ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামগঞ্জে সাপখেলা ॥ বেদে সম্প্রদায় অন্য পেশায় ঝুঁকছে

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ১১ জানুয়ারি ২০২০

 গ্রামগঞ্জে সাপখেলা ॥ বেদে সম্প্রদায় অন্য পেশায় ঝুঁকছে

সাপুড়েদের নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গল্প, সিনেমা, ছড়া, কবিতা। সুকুমার রায়ের ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ পড়েননি এমন বাঙালী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সাপুড়েদের জীবিকার উৎস গ্রাম-গঞ্জে সাপ ধরা আর সাপের নাচ বা খেলা দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দেয়া। খেলা দেখানো ছাড়া সাপের বিষ এবং চামড়াও বিক্রি করেন তারা। এভাবে যে অর্থ আসে তা দিয়েই চলে সাপুড়েদের সংসার। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সাপুড়েদের সন্তানরাও সাধারণত সাপুড়েই হয়। জন্মের পর থেকেই ঘরে-বাইরে সাপ আর সাপের খেলা দেখে দেখে বড় হয় তারা। তাই একটু বড় হলে তারাও হাতে তুলে নেয় বীণ, দিনে দিনে তারাও হয়ে ওঠে পাকা সাপুড়ে। কয়েক বছর আগেও কাউকে সাপে কামড়ালে সাধারণ মানুষ ডাক্তারের কাছে না গিয়ে সাপুড়ে খুঁজতো। আজকাল বনাঞ্চল কমছে, সাপ কমছে, কমছে সাপুড়ের সংখ্যাও। পাশাপাশি চিকিৎসা বিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণের মাঝে সচেতনতাও বাড়ছে। ফলে সাপে কাটলে সাপুড়ে খোঁজার প্রবণতাও কমেছে অনেক। সাপুড়েরা দাবি করেন, তারা বীণ বাজালে বীণের সুরে মোহিত হয়ে সাপ নাচতে শুরু করে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, সাপের কান নেই। তাহলে? বীণ বাজালে বা চোখের সামনে হাত নাড়লেই সাপ দুলতে শুরু করে কেন? আসলে সাপের দৃষ্টিশক্তি প্রখর নয়। চোখের সামনে বীণ বা হাত যা-ই নাড়ানো হোক, তা ঝাপসাভাবে দেখে সে ভাবে, এই বুঝি শত্রু এলো। শত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই সাপ তখন দুলতে শুরু করে। দেশে দেশে বন্য প্রাণী রক্ষার উদ্যোগ জোরদার হচ্ছে। পরিণামে সাপুড়েদের প্রতিকূলতা বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে দুঃসময় আরও ঘনীভূত হচ্ছে সাপুড়েদের। এখনও যারা বংশগত এই আদি পেশায় আছেন, তাদের অনেকেই আর সন্তানদের সাপুড়ে হিসেবে দেখতে চান না। প্রজন্মের অনেকেই সাপুড়ে না হয়ে নির্মাণশ্রমিক হয়ে বা রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন। নদীমাতৃক বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়ের প্রতিটি বহরের সঙ্গে ‘সাপ’ ছিল তাদের একটা বিশেষ অংশ। তারা ছিল যাযাবর। জীবন চলার পথে বছরের কয়েক মাস কয়েকটি স্থানে ভ্রাম্যমাণ আশ্রয় স্থাপন করে তারা বসবাস করে। এরপর জীবিকা হিসেবে কেউ বানর, কেউ সাপ, কেউ বা অন্য কোন পেশায় নিযুক্ত থেকে বসবাসকৃত এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে বেদে-বেদেনীরা সাপ নাচিয়ে খেলা দেখাত। আবার তাদের পুরুষ সঙ্গীরা জীবিকা নির্বাহ করত সাপ, বানর কিংবা অন্য কোন কর্ম করে। এদিকে পুরুষ সাপুড়ে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে সাপ নাচিয়ে লোক জড়ো করে খেলা দেখিয়ে কিংবা ওষুধ বা তাবিজ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে কালের আবর্তে পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া সেই পেশা ছেড়ে তারা এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে এখন আর আগের মতো গ্রামের মেঠোপথে কিংবা হাট-বাজারে এসব খেলা দেখিয়ে মানুষের জটলা আর দেখা যায় না। বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন পূর্বে ভাসমান জীবনযাপন করলেও বর্তমানে নদ-নদী, খাল-বিল চলাচল অনুপযোগী হওয়ায় নৌকায় অবস্থান না করে বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী ও অস্থায়ী আবাস গড়ে তুলছে। কমে আসছে তাদের সংখ্যাও। তবে হাটবাজারে প্রদর্শিত সাপ খেলার মূল উদ্দেশ্য সাপ খেলা নয়। অন্তরালে থাকে সাপ বশীকরণ তাবিজ বা ওষুধ বিক্রি। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অবাধ অগ্রগতিতে তাবিজ বা গ্রামীণ ভেষজের প্রতি বিশ্বাসেও চিড় ধরেছে সাধারণ মানুষের। সাপের খেলার উদ্দেশ্য বা অন্তরালের লক্ষ্য যাইই থাকুক, গ্রামীণ বাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে সাপ খেলা। এখন আর হাটবাজারে জটলা থাকে না সাপ খেলাকে ঘিরে। খুব একটা চোখে পড়ে না মনষা পালাও। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আশঙ্কা, খুব তাড়াতাড়িই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী সাপ খেলা। গাজীপুর থেকে মীরসরাই এর জোরারগঞ্জ বাজারে সাপ খেলা দেখাতে আসা সাপুড়ে জিওম আলী (৩৩) জানান, সাপের বিষ দিয়ে অনেক দুরারোগ্য রোগ সারার ওষুধ তৈরি হয়। এগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাদের অনেকে সাপের বিষাক্ত ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে। তিনি আরও জানান, সাপ ধরার কোন মন্ত্র নেই। আছে বুদ্ধি, সাহস আর কলা-কৌশল। সাপ ধরার সময় কোন চালের ব্যত্যয় ঘটলে তাকে প্রাণ হারাতে হয়। আর তাবিজে বিভিন্ন গাছ-গাছড়া থাকে। গাছ-গাছড়ার দ্রব্যগুণ আছে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তাই আমরা এগুলো বিক্রি করে, বিভিন্ন হাট-বাজারে বীণ বাজিয়ে সাপের নাচ দেখিয়ে দর্শক মাতাই এবং তাবিজ বিক্রি করে দিনে ২-৩ শত টাকা আয় করে চালাতে হয় নিজ সংসার। -রাজিব মজুমদার, মীরসরাই চট্টগ্রাম থেকে
×