ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একমণ ধানের দামে ২ কেজি বীজ

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১৪ জানুয়ারি ২০২০

একমণ ধানের দামে ২ কেজি বীজ

এমরানুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ ॥ হাওরের রাজধানী খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলায় বোরো ধান আবাদে এবার অনাগ্রহ কৃষককুল। জমি এখনও অনাবাদী। তবুও বোরো আবাদের এই ভরা মৌসুমে মাঠে যেতে আগ্রহ নেই আবু সুফিয়ানের। শুধু তিনিই নন। এই চিত্র এ বছর হাওরাঞ্চলের সর্বত্র। জানা গেছে, গেল বছরগুলোতে পরপর উৎপাদন খরচই তুলতে পারেনি। বরং ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। উৎপাদন খরচের তুলনায় উৎপাদিত ফসলের দাম কম হওয়ায় ক্রমেই বোরো আবাদে উৎসাহ হারাচ্ছেন এ জেলার কৃষক। যে কারণে বিপুল আয়তনের জমি অনাবাদী পড়ে থাকার শঙ্কা রয়েছে। একমণ ধানের বাজারদর বছরের এই সময়টাতে এসে যেখানে সর্বোচ্চ সাতশ’ টাকা, সেখানে এই ধান উৎপাদনের জন্য এক কেজি বীজ কিনতে কৃষককে ব্যয় করতে হচ্ছে সাড়ে তিনশ’ টাকা। এর সঙ্গে বীজতলা তৈরি, জমি চাষ, সেচ, আগাছা বাছাই, সার প্রয়োগ, ধান কাটা; সব হিসাব এক করলে বোরো ধান চাষ করে একজন কৃষকের লাভবান হওয়ার সুযোগ খুই একটা থাকে না। বোরো চাষীদের ব্যাপক প্রণোদনা, বীনামূলে সার, বীজ, কীটনাশক ও বিনাসুদে কৃষিঋণ এবং মৌসুম শেষে সরকারের তরফ থেকে ন্যায্যমূল্যে কৃষকের চাহিদা মাফিক ধান-চাল ক্রয় করা হলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় এবারও প্রায় সোয়া দুই লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। ৯ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এবার। এর বিপরীতে গত মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরকারের পক্ষ থেকে মাত্র ১৭ হাজার ৮২৩ মেট্রিকটন ধান এবং মিলারদের কাছে থেকে ৩১ হাজার ৯৭৪ মেট্রিকটন চাল কেনা হয়েছে, যা মোট উৎপাদিত ফসলের তুলনায় খুই কম। শতকরা হিসেবে যা ৩% এরও কম। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপতরের উপ-পরিচালক মোঃ সফর উদ্দিন বলেন, বোরো চাষের জন্য কৃষকদের সরকারের পক্ষ্য থেকে সরাসরি কোনও প্রণোদনা দেয়া হয় না। তবে কৃষকের সুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকার সারের দাম প্রতি কেজিতে ৯ টাকা করে কমিয়েছে। কৃষকরা জানান, বছরের এই সময়ে এসে বোরো আবাদের জন্য বীজতলা তৈরি করে বীজ বুনেন তারা। কিন্তু বছরের একটিমাত্র ফসলের ওপর নির্ভরশীল এই কৃষকরা ধান কাটার পর পর সেগুলো প্রয়োজন মেটাতে পানির দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে নতুন করে ফসল উৎপাদনের জন্য যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন সেটা সংকুলানের সামর্থ্য খুব কম কৃষকেরই রয়েছে। পাশাপাশি ফসল উৎপাদন করে বিগত বছরগুলোর ন্যায় আগামীতেও ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন কিনা সে আত্মবিশ্বাসও নেই কৃষকের মাঝে। যে কারণে বোরো আবাদে বছর বছর উৎসাহে ভাটা পড়ছে কৃষকের। অনেক হাওরে বোরো জমি অনাবাদী থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে, ধানের উৎপাদন খরচ বেশি ও বিক্রিমূল্য কম হওয়া বর্গাচাষী ও জমি বর্গা দেয়া গৃহস্থ দুই শ্রেণীই পড়েছেন বিপাকে। লাভ না হওয়ায় বর্গাচাষীরা জমি বর্গা নিতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে হাওরের প্রান্তিক ও গৃহস্থ পরিবারের ওপর। দিরাই উপজেলার ঘিলটিয়ার হাওরে নিজের বীজতলায় সেচ দিচ্ছিলেন দুর্গাপুর গ্রামের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কৃষক জয় সেন সরকার। জানালেন, ধানের দাম না থাকায় আমরার অবস্থা ডাইল (খুবই খারাপ অবস্থা)। ধান ৪শ’ থাকি বেচা শুরু করছিলাম, পরে সর্বোচ্চ ৬ থাকি সাড়ে ৬ শ’ টাকা। ধান বেচিয়াই (বিক্রিয়) তো আমরা নয়া কইরা হালচাষ করতাম। ধানের দাম না ফাইলে (পেলে) কেমনে কিতা করমু (কি করব)। আর জিনিসপত্রের যে দাম, ইটাও (এটাও তো) আমরার লাগি (আমাদের জন্য) সমস্যা। ২০ টেখার (টাকার) পিঁয়াজ কিনা লাগছে আড়াই শ’ টেখায়।’ এখনও দেড়শত টেখার উপরে। