ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাবি ছাত্রীর ধর্ষক শনাক্ত ও সারওয়ার আলী হত্যার চেষ্টাকারী গ্রেফতার এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ

অপরাধী ধরতে পুলিশ ডিজিটাল সিস্টেমে, দ্রুত সুফল মিলছে

প্রকাশিত: ১১:১২, ১২ জানুয়ারি ২০২০

অপরাধী ধরতে পুলিশ ডিজিটাল সিস্টেমে, দ্রুত সুফল মিলছে

শংকর কুমার দে ॥ পুলিশ অপরাধ দমনে ও অপরাধী শনাক্তকরণে ‘এনালগ’ থেকে চলে গেছে ‘ডিজিটাল’ সিস্টেমে। প্রযুক্তি নির্ভরশীলতায় সাফল্য অর্জন করেছে পুলিশ। বিশেষ করে, অপরাধী শনাক্তকরণ ও গ্রেফতারে মুখ্য ভূমিকায় ‘সিসি টিভির ফুটেজ’ ও ‘মোবাইল ফোনের কললিস্ট’। ক্লু লেস অপরাধ খুবই দ্রুত উদ্ঘাটনে সাফল্যের উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষিত ছাত্রীর ধর্ষককে শনাক্ত করে মজনু নামে এক মাদকাসক্ত ভবঘুরেকে গ্রেফতারের উদাহরণ এর সর্বশেষ প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলী হত্যা চেষ্টার ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনাতেও প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কুর্মিটোলায় ঢাবি ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় উদ্ধার ভিডিও ফুটেজ ও মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। প্রথমে ওই এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পরীক্ষা, পরে মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও ট্র্যাকিং পদ্ধতি অনুসরণ করে ধর্ষক মজনুকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। একইভাবে উত্তরায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডাঃ সারওয়ার আলীর বাড়িতে হামলাকারীদের গ্রেফতারের জন্য পলাতক গাড়িচালক নাজমুলের মোবাইল ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা। অতঃপর গ্রেফতার করা হয় দারোয়ান হাসান ও বর্তমান গাড়িচালক হাফিজকে। গত সপ্তাহে যে দুটি অপরাধের ঘটনা বহুল আলোচিত হয়েছে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই সে রহস্য উদ্ঘাটন করেছে পুলিশ। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আলামত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে পুলিশ আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্ষম। ঘটনাস্থল থেকে হাতের ছাপ বা শারীরবৃত্তীয় আলামত যেমন রক্ত, বীর্য, লালা বা অন্যান্য উপাদান সংগ্রহের উপকরণ ও কৌশল এখন থানা পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়েছে। ফলে মামলা উদ্নে এখন ফরেনসিক ও বায়োমেট্রিক আলামতের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। সূত্র মতেÑ সিসিটিভির ফুটেজ, মোবাইল ফোনের কললিস্ট তো আছেই, অপরাধের তদন্তের মোবাইল এ্যাপ্লিকেশন, ভেহিকল থেফট এ্যান্ড রিকভারি ডেটাবেজ, মেটাল ডিটেক্টর, ডিজিটাল সার্ভিলেন্স ক্যামেরা, ডিএনএ টেস্ট, কলট্র্যাকিং, ওয়াকিটকি, ইলেক্ট্রনিক ট্রাফিক সাইন বোর্ড, মোবাইল ট্র্যাকিং ইত্যাদি প্রযুক্তিসেবার মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা সহজ হচ্ছে। এখন ই-পুলিশ সিস্টেম নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত করতে উন্নত ধরনের মোবাইল ট্র্যাকিং পদ্ধতি বেশ প্রশংসা ও সাফল্য পেয়েছে। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমেই দ্রুততার সঙ্গে অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতারের জন্য পুলিশও প্রশংসা কুড়োচ্ছে। অপরাধ হলেই ওই এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ পরীক্ষা করা হচ্ছে। অর্থাৎ পুলিশ এনালগ সিস্টেম থেকে চলে আসছে ডিজিটাল সিস্টেমে। মোবাইল ফোনের ভূমিকা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কোথাও কোন অপরাধ ঘটামাত্রই শুরু হয় ওই এলাকায় ব্যবহৃত মুঠোফোনের ওপর নজরদারি। সেই মুঠোফোন মালিকদের থেকে বাছাই করা সন্দেহভাজনদের পরিচয় সম্পর্কে তথ্য নিয়ে খোলা হয় তদন্তের খাতা। কেউ হত্যার শিকার হলে তার মুঠোফোন নম্বর আগেই চলে যায় পুলিশের কব্জায়। শুরু হয় বিস্তর বিশ্লেষণ। মোবাইল ফরেনসিকের সব প্রযুক্তি এখন তাদের হাতে রয়েছে। একটি মুঠোফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে মুছে ফেলা তথ্যও তারা বের করতে পারেন। কোন অপরাধের শিকার বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির মুঠোফোন ব্যবহারের অভ্যাস জানলে তার চরিত্র সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা পাওয়া যায়। বর্তমানে তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করেই বেশিরভাগ মামলার তদন্ত করে। যেভাবে ট্র্যাকিং করা হয় বর্তমানে মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আর