ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণিল আলোকচ্ছটায় নাচ গান কবিতায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ

প্রকাশিত: ১১:১২, ১২ জানুয়ারি ২০২০

বর্ণিল আলোকচ্ছটায় নাচ গান কবিতায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ

মনোয়ার হোসেন ॥ জেগে ওঠে রাতের ঢাকা। ছড়িয়ে যায় সংস্কৃতির স্রোতধারা। স্বদেশের গানে গানে এগিয়ে যায় আনন্দ আয়োজন। সুরের পথরেখায় নিবেদিত জাতির পিতার প্রতি অপার ভালবাসার নির্দেশ। এরই মাঝে আতশবাজির আলোকচ্ছটায় শহরের আকাশে দৃশ্যমান হয় রঙিন আবহ। লাল-নীলসহ অজস্র রঙের মাঝেও প্রকাশিত হয় সমৃদ্ধির অদম্য অগ্রযাত্রা। যে সমৃদ্ধির বীজ বপন করেছিলেন স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার দৃশ্যকল্পময় ক্যানভাসে অনুষ্ঠানটি পরিণত হলো। শনিবার হিমেল হাওয়ার কনকনে ঠান্ডার রাতে মুজিবের মুখচ্ছবিময় আয়োজন হয় রাজধানীর হাতিরঝিলের এ্যাম্পিথিয়েটারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের আগাম উদ্যাপনের অংশ ছিল এ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শন ও তার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে রূপরেখা মেলে ধরা হয় অনুষ্ঠানে। নাচে গানে আর চোখ ধাঁধানো আতশবাজিতে ভেসে ওঠে নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। ক্রমাগত এগিয়ে চলার সেই দৃশ্যমানতার মাঝে ৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ বিশ রাষ্ট্রের একটিতে পরিণত হওয়ার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ইআরডি। ঢাকার পাশাপাশি শোভাযাত্রা, আলোচনাসহ নানা আয়োজনে সারাদেশের ৪৯১ উপজেলায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের প্রারম্ভিক উদ্যাপনের কথা জানায়। হাতিরঝিলের অনুষ্ঠানটি এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে ওসব উপজেলায় দর্শকদের দেখার ব্যবস্থা করা হয়। আর রাত নয়টার দিকে ঢাকার আকাশের মতোই উপজেলাগুলোর আকাশও রঙিন হয়েছে আতশবাজির ঝলকানিতে। সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের-এমন দৃঢ় প্রত্যয়ী উচ্চারণ ছিল অনুষ্ঠান জুড়ে। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু হওয়া মুজিববর্ষের এই অগ্রিম আয়োজন চলে রাত সাড়ে নয়টা অবধি। সময় অনুষ্ঠানটি উপভোগে রাজধানীর নানা প্রান্তের থেকে কয়েক হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন হাতিরঝিলে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়নে দেশের নিরবচ্ছিন্ন এগিয়ে চলার নানা তথ্য উঠে আসে তার বক্তব্যে। পাশাপাশি ডিজিটাল স্ক্রিনে উপস্থাপিত হয়েছে সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা পাওয়া রাষ্ট্রটির শিল্প-বিপ্লবের পানে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনার কথা। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক ও ব্যবসায়িক সূচকে দেশের ক্রমাগত এগিয়ে চলার তথ্য তুলে ধরা। স্বপ্নের পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্যচিত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছে নতুন স্বপ্নের বাংলাদেশ। সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। পরিবেশিত হয় দেশ, মাটি ও মানুষের কথা বলা দেশাত্মকবোধক সঙ্গীত। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের সুরে অনুষ্ঠানের সূচনা। সুললিত ও চর্চিত কণ্ঠে গেয়ে শোনান ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’। খ্যাতিমান নজরুল সঙ্গীত শিল্পী সুজিত মুস্তাফার কণ্ঠে ছিল মাতৃভূমির বন্দনা। শুনিয়েছেন ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের সুরে নয়ন জুড়ানো নৃত্য পরিবেশন করেন বিদ্যা সিনহা মীম। কোরিওগ্রাফির আশ্রয়ে চমৎকারভাবে উঠে আসে বায়ান্ন থেকে একাত্তরের সংগ্রামী অধ্যায়। দলীয় নৃত্যভিত্তিক সেই কোরিওগ্রাফিতে মাঝিরা নৌকা বেয়ে যায় আর আলোকিত নৌকার ঝাঁক ঘুরে বেড়ায় মঞ্চজুড়ে। গানে গানে লাল-সবুজের বাংলাদেশের কথা শুনিয়েছেন ফাহমিদা নবী। গেয়েছেন ‘এই পতাকা আমার শত বাঙালীর একটি রূপকার’। বাংলা ও বাঙালীর সংগ্রামী অধ্যায়কে