস্যা নিজে দেখে সমাধান করতে পারবে। সব সময় শেখার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে যাওয়া উতি মিনা এ্যাওয়ার্ডজয়ী প্রদীপ্ত সুন্দর সাহা পাঁচ মিনিটের সংলাপ বিহীন শর্টফিল্ম সুপ্রভাত। শর্টফিল্ম সুপ্রভাত মূলত কিশোর বয়সের মনস্তাত্তিক সমস্যা নিয়ে ভোগা এক ছেলের গল্প! এই গল্পটা খুবই চেনা। চেনা গল্প যেন প্রদীপ্ত সুন্দর সাহার পরিচালনায় নতুনভাবে ধরা দিয়েছে। মানুষকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। ইউটিউবে এই শর্টফিল্মটি ছাড়ার পর ব্যাপক সাড়া পড়ে। ২০১৯ সালে মিনা পুরস্কার পেয়েছে প্রদীপ্ত সুন্দর সাহার সুপ্রভাত। প্রতিবছর ইউনিসেফ থেকে শিশুদের জন্য এবং শিশুদের করা গণমাধ্যমের বিভিন্ন বিভাগে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার দেয়া হয় । প্রদীপ্ত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছেন সরকারী সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে থেকে। প্রদীপ্ত এর বন্ধু তূর্য, সাফি। তিনজনে মিলেই তৈরি করেন সুপ্রভাত। তিনজনই বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রদীপ্ত এর মুখেই শোনা গেল সে কথা। তিনি বলেন, ‘তূর্য ধারাবাহিক গল্প বলা জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় দুইবার স্বর্ণপদক লাভ করেছে। সাফি খুব সুন্দর অভিনয় করে।’ তূর্য এই ছবিতে অভিনয় করেন। তূর্যের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন প্রদীপ্তর মা। সুপ্রভাত এর জন্য চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত ১২তম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছে প্রদীপ্ত। প্রদীপ্ত জানায়, ‘ছবিটি বেশ কিছু এক্সিবিশনে প্রদর্শিত হয়েছে। ঢাকা-ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফি সোসাইটির ফেস্টিভ্যালে অনারেবল মেনশন হয়, বিডিএস ডিবেটার অব দ্য ইয়ার হওয়াসহ আরও বেশকিছু স্বীকৃতি পেয়েছে। মাধ্যমিকে পড়ার সময় প্রদীপ্ত ইউটিউবে কাজ করার ভাবনা আনে। প্রদীপ্ত বলেন, ‘আমাদের এই চলচ্চিত্র বানানোর টিমের নাম হয় বীরপুরুষ।’ বীরপুরুষ নাম কেন জানতে চাইলে সে বলল, যে সময় পত্রিকার পাতায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের দুর্দশা নিয়ে লেখা হয় প্রতিদিন সে সময় আমরা স্বপ্ন দেখি এই চলচ্চিত্র নিয়েই কাজ করার, এ জন্যই বীরপুরুষ নামটা দেয়া। প্রচ- শীতে খালি গায়ে ফ্লোরে শোয়ার মতন অতিরিক্ত সাহস দেখানোর জন্য ব্যঙ্গাত্মকভাবে ছোটবেলায় আমার দিদা আমাকে বীরপুরুষ বলত। সেইখান থেকেই এই নামের অনুপ্রেরণা।। প্রদীপ্ত স্ট্রিট ফটোগ্রাফার হিসেবে ছবি তোলেন। কেবল শর্টফিল্ম নয়, স্থির ছবিগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাল সবুজ সোসাইটিতে প্রদীপ্ত সহ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। পথশিশুদের থেকে শুরু করে বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় প্রবীণদের নিয়ে কাজ করেছেন এক সময়। ময়লা ডাস্টবিনে ফেলা, গাছ লাগানোর জন্য ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজ করেন। বাদ্যযন্ত্র বাজানো, ম্যাজিক দেখানো তার শখ। এক সময় লেখালেখিও করতেন। মাছ, বিড়াল, কুকুর পুষছেন কিছুকাল। নিজের চিন্তাভাবনা গুলো চলচ্চিত্র - ছবি সহ অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে প্রকাশ করে বেঁচে থাকাই এখন প্রদীপ্তের স্বপ্ন। সবসময় শেখার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিৎ। আমি নিজেও সে চেষ্টাই করি। আর পুরষ্কার বা পরিচিতির আশায় কাজ না করে ভালোবেসে কাজ করা উচিত। এমনটাই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যারা ছবি তুলতে কিংবা চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের জন্য প্রদীপ্ত সুন্দর সাহার পরামর্শ। বরিশালের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লাল সবুজ সোসাইটি গত দুই নবেম্বর এই তিন তরুণকে সংবর্ধনা দেয়। বিজয়ের গল্প শিরোনামে এই অনুষ্ঠাতে শুভ, প্রদীপ্ত, অয়নরা তাদের সফলতার গল্পগুলো সকলের সঙ্গে শেয়ার করেন।
×