মোবাইল ফোনের প্রযুক্তি ব্যবহারকারী অপরাধী শনাক্ত করা খুব কঠিন কাজ নয়। যে এলাকায় অপরাধ হয়ে থাকে নির্ধারিত সে এলাকার মোবাইল টাওয়ারের মাধ্যমেই ঘটনার সময়ে থাকা মোবাইল ফোনগুলো চিহ্নিত করা হয়। পরে এসব মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করা হয়। এসব নম্বর থেকে সন্দেহভাজন মোবাইল নম্বরগুলো চিহ্নিত করে চলে তদন্তের কাজ। তবে কেউ মোবাইল ফোন থেকে সিম বদল করলেও ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি নম্বর দিয়ে সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করা সম্ভব। তবে অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন সন্দেহভাজন মোবাইল ফোনটি ব্যবহার বন্ধ থাকলে অপরাধীকে খুঁজে পেতে সময় লাগে। এক্ষেত্রে সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তির নিকটাত্মীয় কিংবা বন্ধুদের মোবাইল ফোনের ওপর নজরদারি চলে। দীর্ঘদিন পরে হলেও সন্দেহভাজন ব্যক্তির নিকটাত্মীয় কিংবা বন্ধুদের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করামাত্রই তাকে শনাক্ত করা হয়। এরপরই চলে সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তির অবস্থান শনাক্তের কাজ। গোয়েন্দা পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, অপরাধ ঘটামাত্রই এখন এলাকায় সিসি ক্যামেরা আছে কিনা, তার খোঁজা শুরু করা হয়। ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পরে অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে গাড়ির নম্বর চিহ্নিত করতে পারে এমন সিসি ক্যামেরা। আর কোথাও ক্যামেরা না থাকলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী সন্দেহভাজন ব্যক্তির চেহারা এঁকে ফেলার প্রযুক্তিও এখন পুলিশের কাছে। পুলিশ সদর দফতরের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, এতদিন পর্যন্ত কেবল নির্দিষ্ট সোর্স নির্ভর হয়ে পুলিশ কাজ করলেও এখন জনগণের সঙ্গে পুলিশের সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এখন জরুরী হেল্পলাইন ‘৯৯৯’ এ্যাপের মাধ্যমে স্থাপিত সম্পর্ক প্রযুক্তি নির্ভরশীলতা। ডিএমপির সিটি ইউনিটের এ্যাপ ‘হ্যালো সিটি’ ও র‌্যাবের ‘রিপোর্ট টু র‌্যাব’র ইতোমধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে তথ্য পেয়ে সংশ্লিষ্ট অপরাধী ধরতে সুবিধা পাচ্ছে পুলিশ। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধও বেড়েছে। আর তা দমনে ‘সাইবার পুলিশিং’ বাড়ানো হয়েছে। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, অপরাধী শনাক্তে পুলিশ গড়ে তুলেছে বিশাল তথ্যভা-ার। প্রায় একযুগ ধরে কারাগারে যাওয়া সব সন্দেহভাজনেরই আঙুলের ছাপ, ডিএনএ, আইরিশসহ পাঁচ ধরনের শনাক্তকারীর বৈশিষ্ট্য তথ্যভা-ারের সংগ্রহে রাখা হচ্ছে। এর সঙ্গে অপরাধী বা অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহ শনাক্তে ব্যবহৃত হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিশাল তথ্যভা-ার। ছদ্ম পরিচয়ে থাকা কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পরে আঙুলের ছাপ দেয়া মাত্রই জাতীয় তথ্যভা-ার থেকে উঠে আসছে তার আসল পরিচয়। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার কোন থানায়ও তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলে সেটি খুব অল্প সময়েই জানা যাচ্ছে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা বা হত্যার শিকার, পরিচয়হীন ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তেও আঙুলের ছাপ বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ঢাকা মহানগরে থাকা সব ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালার তথ্য সংগ্রহ করেছে পুলিশ। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বোমা উদ্ধার ও অপসারণেও যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। এখন বোমা নিষ্ক্রিয়করণ যন্ত্রপাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি অত্যাধুনিক রোবট। দূর নিয়ন্ত্রিত রোবটগুলো বোমা খোঁজা, নিষ্ক্রিয় করা থেকে শুরু করে দেয়াল ভাঙ্গা, সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো কাজও করতে পারে। পিটিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের দিন শেষ হয়ে গেছে, সময় এখন প্রযুক্তির। প্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত করলে সেটা যেমন নির্ভুল হবে, তেমনি মানুষও হয়রানির হাত থেকে বাঁচবে। অপরাধ দমন, নিয়ন্ত্রণ, ক্লু-লেস অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধী শনাক্তকরণ ও গ্রেফতারে পুলিশ এখন পুরোপুরি প্রযুক্তি নির্ভরশীল।
×