ধারণ করে হৃদয় খান শুনিয়েছেন ‘আমার আছে বাহান্ন, আমার আছে একাত্তর ... জন্মেছি এখানে, তাই হয়েছি ধন্য, বাংলাদেশ তোমারই জন্য’। আরেফিন রুমি গেয়েছেন ‘লাল-সবুজের বিজয় নিশান ছড়িয়ে দাও হাতে হাতে’। শত শিল্পীকে সঙ্গী করে পরিবেশনা উপস্থাপন করেন তাপস এ্যান্ড ফ্রেন্ড। তাদের পরিবেশনায়ও ছিল স্বদেশের বন্দনা। সব মিলিয়ে নৃত্য-গীতে সজ্জিত প্রায় দুই ঘণ্টার সাংস্কৃতিক পর্বটি ছিল মনোমুগ্ধকর। অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল ফায়ারওয়ার্কস। আতশবাজির খেলায় রঙে রঙে ঢেকে যায় শহরের এক অংশের অন্তরিক্ষ। আতশবাজির সেই আলোকরেখার মাঝেও প্রতিফলিত দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিত্র। সেই সুবাদে প্রাসঙ্গিকভাবেই উদ্ভাসিত হন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। প্রদর্শিত হয় প্রামাণ্যচিত্র। তথ্যচিত্রটির মাধ্যমে উপস্থাপিত মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সেই বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন এবং বাংলার মুক্তি সংগ্রামে তার অবদান। ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রামাণ্যচিত্রের উঠে আসে ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের জন্মকথা। সেই সূত্রে উঠে আসে মহান মুুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী নেতৃত্বে স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস। সেই জন্মকথায় ক্রমান্বয়ে বর্ণিত হয় বর্তমান সমৃদ্ধির সোপানে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের কথা। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার বেদনাদায়ক অধ্যায়টিও মেলে ধরা হয় তথ্যচিত্রে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আজকের দিনটি বিশেষ। সারা জাতি প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে। সেই প্রস্তুতিরই প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। জাতির পিতাকে আমরা অনেক উঁচুতে নিয়ে যাব। তিনি ছিলেন এক ক্ষণজন্মা মানুষ। এমন মানুষ সব সময় আসেন না। তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। দিয়েছেন আত্মপরিচয়ের ঠিকানা স্বাধীন বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে এগিয়ে দিয়েছেন সঠিক পথে। তার মননে সব সময় মিশেছিল বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ। তার চিন্তায় ছিল স্বাধীন দেশে শহর ও গ্রামের মাঝে তফাত থাকবে না। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাাকবে না। আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে দেখি, সব কাজের রূপরেখায় তৈরি করে রেখে গেছেন। এক্িট যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে উঠে দাঁড়ানোর সকল পরিকল্পনা করেছিলেন। আমরা হারিয়েছি সেই জাতির পিতাকে। এরপর অপেক্ষা করতে হয়েছে পিতার উত্তরাধিকার শেখ হাসিনার জন্য। একটাই লক্ষ্য, জাতির পিতা যে সোনার বাংলার লক্ষ্য আমাদের সামনে রেখে গিয়েছিলেন অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই কাজটিই করে যাচ্ছেন। আমরা আগে স্বপ্ন দেখতাম, আর এখন সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে। আমরা একসময় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দেশকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাব। ২০৪১ সালে ক্ষমতাধর টপ টোয়েন্টিভুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত হব। জাতির পিতার মতোই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধার কাছে আমাদের যে ঋণ সেই ঋণকে শোধ করব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আমরা যেখানে দেশকে রেখে যাব তরুণ প্রজন্ম শুরু করবে সেখান থেকে। শুধু বিশ্বাস রাখতে হবে, জাতির পিতা অমর। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জনের মাধ্যমে তিনি বেঁচে থাকবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মনোয়ার আহমেদ। মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, আমন্ত্রিত অতিথিসহ বিশিষ্টজনরা অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন।
×