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, বোরো চাষীদের সুবিধার জন্য বিশেষ কোন প্রণোদনা প্যাকেজের প্রয়োজন হলে বিষয়টি আমরা সরকারকে জানাব। বরিশাল খোকন আহম্মেদ হীরা বরিশাল থেকে জানান, পৌষের দু’দফার প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্যের গুণগতমান ভাল না হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমনের দর পতনে কৃষককুল এখন দিশেহারা। বরিশালের বিভিন্ন হাটে ধানের গড় দাম এখন ছয় শ’ টাকারও নিচে। অথচ এবার আমন রোপণের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ এবং কর্তনের আগে ‘বুলবুল’ এর আঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের ধান চাষের ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেলেও ধানের দাম গত বছরের চেয়ে কম। সর্বশেষ গত শনিবার দক্ষিণাঞ্চলের ধানের পাইকারি হাটগুলোতে যে মূল্য পরিস্থিতি দেখা গেছে তাতে কৃষকের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। চরম দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে সকল কৃষকের চোখে-মুখে। সূত্রমতে, অগ্রহায়ণের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময়ে প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার বেগের ঝড়োহাওয়া বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলায় আঘাত হানে। ফলে এসব জেলার মাঠে থাকা কয়েক লাখ হেক্টর জমির উঠতি আমন ধান মাটিতে ফেলে দেয়ায় তা প্রবল বৃষ্টি আর জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হয়। বুলবুলের বয়ে আনা মেঘমালায় বরিশালে দেশের সর্বোচ্চ প্রায় ২৬৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে মাত্র পাঁচ ঘণ্টায়। ওই বর্ষণে আমনসহ প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমির ফসল বৃষ্টি আর জলোচ্ছ্বাসের পানিতে নিমজ্জিত হয়। পানি সরে যেতে সপ্তাহখানেকে সময় লাগলেও উঠতি আমনের বেশিরভাগ ধানই চিটা হয়ে যায়। এমনকি ধানের থোর পর্যায়ের গুণগত মানও বিনষ্ট হয়। জানা গেছে, সদ্য সমাপ্ত খরিপ-২ মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলায় আবাদকৃত সোয়া সাত লাখ হেক্টর জমিতে উৎপাদিত আমন থেকে ১৬ লাখ টনের বেশি চাল পাবার লক্ষ্য থাকলেও তা অর্জন নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে কৃষিবিদদের মধ্যে। বুলবুলের আঘাতে মাটিতে শুয়ে পড়া ধানের প্রায় পুরোটাই নিমজ্জিত হয়েছে বৃষ্টি আর বাড়তি জোয়ারের পানিতে। ফলে অনেক এলাকার ২৫-৩০ ভাগ ফসল কাটাই সম্ভব হয়নি। যে ফসল ঘরে উঠেছে তাতেও চিটার পরিমাণ বেশি। বুলবুলে ভর করে অগ্রহায়ণের ক্ষতিকর বর্ষণের পরে গত কয়েকদিনের অকাল বর্ষণেও ধানের আরও ক্ষতি হয়েছে। অনেক কৃষক ধান কাটলেও পৌষের বৃষ্টির কারণে তা শুকানো যাচ্ছে না। আর ধান বিক্রি করতে গিয়েও দাম মিলছে না। এবার দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিমণ আমনের উৎপাদন ব্যয় হয়েছে সাড়ে পাঁচ শ টাকারও বেশি। অথচ ধান হাটে পৌঁছানোর পরিবহন ব্যয়ের পরে দাম মিলছে সাড়ে পাঁচ শ’ থেকে ছয় শ’ টাকা। এ অবস্থায় সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন। খাদ্য অধিদফতর দক্ষিণাঞ্চলে যেসব শর্তে ধান কিনছে, তাতে কৃষকরা সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন না। তাদের নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে মধ্যবর্তী ফড়িয়াদের ওপরই। আর সেখানে দাম মিলছে ফড়িয়া সিন্ডিকেটের নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী। ফলে এবার মারাত্মক ক্ষতির কবলে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণ কৃষি ও কৃষক। এমনকি এবার বাজারে শীতকালীন সবজির দাম সাম্প্রতিককালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছলেও তাতে লাভবান হননি দক্ষিণাঞ্চলের কৃষক। কারণ সারাদেশের অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা দক্ষিণাঞ্চলে রবি মৌসুম শুরু হয় প্রায় দু’মাস বিলম্বে। যে কারণে বুলবুলের ছোবলে আগাম শীতকালীন সবজির পুরোটাই নষ্ট হয়ে কৃষকদের পরিপূর্ণভাবেই সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে। বরিশালের আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলার কৃষকরা জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের ছোবলে তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও এখনও তারা সরকারী কিংবা বেসরকারীভাবে কোন সহযোগিতাই পাননি।
×