ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালানি তেল সঙ্কটের আশঙ্কায় ১৮ জেলা

নাব্য সঙ্কট ॥ যমুনায় ৬০ কার্গো আটকা

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ১২ জানুয়ারি ২০২০

নাব্য সঙ্কট ॥ যমুনায় ৬০ কার্গো আটকা

কৃষ্ণ ভৌমিক, পাবনা ॥ যমুনায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নাব্য সঙ্কটে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরমুখী প্রায় ৬০টি জ্বালানি তেল ও অন্য পণ্যবাহী কার্গো ও ট্রলার ডুবোচরে আটকা পড়েছে। এতে বন্দরের আমদানি-রফতানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অন্যদিকে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে তেলবাহী জাহাজ ভিড়তে না পারায় পেট্রোল সঙ্কটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিপিসির বাঘাবাড়ী ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানিতে ডিজেলের আপৎকালীন মজুদ রয়েছে মাত্র আড়াই কোটি লিটার। ওই পরিমাণ মজুত দিয়ে ৭-৮ দিনের চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। জানা গেছে, বাঘাবাড়ী নৌবন্দরমুখী যমুনা ও পদ্মা নদীর নৌচ্যানেলে গত কয়েকদিনের নাব্য সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। আরিচা মোহনগঞ্জ-মোল্লারচর পয়েন্টে পানির গভীরতা ৬-৭ ফুট দাঁড়িয়েছে। নৌচ্যানেলের এ নব্য সঙ্কটে চিটাগাং থেকে বাঘাবাড়ী বন্দরমুখী তেল ও পণ্যবাহী বড় বড় কার্গো জাহাজ আরিচায় এসে নোঙ্গর করতে বাধ্য হচ্ছে। নাব্য সঙ্কটে বড় বড় এ কার্গো জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে আরিচায় আটকা পড়ছে। সেখান থেকে লাইটার জাহাজে করে তেলসহ অন্য পণ্য খালাস করে বাঘাবাড়ী বন্দরের ৫-৬ কিলোমিটার দূরে মোহনগঞ্জ থেকে প্রতাপপুর পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে নাব্য সঙ্কটে আটকা পড়ছে। এসব লাইটার জাহাজের পণ্য আবার বিকল্প ব্যবস্থায় বাঘাবাড়ী বন্দরে নেয়া হচ্ছে। নাব্য সঙ্কটের কারণে এসব পণ্যে যেমন পরিবহন ব্যয় বাড়ছে তেমনি অনেক সময়ও লাগছে। তাই এসব কার্গো মাল খালাস করতে জাহাজ জটের সৃষ্টি হচ্ছে। দিনের পর দিন পণ্য খালাসের অপেক্ষায় জাহাজের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিটি জাহাজকে এজন্য ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত পণ্য খালাসের অপেক্ষায় অন্তত ৬০ জাহাজ আটকে আছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বিআইডব্লিইটিএ বেড়ার মোহনগঞ্জে যমুনার নৌচ্যানেল সচল রাখতে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ড্রেজিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নাব্য বজায় রাখার জন্য তারা কোন বিকল্প পদ্ধতি প্রয়োগ করছে না। অভিযোগ উঠেছে বিআইডব্লিউটিএর অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে নাব্য সঙ্কট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মোহনগঞ্জ পয়েন্টে ড্রেজিং করে পলিমাটি নিরাপদ দূরত্বে না ফেলে নদীতেই ফেলা হচ্ছে। এতে নদীতেই চর জেগে উঠছে। এছাড়া ড্রেজিং স্পয়েল ¯্রােতের টানে ভাটিতে জমে ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় নাব্য সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। এই অপরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারণে বিপুল পরিমাণ টাকার অপচয় শুধু হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যমুনা পাড়ের মোহনগঞ্জ গ্রামবাসী জানিয়েছে, ২০০৩ সালে বাঘাবাড়ী নৌপথে মারাত্মক নাব্য সঙ্কট দেখা দেয়। সে সময় ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি যমুনা নদীর দুই পাশে বিভিন্ন পয়েন্টে বাঁশের বাঁধ নির্মাণ করে তাতে তালাই বিছিয়ে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনা হয়। প্রশস্ততা কমে যাওয়ায় পানি নদীর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে পানির প্রবাহ ও স্রোতের গতি বেড়ে যায়। তাই নদীতে পলি জমতে পারে না। অন্যদিকে পানির উচ্চতা ও প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নদীতে নাব্য ফিরে আসে। বর্তমানে ড্রেজিয়ের পাশাপাশি অল্প খরচে বান্ডালিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে নদীতে নাব্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে সূত্র জানিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগ সূত্র জানায় ভারত থেকে আসা ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ এক সঙ্গে ধারণ করে যমুনা নদী বিশাল জলরাশি নিয়ে বিস্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান