ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুখ দিয়ে লিখে গ্র্যাজুয়েট হলেন হাফিজুর

প্রকাশিত: ১১:১১, ১৩ জানুয়ারি ২০২০

  মুখ দিয়ে লিখে গ্র্যাজুয়েট  হলেন  হাফিজুর

মামুন শেখ, জবি থেকে ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রথম সমাবর্তনে সহপাঠীরা যখন আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রিয় ক্যাম্পাসে, সেই আনন্দ মনে নিয়েও বিষাদ ছড়িয়ে পড়েছিল হাফিজুর রহমানের। জবির প্রথম সমাবর্তনে অংশ নেয়া আর সব গ্র্যাজুয়েটের মতো নয় তার জীবন। কারণ হাত-পা বিকলাঙ্গ হওয়ায় এই অদম্য তরুণ মুখ দিয়ে লিখেই স্নাতক-স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। প্রথমবারের মতো সমাবর্তন ঘিরে গ্র্যাজুয়েটদের পদচারণায় মুখরিত হয়েছিল জবি ক্যাম্পাস। নিজ নিজ বিভাগ থেকে যখন সবাই সমাবর্তনের উপহার সামগ্রী নিয়ে আনন্দভরা মন নিয়ে ফটোসেশন করছেন; সহপাঠীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতিচারণ করছেন, অন্যদের মতো এদিক ওদিকে ছুটতে পারেননি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের স্নাতোকত্তর করা হাফিজুর। সহপাঠীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে বাধা ছিল তার হাত-পা না থাকা। জন্ম থেকে বিকলাঙ্গ হাফিজুর ক্যাম্পাসের মূল ফটকের পাশে হুইলচেয়ারে বসে অপলক দৃষ্টিতে দেখে ছিলেন গ্র্যাজুয়েটদের। পরিচিতজনরা ছাড়াও অনেকে তাকে সমাবর্তনের গাউন, ক্যাপ পরা দেখে এগিয়ে এসেছিলেন ছবি তুলতে, কুশল বিনিময় করতে। আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষার সনদ নিয়ে যখন সবাই ছড়িয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন কর্মজীবনে প্রবেশের তখন হাফিজুরের মনে অজানা আতঙ্ক ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখনও চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেননি। সেই সুযোগ পাবেন কি না, কিভাবে পাবেন তাও অজানা। এর মধ্যেও প্রথম সমাবর্তন নিয়ে হাফিজুর রহমান উচ্ছ্বসিত তিনি বলেন, ‘অন্যদের মতো আমিও আনন্দিত। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও মানসিক শক্তির জোরে এবং শিক্ষক, সহপাঠীদের সহযোগিতায় উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ পেয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ পাব এই অনুভূতি বোঝানো যাবে না।’ যদি আমাকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন চাকরি দেয়া হয় তবে আমার ও আমার পরিবারের জন্য বড় উপকার হয়। আর অন্য কোথাও যদি কোন ব্যবস্থা হয় আমি আশা করি তাদের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হব। এক সময় সবাই বলত আমার পক্ষে উচ্চশিক্ষা নেয়া সম্ভব নয়, হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন পরিকল্পনা করতে। ১৯৯৩ সালে বগুড়া ধনুট থানার বেলকুচি গ্রামে জন্ম নেন হাফিজুর রহমান। বাবা মফিজউদ্দিন একজন কৃষক। মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট তিনি। সম্প্রতি পিতাকে হারিয়েছেন হাফিজুর রহমান। বিকল দুই হাত ও দুই পা নিয়ে ছোটবেলায় পিতার কাছেই ‘বর্ণ পরিচয়’ শেখা হাফিজুরের। পরে বাড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ব্র্যাক স্কুলে শুরু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন। সে সময় বেয়ারিংয়ের গাড়িতে করে সহপাঠীরা স্কুলে নিয়ে যেত তাকে। এভাবেই স্কুলে যাওয়া আসার মধ্যে ২০০৯ সালে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৪.১৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হন হাফিজুর। পরে ধনুট ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০১১ সালে এইচএসসিতে জিপিএ ৩.৬০ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। কোন প্রকার কোচিং ছাড়াই ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্র্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হন হাফিজুর। অচেনা এই নগরীতে একাকী লড়াই শুরু হয় তার। তিনি বলেন, আমি গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছি। সুস্থ ও স্বাভাবিক সহপাঠীদের থেকেও বেশ ভাল ফল করেছি। অনার্সে সিজিপিএ -৪ এর মধ্যে পেয়েছেন জিপিএ ৩.০১। মাস্টার্সে পেয়েছেন জিপিএ-৩.০৬। তার এই রেজাল্টে খুশি বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্দেশে হাফিজুর বলেন, ‘আমাদের উচিত লক্ষ স্থির করা। তাহলে আমরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকব না। আমরা প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের মতোই অংশগ্রহণ করতে চাই। আর মস্তিষ্ক যদি কারও প্রতিবন্ধী না হয় তাহলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কিছুই নয়।
×