শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ শেষ পৌষের হিমশীতল বাতাসে দিগন্তজোড়া মাঠে আনমনে দোল খায় হলুদবর্ণ শর্ষে ফুল। সেই ফুলের রাজ্যে মৌমাছির গুঞ্জরণে এবারও মুখর অবারিত মাঠ। শর্ষের ফুল পুরো খেতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রজাপতি আর মৌ-লোভী মৌমাছিরা শীতের শিশিরভেজা ভোরে মাঠভর্তি হলুদ ফুলের ঘ্রাণে ঘ্রাণে দল বেঁধে ছুটে আসছে মধু আহরণের জন্য। এবার বাম্পার ফলনের আশায় কৃষকের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আনন্দের হাসি- যেন শর্ষে ফুলের হলুদাভ হাসিতে সুখ-স্বপ্ন দেখছে কৃষক।
ভোরের বিন্দু বিন্দু শিশির এখন হলুদ ফুলের শরীরজুড়ে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তার মতো ঝিলমিল শিশির-কণা পাতা গড়িয়ে নামে মাটিতে। সকালের মিষ্টি রোদ-ঝলমল করতে থাকে মাঠভর্তি হলুদ ফুলে। যতদূর চোখ যায় কেবল হলুদ আর হলুদ। ফসলের সবুজ মাঠ যেন হলুদ চাদরে ঢাকা। ধীরে ধীরে বেলা গড়িয়ে নামে বিকেল। বিকেলের ‘কন্যা-সুন্দর’ আলোয় হলুদ ফুলগুলো রূপ নেয় অন্য এক মাধুর্যে। মিষ্টি বাতাসে দোল খেতে থাকে ফুলের ডগাগুলো। দিগন্ত বিস্তৃত শর্ষের হলুদ ফুল-ফলে সেজে ওঠা সৌন্দর্যে মুগ্ধ কৃষকের চোখে-মুখে তাই নির্মল আনন্দের ঝিলিক।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে ১৫ ইউনিয়নে ৪২০ হেক্টর জমিতে শর্ষে আবাদ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। উপজেলা উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা রুহুল আমীন বলেন, চলতি বছর ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় চরাঞ্চলসহ ১৫ ইউনিয়নে সরিষার ভাল আবাদ হয়েছে। তিনি বলেন, খেতে শর্ষে উৎপাদন করলে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়, ইউরিয়া সারের সাশ্রয় হয়, শর্ষে খেত থেকে মধু উৎপাদন করা যায়। ভোজ্য তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, তাছাড়া শর্ষের খৈল জৈব সার ও গো-খাদ্যের উপকার করে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ টন তেল পাওয়া যায় শর্ষে থেকে। হলুদ রংয়ের এই ফুলে চারটি পাপড়ি থাকে। একটি সরিষা গাছের জীবনধারায় আনুমানিক ২শ’ ফুল ফোটে, একটি গাছ এক হাজার শস্যবীজ তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই গাছ ক্রুশিফেরাস গোত্রের অন্তর্ভুক্ত তেল উৎপাদক এক বর্ষজীবী প্রজাতির উদ্ভিদ। সাধারণত শীতকালে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে গ্রামের মাঠে মাঠে ব্রহ্মহ্মহ্মপুত্রের চরাঞ্চলে শর্ষে খেতের চোখ জুড়ানো নয়ানাভিরাম দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব জায়গাতেই এই ফসলটি উৎপাদন হয়। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধাসহ প্রায় সব জেলাতেই পরিমিত পরিমাণে শর্ষের তেল উৎপাদিত হয়। দেশের ঐতিহ্যগত ঘানিভাঙ্গা খাঁটি সরিষার তেল সবারই পছন্দ। একটা সময় ছিল গ্রামাঞ্চলের কলুর বাড়িতে গরুর চোখে পট্টি বেঁধে তেল টেনে শর্ষের বীজ থেকে খাঁটি তেল নিংড়াচ্ছে। এখন আর তা চোখে পড়ে না। বর্তমানে ঘানির বদলে বৈদ্যুতিক তেলকল চালু হয়েছে।
আমাদের দেশে প্রধানত শর্ষে থেকে ভোজ্যতেল উৎপাদন করা হয়। দেশে ভোজ্য তেলের মধ্যে সয়াবিন তেল প্রথম হলেও শর্ষের স্থান দ্বিতীয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এই তেলের ব্যবহার বহুলাংশে কমে গেছে।