ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বছরের পর বছর পড়ে আছে মর্গে;###;বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিই মূলত বাধা বলে মনে করা হচ্ছে

স্বামীর মরদেহ নিয়ে দুই ধর্মের দুই স্ত্রীর টানাহেঁচড়া

প্রকাশিত: ১১:১৪, ১২ জানুয়ারি ২০২০

স্বামীর মরদেহ নিয়ে দুই ধর্মের দুই স্ত্রীর টানাহেঁচড়া

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ খোকন চৌধুরীসহ দুই বাংলাদেশী ও দুই বিদেশীর লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পড়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। এদের লাশ আর কত দিন মর্গে থাকবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। আইনী জটিলতায় মরদেহগুলো বেওয়ারিশ হিসেবে মর্গে হিমঘরে পড়ে আছে। এ অবস্থায় এই চার লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েছে দেশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসা কেন্দ্র ঢামেক ফরেনসিক বিভাগ। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সোহেল মাহমুদ জনকণ্ঠকে জানান, দীর্ঘ সাড়ে ৫ বছর দুই বাংলাদেশী ও দুই বিদেশীর লাশ পড়ে আছে মর্গের হিমগরে। এতে করে মর্গের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এসব লাশের গ্যাসে মর্গের ফ্রিজ নষ্ট হচ্ছে। অন্য মরদেহের ওপর প্রভাব পড়ছে। এসব লাশের গ্যাসে মর্গের আশপাশের পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। চারটি লাশ রাখার স্থান নষ্ট হচ্ছে। আদালত অচিরে সুরাহা করলে আমাদের জন্য ভাল হয় বলে জানান ডাঃ সোহেল মাহমুদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মৃত্যুর পর ৫ বছর ৬ মাস ১৫ দিন ধরে খোকন ওরফে খোকন নন্দী ওরফে খোকন চৌধুরী ওরফে খোকা চৌধুরী ওরফে রাজীব চৌধুরীর লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গের হিমঘরে পড়ে রয়েছে। দুই ধর্মের দুই স্ত্রী স্বামীর লাশের দাবিদার। প্রথম স্ত্রীর দাবি, খোকন নন্দী ছিলেন সনাতন ধর্মের অনুসারী। সে অনুযায়ী তার মরদেহ সৎকার করা হবে এবং তার সম্পদের উত্তরাধিকারীও তারা। দ্বিতীয় স্ত্রী বলছেন, খোকন এ্যাফিডেভিট করে সনাতন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। তার মরদেহ দাফন করা হবে। এ নিয়ে আদালত এখনও সিদ্ধান্ত দেয়নি। এর অপেক্ষায় এখন দুই পরিবার। এদিকে খোকনের মৃতদেহ নিয়ে বিপাকে রয়েছে ঢামেক হাসপাতাল মর্গ কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালের ১৫ জুন দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আক্তার ওরফে বাবলির বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে খোকন চৌধুরীকে (৬৮) বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৬ জুন তিনি মারা যান। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে স্বামীর মরদেহ দাফনের উদ্যোগ নেন বাবলি। এতে বাধা দেয় খোকনের প্রথম স্ত্রী মীরা নন্দী। সনাতন রীতি অনুযায়ী সৎকারের জন্য মরদেহ নিয়ে যেতে চান তারা। এই প্রেক্ষাপটে ঘটনাস্থলে যায় রমনা থানার পুলিশ। পরে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। প্রথমে তার লাশ বারডেমের হিমঘরে রাখা হয়। সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় বারডেম কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানায় আদালতে। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর সহকারী জজ আদালত (দেওয়ানি ২৫২/১৪ ঢাকা) এক আদেশে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ও তদারকিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মরচুয়ারিতে লাশটি সংরক্ষণের আদেশ দেয়। ১৫ নবেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ লাশটি গ্রহণ করে। এখন পর্যন্ত লাশটি সেখানেই আছে। এ বিষয়ে শনিবার বিকেলে খোকন নন্দীর দ্বিতীয় স্ত্রী ষাটোর্ধ হাবিবা আক্তার খানমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, তার স্বামী খোকনের লাশ সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ঢামেক মর্গে ফ্রিজে পড়ে রয়েছে। আদালত এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না লাশ কে পাবে। লাশটি এতদিন মর্গের হিমঘরে পড়ে আছে। লাশ গলে শুকিয়ে যাচ্ছে। এটি তো কোন সম্পত্তি নয়। আমি এর সুরাহা চাই। ওকে আর কষ্ট দেবেন না। লাশ তো আর সম্পত্তি নয়। এ বিষয়ে আমি মানসিক অশান্তিতে আছি। মৃত্যুর আগে ওর লাশ দাফন