ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৪৮ বছর আগের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি

লেজার শোতে বঙ্গবন্ধুর প্রতীকী আগমন, আবেগঘন মুহূর্ত

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ১১ জানুয়ারি ২০২০

 লেজার শোতে বঙ্গবন্ধুর  প্রতীকী আগমন,  আবেগঘন মুহূর্ত

মোরসালিন মিজান ॥ পরিত্যক্ত প্রায় বিমানবন্দর। সেখানে একটি প্রতীকী উপস্থাপনা। খুবই অল্প সময়ের। এরপরও অদ্ভুত ফিরে দেখা। বিভিন্ন বয়সী উৎস্যুক মানুষ। সবারই রোমকূপ জেগে উঠল। সবার ভেতরেই দোলা। হৃদয়ে শিহরণ। একটু পর পর তারা এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। শূন্য রানওয়ের দিকে স্থির দৃষ্টি। মুখে ‘জয় বাংলা/জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান। আর হাতে লাল-সবুজের পতাকা। এমন আবেগঘন মুহূর্তে রানওয়ের মাটি স্পর্শ করল স্মৃতি জাগানিয়া উড়োজাহাজ। না, বঙ্গবন্ধু আর নামলেন না। লাল গালিচা পাতাই ছিল। তার ওপর এক খ- আলো এসে পড়ল। বাঙালীর ভাগ্যাকাশে উদিত হওয়া চির এই আলোর নামই তো শেখ মুজিব! সারাজীবন বাঙালীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা মুজিব আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে এলেন। ক্রমে এগিয়ে গেলেন অপেক্ষারত জনসমুদ্রের দিকে। হাজার হাজার মানুষের জোড়া চোখ আকাশ থেকে নেমে আসা ধ্রুবতারাকে অনুসরণ করে চলল। কেউ স্মৃতি হাতড়ে আর কেউ কল্পনায় ঠিক আবিষ্কার করলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এভাবে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন শুক্রবার ফিরে যাওয়া হলো গৌরবোজ্জ্বল অতীতে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ভেসে উঠল চোখের সামনে। ২০২০ সালের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে ৪৮ বছর আগের ইতিহাস স্মরণ করল বাঙালী। তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরে বিশেষ এ ফিরে দেখার ব্যবস্থা করা হয়। একইসঙ্গে সূচনা করা হয় মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি’। আগামী ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। এদিন থেকে পরবর্তী বছরের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। এ সময়ের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। থাকবে আরও নানা কর্মসূচী। বছরব্যাপী উৎসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করবে কৃতজ্ঞ বাঙালী। তারই প্রাথমিক সূচনা বলা চলে শুক্রবারের আয়োজনটিকে। জাতির জনকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন উদ্যাপনের পাশাপাশি এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের ক্ষণগণনা শুরু করা হয়। রানওয়েতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন অসংখ্য কৌতূহলী মানুষ। অনেক আগে থেকেই আসতে শুরু করেন তারা। হাতে জাতীয় পতাকা। মুখে ‘জয় বাংলা/ জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান। দেখে মনেই হয় না, কোন প্রতীকী আয়োজন প্রত্যক্ষ করতে এসেছেন তারা। প্রতিক্ষার মাঝেই বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে অনুষ্ঠানস্থলে এসে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। আদরের ছোট বোন শেখ রেহানা ও সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়কে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকেন তিনি। এ সময় ডিজিটালস্ক্রিনে জাতির জনকের ছবি। সেখান থেকে কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল তাঁর। আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিংবদন্তি নেতা বলছিলেন, আমি জানতাম আমার বাঙালীকে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না...। দাবিয়ে রাখা যায়নি শেখ হাসিনাকেও। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী আসন গ্রহণ করার পর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। মাইকে জানানো হয় বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তটিকে এখন প্রতীকী উপস্থাপনা দেয়া হবে। ওমনি আকাশের দিকে তাকান সবাই। ৪টা ২৪ মিনিটের দিকে রানওয়ের মাটি স্পর্শ করে যুক্তরাজ্যের রয়েল এয়ারফোর্সের উড়োজাহাজ সি ওয়ান-থার্টি জে। একই এয়ারওয়েজের উড়োজাহাজে চড়ে স্বদেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তখন অমর শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান বেজে উঠেছিল। গানে গানে স্বাধীন শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানো হয়। এদিনও বেজে উঠে সন্ধ্যা মুখার্জীর কণ্ঠ। তিনি গেয়ে যান : বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়/তুমি আজ ঘরে ঘরে এত খুশি তাই/ কি ভাল তোমাকে বাসি আমরা/বলো কী করে বোঝাই...। অনেকেই গানের সঙ্গে সুর মেলান। আবিদুর রহমানের লেখা ও সুধীনদাস গুপ্তের সুর করা গান নতুন করে আপ্লুত করে। এরই মাঝে শূন্য রানওয়ের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে উড়োজাহাজ। ৪টা ৪৪ মিনিটে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। সকলের মধ্যে তখন দারুণ উত্তেজনা। উচ্ছ্বাস। সেদিনের মতোই একদল মানুষ পতাকা হাতে উড়োজাহাজের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় গোটা এলাকা। ৪টা ৪৮ মিনিটে উড়োজাহাজের দরজার সামনে ভেসে ওঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। লেজার রশ্মির মাধ্যমে তৈরি করা প্রতিকৃতি দৃশ্যমান হওয়া মাত্রই প্রধানমন্ত্রীসহ সকলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। শুরু হয় তোপধ্বনি। ২১বার তোপধনি করা হয়। ঐতিহাসিক দিনের মতোই মহান নেতাকে প্রদান করা হয় গার্ড অব অনার। এ সময় মাইকে উচ্চারিত হয়- হে বীর হে নির্ভয় তোমারই হলো জয়। বঙ্গবন্ধুও যেন হাত উঁচিয়ে নিজের দেশের মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসার জবাব দেন। এর পর আলোয় মিলিয়ে যাওয়া। সেই আলো লালগালিচার ওপর দিয়ে শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছে। জাতির পিতাকে সশস্ত্র সালাম জানায় সশস্ত্রবাহিনী। বেজে ওঠে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। গোটা দৃশ্যটি দেখে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। একাধিকবার চোখ মুছতে দেখা যায় তাকে। পরে ছোট বোন ও পুত্রকে নিয়ে মঞ্চে আসেন তিনি। বক্তৃতায় উল্লেখ করতে ভুলেন না, নিজের স্মৃতিময় দিনে ফিরে যাওয়ার কথা। তিনি বলেন, সেদিন (১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি) আসতে পারিনি। আজ আলোকবর্তিকা হয়ে এলেন জাতির জনক। প্রতীকী উপস্থাপনা দেখে আমি নিজেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমার মনে পড়ে গেল, সেদিন মা সর্বক্ষণ একটি রেডিও নিয়ে বসেছিলেন। ধারাবিরণী শুনছিলাম আমরা। আজ একই স্থানে এসে প্রতীকী উপস্থাপনা প্রত্যক্ষ করলাম। ইতিহাস তুলে ধরে এদিন বঙ্গবন্ধুকে অনুভব করার আহ্বান জানান তিনি। একই মঞ্চ থেকে ৫টা ১৮ মিনিটে মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। একটি ল্যাপটপ কম্পিউটারের সাহায্যে সূচনা করেন ক্ষণগণনার। প্রধানমন্ত্রীর আঙুলের স্পর্শে চালু হয়ে যায় ডিজিটাল ক্লক। সেখানে দেখা যায়, আর ৬৬ দিন পর শুরু হবে মুজিববর্ষ। মুজিবের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে এ সময় এক শ’ পায়রা ওড়ানো হয়। আকাশ ছেয়ে যায় রঙিন বেলুনে। একইভাবে মুজিববর্ষের লোগো উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। আগে থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হওয়া লোগো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। লোগোতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। পাশে বাংলায় ও ইংরেজীতে মুজিব শতবর্ষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে স্থাপিত এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রাম বর্ণনা করা হয়। ছিল বিভিন্ন অডিও ভিজ্যুয়াল পরিবেশনা। কিউআর কোডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে জন্মশতর্ষের শুভেচ্ছা ও বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন অনেকে। তবে এতসব আয়োজনের মধ্যেও একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বেদনা বুকে বেজেছে। প্রিয় নেতাকে, আহা যদি ফিরে পাওয়া যেত! যদি আজ বেঁচে থাকতেন তিনি, তাহলে কী আর এত কিছুর প্রয়োজন হতো? শিশুর মতো প্রবোধ দিতে হতো নিজেকে? ভাবতে ভাবতে মনটা হাহাকার করে ওঠে।
×