ছিল। তিস্তার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাবে যমুনা নদীতে নাব্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি না পেলে যমুনায় নাব্য সঙ্কট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এদিকে চলতি বোরো মৌসুমে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে তেলবাহী জাহাজ ভিড়তে না পারায় জ্বালানি সঙ্কটে সেচ কার্যক্রম ব্যাহতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাজশাহী ও রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা যায়, বোরো মৌসুমে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী টাংগাইল, ময়মনসিং ও জামালপুর জেলায় সেচের জন্য আট লাখ ৯৬ হাজার ৭৫টি সেচযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ডিজেল ও ৩০ শতাংশ বিদ্যুতনির্ভর। সেচ মৌসুমে ডিজেল চালিত ৮২৮টি গভীর নলকূপ, ছয় লাখ ৭৩ হাজার ৮৭০টি অগভীর নলকূপ, ১১ হাজার ৩৭৭টি শক্তিচালিত পাম্পের সাহায্যে সেচ কার্যক্রম চলে। আর এ জন্য প্রায় ৫৫ কোটি লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হবে। ডিজেল চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপো থেকে সরবরাহ করা হয়। জ্বালানি তেলনির্ভর বেড়ার ৭১ মেঘাওয়াট, বাঘাবাড়ীর ৫০ মেগাওয়াট, রাজশাহীর আমনুরা ৫০ মেঘাওয়াটসহ ৫টি বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। বিদ্যুতচালিত সেচপাম্পের রয়েছে দুই লাখ ১০ হাজার। এর জন্য বাড়তি বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে প্রায় ৮৪৩ মেগাওয়াট। উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা না গেলে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুত উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। সেই সঙ্গে এ অঞ্চলের সেচনির্ভর বোরো আবাদ ও উৎপাদনে চরম হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্ট এ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের জনৈক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাঘাবাড়ী অয়েল ডিপো থেকে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর জেলায় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। আরিচা-বাঘাবাড়ী নৌপথ জ্বালানি তেল, চাল, গম, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য মালামাল পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে উত্তরাঞ্চলে চাহিদার ৯০ ভাগ জ্বালানি তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। উত্তরাঞ্চলে প্রায় পাঁচ শতাধিক পেট্রোল পাম্প, তিন শতাধিক ডিলার এবং পাঁচটি ডিজেল চালিত বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র আছে। এছাড়া প্রায় তিন লক্ষাধিক বাস, ট্রাকসহ ডিজেল চালিত বিভিন্ন ধরনের যানবাহন রয়েছে। নাব্য সঙ্কটে আন্ডারলোড নিয়ে জ্বালানি তেল নিয়ে জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে আসছে। তিনটি কোম্পানিতে প্রতিদিনের চাহিদার তুলনায় জ্বালানি তেল আমদানি কম হচ্ছে। প্রতিদিনের ঘাটতি আপৎকালীন মজুদ থেকে পূরণ করা হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল সঙ্কটের আশঙ্কা রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ আরিচা সূত্রে জানা যায়, আরিচা-বাঘাবাড়ী নৌপথের মোহনগঞ্জ ও মোল্লারচরে পানির গভীরতা কমে ৬ থেকে ৭ ফুটে দাঁড়িয়েছে। পদ্মা ও যমুনা নদীতে প্রতিদিন পানি কমায় উত্তরাঞ্চলে জ্বালানি তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিআইডব্লিউটিএ কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ নৌচ্যানেল সচল রাখার জন্য মোহনগঞ্জ ও মোল্লারচর পয়েন্টে দুটি ড্রেজার পলি অপসারণ করছে। এদিকে বালির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ড্রেজিং করার পর ভাটিতে পলি জমে ডুবোচরগুলো আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে বলে এ সূত্র দাবি করেছে। বিপিসি বাঘাবাড়ী রিভারাইন অয়েল ডিপোর যমুনা কোম্পানির ম্যানেজার একেএম জাহিদ সরোয়ার জানান, বাঘাবাড়ীতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তিনটি তেল কোম্পানির ডিপোতে ২ কোটি ৫০ লাখ লিটার ডিজেল মজুদ আছে। নাব্যতা সঙ্কটে আন্ডারলোড নিয়ে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে আসছে। গড়ে প্রতিদিন ডিজেল সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ লিটার। পেট্রোলের মজুদ আশঙ্কাজনক অবস্থায় নেমে গেছে। ১-২ দিনের মধ্যে পেট্রোলবাহী জাহাজ ডিপোতে পৌঁছাতে না পারলে এ অঞ্চলে পেট্রোলের সঙ্কট দেখা দেবে। তবে ডিজেল সঙ্কটের কোন আশঙ্কা নেই বলে তিনি জানিয়েছেন।
×