করতে চাই বলে সংশ্লিষ্টদের কাছে আর্জি জানান। তিনি জানান, ওই পক্ষ আদালতের কাছ থেকে বারবার সময় চেয়ে নিয়ে সময় ক্ষেপণ করছে। হাবিবা জানান, গত নবেম্বর মাসে ঢামেক মর্গে গিয়ে স্বামীর লাশ দেখে এসেছি। লাশ গলে যাচ্ছে। শুকিয়ে গেছে। ওই পক্ষ কিন্তু এখন পর্যন্ত লাশ দেখতেও যায়নি। তারা চাইছে, সময় নষ্ট করতে করতে আমি মারা গেলে সম্পত্তি ভোগ দখল করবে। আমার কোন সন্তান নেই। ফলে তাদের আর কোন সমস্যাই হবে না। আমাদের যে ধর্মীয় রীতিতে বিয়ে হয়েছিল। সে সংক্রান্ত নথিসহ বিভিন্ন সাক্ষী আদালতের কাছে হাজির করেছি। রাজধানীর কাকরাইল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে দুই বছর আগে অবসর নেয়া শিক্ষক হাবিবা আক্তার অভিযোগ করেন, স্বামী বিভিন্ন সময় বলেছেন, তার একটি মেয়ে আছে। কখনও ছেলে আছে বলেননি। স্বামীর মৃত্যুর পর এখন ছেলেও হাজির হয়েছেন। ফার্মগেটের ক্যাপিটাল সুপার মার্কেটসহ স্বামীর অনেক সম্পত্তি ছিল। তবে আসলেই সে সম্পত্তির পরিমাণ কত, তা জানি না। তবে স্বামী খোকন মৃত্যুর আগে ফার্মগেটের ক্যাপিটাল সুপার মার্কেট তার নামে লিখে দেয়ার জন্য অছিয়ত করে গেছেন। ওই মার্কেটে তখন চতুর্থতলার নির্মাণ কাজ চলছিল। তবে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত স্বামী তার আগের পক্ষের স্ত্রী বা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে স্বামীর এক ভাই ওই পক্ষকে খবর দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বারডেম হাসপাতালে লাশ নিয়ে টানাটানি শুরু হলে রমনা থানা থেকে পুলিশ আসে। তারপর তো এত ঘটনা। হাবিবা জানান, বারডেম হাসপাতালে খোকনের লাশ হিমঘরে রাখা বাবদ বিল হয়েছিল ২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। আদালতের আদেশে যে স্ত্রী স্বামীর লাশ পাবেন, তাকেই এ বিল পরিশোধ করতে হবে। এ নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন হাবিবা। তিনি জানান, লাশ পেলে এত টাকা আমি কোথা থেকে পরিশোধ করব। কেননা স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ক্ষমতার দাপটে স্বামীর ভাই, আগের পক্ষের স্ত্রী ও অন্যরাই তার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ভোগ দখল করছেন। হাবিবা জানান, খোকনের এক ভাইয়ের সঙ্গে তার প্রথম স্ত্রীর অবৈধ সম্পর্ক ছিল। পারিবারিক অশান্তির কারণে ওই সংসার ত্যাগ করেন তিনি। এমনকি তার ছেলে বাবলুকে কোন দিন সন্তান বলে স্বীকার করেননি। তবে চন্দনাকে নিজের মেয়ে বলে স্বীকার করতেন। তিনি জানান, বাবলুকে খোকন সন্তান হিসেবে অস্বীকার করতেন, বিষয়টি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব। কিন্তু তারা বাবলুর ডিএনএ টেস্ট করাতে রাজি হচ্ছে না। খোকন চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী হাবিবা আক্তার খানম জানান, পল্টনে এক চটপটির দোকানে পরিচয়ের পর ১৯৮৪ সালের ১৫ জুলাই খোকনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আর বিয়ের আগে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এ্যাফিডেভিট করে খোকন নন্দী ধর্মান্তরিত হন। নাম রাখেন খোকন চৌধুরী। তাদের বিয়ের কাবিননামা ও এ্যাফিডেভিট আছে। আদালতে সব নথিপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। হাবিবা জানান, খোকন জীবিত থাকার সময় তার চার ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই হিরালাল নন্দী, শান্তি নন্দী ও সাগর নন্দী উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায় যাতায়াত করতেন। শ্বশুরবাড়ির অন্য আত্মীয়রাও আসতেন। স্থানীয় লোকজন খোকন চৌধুরীকে মুসলমান হিসেবেই জানতেন। খোকা ভাই নামে ডাকতেন। শাহজাহানপুরের বাসায় তারা ১৮ বছর ছিলেন। তাদের কোন সন্তান নেই। তিনি জানান, খোকনের লাশ পড়ে থাকার মূল কারণ ধর্মীয় নয়। বরং সম্পত্তি দখল। তার প্রথম স্ত্রীর লোকজন ও ভাইয়েরা আদালতে শুধু সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করেন। তারা মার্কেটের ভাড়া তোলে, ইচ্ছেমতো অগ্রিম নিয়ে দোকানপাট ভাড়া দেয়। অথচ তার লাশটি সাড়ে পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে। সেটা দাফনের বিষয়ে কারও কোন উদ্যোগ নেই। তিনি জানান, আদালতে তার পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে প্রথম স্ত্রীর পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। বাবলুকে খোকন সন্তান হিসেবে অস্বীকার করতেন, বিষয়টি ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব। কিন্তু