ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতা পূর্ণতা পেল যেদিন

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ১৩ জানুয়ারি ২০২০

 স্বাধীনতা পূর্ণতা পেল যেদিন

বাঙালী জাতির জীবনে ১০ জানুয়ারি একটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের এই দিনে তাঁর স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। তিনি এসেছিলেন বলেই অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। শত্রুর হাতে বন্দী বাঙালী জাতির মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন কোথায়, তিনি কেমন আছেন, তা পাকিস্তান সরকার ছাড়া আর কারও জানা ছিল না। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়ের পর বাংলার জনগণ নবীন রাষ্ট্রের জনককে দেখার জন্য উতলা হয়ে ওঠে। বিশ্ব জনমতও তখন মুজিবের পক্ষে। শুধু বাংলা নয়, সমগ্র বিশ্বে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। পরাজয়ের পর পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জে. ইয়াহিয়া খান পদচ্যুত হন। পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্রে জে. ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে কে বেশি দায়ী তার বিচার ইতিহাস একদিন অবশ্যই করবে। পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী বাঙালীর মহান নেতা শেখ মুজিব তখনও জানতে পারেননি, ১৬ ডিসেম্বর তাঁর বাংলা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছে।’ শেখ মুজিবকে ২৫ মার্চ ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ১ এপ্রিল পর্যন্ত সেনানিবাসে রাখা হয়। এরপর করাচী হয়ে মিয়ানওয়ালী জেলে আটক রাখা হয় তাঁকে। আগস্টে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়। বিচারে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলো শেখ মুজিবকে। বিশ্ব জনমতের চাপে এবং অন্য একটি কারণে শেখ মুজিবের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করেনি পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ আরও অনেক বিশ্ব নেতা শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর জীবন রক্ষার দাবি জানান। ২৬ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালী জেলখানা থেকে মুজিবকে সিহালা রেস্ট হাউসে আনা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঐ রেস্ট হাউসে গিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ২৭ ডিসেম্বর ড. কামাল হোসেনকে আনা হয় ওই রেস্ট হাউসে। পরে জানা গেছে, জেলে শেখ মুজিবের সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে জেলের ডিআইজি শেখ আবদুর রশিদ শেখ মুজিবকে জেলখানা থেকে নিজ বাসস্থানে নিয়ে যান। ডিআইজির বাসভবন থেকেই ভুট্টোর নির্দেশে মুজিবকে রেস্ট হাউসে স্থানান্তর করা হয়। আসলে বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করা পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা অফিসার ও জোয়ানকে ফেরত নেয়ার তাগিদ থেকেই মুজিবকে দ্রুততার সঙ্গে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ভুট্টো। ৩ জানুয়ারি ১৯৭২ করাচীর নিশতার পার্কের জনসভায় ভুট্টো ঘোষণা করেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তিদান করা হবে।’ ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত ভুট্টোর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল শেখ মুজিবের কাছ থেকে একটি প্রতিশ্রুতি আদায় করা। সেই প্রতিশ্রুতিটি হলোÑ ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি জোড়াতালির সম্পর্ক বজায় রাখা।’ কিন্তু ভুট্টোর শত আবেদন-নিবেদনে কাবু হননি মুজিব। শেখ মুজিবের এক কথা- ‘আগে আমাকে আমার জনগণের কাছে যেতে দাও। বাংলাদেশে না গিয়ে এ ব্যাপারে আমি কোন কথাই বলতে পারব না।’ মুজিব নেতৃত্বের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে সংযত রাখা এবং মৃত্যুর মুখেও সিদ্ধান্তে অটল থাকা। পাকিস্তানী জান্তা শত প্রলোভন এবং ফাঁসির ভয় দেখিয়েও বন্দী জীবনের নয় মাসে শেখ মুজিবের কাছ থেকে কোন কথা আদায় করতে পারেনি। জেলে আটক অবস্থায় প্রহরীদের সালামের জবাব দেয়া ছাড়া কোন কথাই তিনি বলেননি ওই দুঃসহ বন্দী জীবনে। ৭ জানুয়ারি মধ্য রাতের পর শেখ মুজিবকে বহনকারী বিশেষ বিমানটি পিন্ডি ত্যাগ করে। সঙ্গে স্ত্রী ও কন্যাসহ ড. কামাল হোসেন। সদ্য স্বাধীন দেশের জনক শেখ মুজিব ওই সময় বিশ্ব নেতা। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানযোগে লন্ডন আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে।’ সকাল ৮টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে লন্ডনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ক্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসে ‘গুড মর্নিং মি. প্রেসিডেন্ট’ বলে সম্ভাষণ জানান। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির কথা শুনে হাজার হাজার বাঙালী হোটেল ঘিরে ‘জয় বাংলা, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিতে দিতে আকাশ-বাতাস মুখর করে তোলে। দুপুরের দিকে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এক মুহূর্তের জন্য আমি বাংলাদেশের কথা ভুলিনি। আমি জানতাম, ওরা আমাকে হত্যা করবে। আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাব না, কিন্তু আমার জনগণ মুক্তি অর্জন করবেÑ এ ব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না।’ বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ছিলেন লন্ডনের বাইরে। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী বাতিল করে প্রধানমন্ত্রী হীথ ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ছুটে আসেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর রুপালি কমেট বিমানে চড়ে ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টায় দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে নামলে রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও সে দেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার এই যাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, করেছেন বীরোচিত আত্মত্যাগ।’ দিল্লী থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কমেট এর পরিবর্তে ভারতের রাষ্ট্রপতির সরকারী বিমান রাজহংসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে ঢাকায় আসার অনুরোধ জানানো হয়। এমনকি সকলের মালামাল স্থানান্তরিত করা হয় রাজহংসে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ কমেটেই বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরেন। দিল্লী থেকে ঢাকায় সফরসঙ্গী ফারুক চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে’ লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ব্রিটিশ সরকার বিশেষ সৌজন্যমূলক ব্যবস্থায় যে বিমানটি দিয়েছেন মাঝপথে অকারণে তা বদল করা সমীচীন হতো না।’ ১০ জানুয়ারি ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ মানুষ জাতির জনককে সংম্বর্ধনা জানায়। এই ময়দানেই প্রায় দশ মাস আগে (৭ মার্চ ১৯৭১) তিনি বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে প্রবল প্রতাপশালী পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ প্রাণপণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। মুজিব নেতৃত্বের আরও একটা বৈশিষ্ট্য যে, ‘১৯৭১ সালে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ৯ মাসের যুদ্ধে অল্পসংখ্যক কুলাঙ্গার রাজাকার ছাড়া প্রায় শতভাগ মানুষ স্বাধীতা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেয়।’ তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু ’৭১ সালে শত্রুর কারাগারে বন্দী থাকলেও মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর নামেই যুদ্ধ করেছেন এবং হাসতে হাসতে জয়বাংলা বলে জীবন দিয়েছেন। অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব ইতিহাসে আরেকটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুজিবের মুক্তি, লন্ডনে একদিন অবস্থান শেষে দিল্লী হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এমন আলোড়ন সৃষ্টিকারী, প্রেরণাময় ও ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ। ১০ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠককালে শেখ মুজিব এই প্রতিশ্রুতিও আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তিনি যখন চাইবেন, ভারতীয় সৈন্য তখনই বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে। শেখ পর্যন্ত তাই হয়। ১৯৭২-এর ১২ মার্চের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তাদানকারী ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। বঙ্গবন্ধু ওই সময় স্বদেশে আসতে না পারলে এত তাড়াতাড়ি ভারতীয় সৈন্য চলে যাওয়ার পরিস্থিতি হয়ত সৃষ্টি হতো না। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলেও বাংলার মানুষের কাছে স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসায় জনগণ স্বস্তি লাভ করে এবং স্বাধীনতাও পূর্ণতা পায়। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষক
×