তারা বাবলুর ডিএনএ টেস্ট করাতে রাজি হচ্ছেন না। ধর্মান্তরিত হলেও ব্যবসার প্রয়োজনে খোকন তার আগের নাম খোকন নন্দীই ব্যবহার করতেন। বাবলি জানান, আমি এখনও অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছি। তাই মৃত্যুর আগে স্বামী খোকনের মরদেহ তিনি দাফন করতে চান। এ বিষয়টি দ্রুত সুরাহার জন্য সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধও জানান তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই পরিবারের দাবি ও মরদেহ নিয়ে টানাহেঁচড়ার মধ্যে ধর্মীয় বিষয়ের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বিপুল সম্পত্তি। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় তিনতলা মার্কেটসহ শত কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির মালিক ছিলেন খোকন। এই সম্পত্তি দখলে রাখতে প্রথম স্ত্রী ও তার ছেলেমেয়ে ব্যাপক তৎপর। শেষ দিকে রাজধানীর উত্তর শাহজাহানপুরে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। ওই এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তেন। ঈদ-উল-আজহার সময় গরু কোরবানি করে এলাকায় মাংসও বিতরণ করতেন তিনি। এদিকে ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের গোলচত্বর এলাকায় পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে অজ্ঞাত (২৫) এক পুরুষ নিহত হয়েছে। পরে তার লাশ উদ্ধার করে ঢামেক মর্গে পাঠানো হয়। পরে ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। এরপর দুই বছর ১০ মাস ধরে মর্গে হিমঘরে এই জঙ্গীর লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে রয়েছে। এদিকে আত্মঘাতী এই হামলার পর এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ঘটনার পরই তৎকালীন ডিএমপির কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে সাংবাদিকদের জানান, এটি হামলার কোন ঘটনা নয়। বোমা বহনকারী ব্যক্তি অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে গেলে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তার মৃত্যু হয়। ডিএমপির কমিশনার বলেন, এ ঘটনায় বোমা বহনকারী ব্যক্তি ছাড়া কেউ হতাহত হননি। নিজের কাছে থাকা বোমা বিস্ফোরণ হলে ওই ব্যক্তি নিহত হন। এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, বিমানবন্দরে হামলার পরিকল্পনা ছিল না ওই ব্যক্তির। কারণ তিনি পূর্ব দিক থেকে এসে হেঁটে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিলেন। বিমানবন্দরে হামলার পরিকল্পনা থাকলে হামলাকারী ওই পথে যেতেন না। আরেক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার জানান, আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা থাকলে হামলাকারী দ্রুত পুলিশ বক্সে থাকা পুলিশ সদস্যদের কাছে চলে যেতেন। কিন্তু হামলাকারী সেটা করেননি। বছরের পর বছর দুই বিদেশীর লাশ মর্গে পড়ে আছে দুই বিদেশীর লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) মর্গে পড়ে আছে দীর্ঘ দিন। এদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক থিইসিয়া সিকেওয়েস্ট ওরফে তিশা জামানের লাশ ৩ বছর ১০ মাস ১৭ দিন ধরে পড়ে আছে। আর মার্কিন নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কেটের লাশ পড়ে আছে ১ বছর ৭ মাস ১৬ দিন। এদের লাশ আরও কত দিন মর্গে থাকবে সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। আইনী জটিলতায় মরদেহগুলো আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকেও দেয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দুই বিদেশীর লাশ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ঢামেক হাসপাতাল মর্গ-সংশ্লিষ্টরা। দুই লাশের দুই ধরনের ঝামেলায় শীঘ্রই কোন সুরাহা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। এদের একজন হলেন মার্কিন নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কেট এবং অপরজন হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক থিইসিয়া সিকেওয়েস্ট। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে আসা থিইসিয়া সিকেওয়েস্ট ওরফে তিশা জামান এবং ২০১৮ সালের ২৫ মে রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে আসা রবার্ট মাইরন বার্কেটের লাশ ঢামেক মর্গে পড়ে আছে। এ বিষয়ে ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ জনকণ্ঠকে জানান, দীর্ঘদিন দুই বিদেশীর লাশ পড়ে থাকায় গ্যাস বের হয়ে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আর এই লাশের জন্য আমাদের দৈনন্দিন কাজেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। আদালত অচিরেই সুরাহা করলে আমাদের ভাল হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমেরিকান নাগরিক রবার্ট মাইরন বার্কেট একটি এনজিওর প্রতিনিধি হয়ে ২০০৫ সালে বাংলাদেশে আসেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। শিশুদের খাওয়া, চিকিৎসা, শিক্ষার সুযোগ করে দিতেন। অসুস্থ এক শিশুকে চিকিৎসা দিতে উত্তরা কমিউনিটি হাসপাতালে যান। তখন হাসপাতালে কর্মরত ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা মাজেদা বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ২০০৭ সালে তারা বিয়ে করেন। প্রথম দিকে তিনি বাংলা বলতে না পারলেও মাজেদা বেগম তাকে বাংলা ভাষায় পারদর্শী করে তোলেন। এক পর্যায়ে মাজেদা বেগম চাকরি ছেড়ে সংসারে মন দেন। স্বামী রবার্ট মাইরন বার্কেটকে নিয়ে দক্ষিণখানের চালাবন্দ মাটির মসজিদ এলাকার ৭৩৯/১ নম্বর বাড়িতে ভালই চলছিল তাদের সংসার। আমেরিকায় রবার্ট বার্কেটের পরিবার থাকলেও সেখানে তিনি আর ফিরে যাননি। ২০১৮ সালের ২৫ মে বার্কেট ব্রেন স্ট্রোক করেন। তাকে দক্ষিণখানের কেসি হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন ২৬ মে ঢামেক মর্গে তার লাশের ময়নাতদন্ত হয়। এরপর থেকে আমেরিকান নাগরিক রবার্টের লাশ ঢামেক মর্গের হিমঘরে পড়ে আছে। রবার্ট মাইরন বার্কেটের স্ত্রী মাজেদা বেগম জানান, স্বামী রবার্টের লাশ সৎকারের জন্য ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসে যোগাযোগ করেছেন। তারা বলেছে, আমেরিকায় বসবাসরত রবার্টের পরিবার থেকে কোন সিদ্ধান্ত না এলে লাশ দেয়া হবে না। রবার্টের মৃত্যুর পর থেকে আমেরিকান দূতাবাসে একাধিকবার যোগাযোগ করে যাচ্ছেন মাজেদা বেগম। কিন্তু সাড়া না পাওয়ায় তার লাশ সৎকারও করা যাচ্ছে না। এদিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার দেবিপুর গ্রামের হাসানুজ্জামান রিপন কাজের সন্ধানে বেশ কয়েক বছর আগে পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকান তরুণী থিইসিয়া সিকেওয়েস্টের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে বিয়ে করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের নাম রাখেন তিশা জামান। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি বাংলাদেশে আসেন তিশা। একমাত্র ছেলের বউ ভিনদেশী হওয়ায় মেনে নিতে পারছিলেন না হাসানুজ্জামানের বাবা-মা। তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই সংসারে ঝগড়া-বিবাদ শুরু হয়। স্বামীকে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে যেতে চান তিশা। কিন্তু হাসানুজ্জামান আর দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে রাজি হননি। ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিশা কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিশা। সেই থেকে তিশা জামানের লাশ ঢামেক মর্গের হিমঘরে পড়ে আছে। ঢামেক মর্গ সহকারী সেকেন্দার আলী জানান, লাশটি রাখার পর কেউ খোঁজ নিতে আসেননি। হাসানুজ্জামানের পরিবারের দাবি, তিশা কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেন। তবে পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে চৌদ্দগ্রাম থানায় মামলা করেন। তিশার স্বামী হাসানুজ্জামানকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে তিনি জামিনে আছেন। এ মামলায় দুই মাসের মাথায় চার্জশীট দেয়া হয়। পুলিশ বলছে, বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস না থাকায় তিশার লাশের দাফন নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতে দক্ষিণ আফ্রিকার দূতাবাস রয়েছে। সেখানে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চিঠি দিয়েও কোন সাড়া পাননি। মামলাটি এখনও বিচারাধীন। আদালতের নির্দেশ পেলে এ বিষয়ে সমাধানে আসা যাবে। দুটি লাশ নিয়ে মর্গকর্মী রামু জানান, ১ বছর ৭ মাস ১৬ দিন ধরে রবার্টের লাশ ঢামেক মর্গে ফ্রিজে আছে। আর ৩ বছর ১০ মাস ১৭ দিন ধরে থিইসিয়া ওরফে তিশা জামানের লাশ ফ্রিজে আছে। রামু জানান, লাশ দুটি যদি নিজ নিজ দেশে পাঠাতে হয় সে ক্ষেত্রে আইনী জটিলতা শেষে মেডিসিন ব্যবহার করে পাঠাতে হবে। তবে ফ্রিজে থাকায় দিন দিন লাশগুলো শুকিয়ে সরু হচ্ছে।
×