ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১১ জানুয়ারি ২০২০

গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের

১৯৭১-এর নবেম্বরের এক সকাল। আবির তখনও ঘুমে। স্কুল নেই। যুদ্ধ শুরুর পরপরই বাবা-মার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি বরলিয়ায় চলে আসে আবির। পড়া লেখা নেই। আবির চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ও বেশ মজাতেই আছে। শহরের বন্দী জীবন থেকে গ্রামের মুক্ত হাওয়ায় সে যেন এক মুক্ত পাখি। সারাদিন এ বাড়ি ও বাড়ি চষে বেড়ায়। গ্রামের ছেলেদের শহরের ছেলের সঙ্গে মিশতে প্রথমে জড়তা থাকলেও আবির ওদের আপন করে নেয়ায় ওরা নিজেরাই আবিরকে এখন খেলাধুলায় ডেকে নেয়। ওদের মধ্যে সোহরাব ওর খুব কাছের। গ্রামের আলপথে হাঁটা, পুকুরের ঘাটে কিভাবে নেমে মুখ ধুতে হয় সব কিছু শিখিয়ে দেয়ার দায়িত্ব যেন সোহরাবের। আবির ঘুম থেকে দেরিতে ওঠে, তাই সোহরাব ও ওদের বাড়ি দেরিতে আসে। সোহরাবের বাড়ি আবিরদের একটি বাড়ি পরে। ১৯৭১ এর নবেম্বরের সকালে সকাল সকাল সোহরাব আবিরদের বাড়িতে এসে হাজির। আবিরের আম্মুও সোহরাবকে পছন্দ করেন। কিন্তু আজ এত সকালে আসাতে তিনি মনে মনে একটু রাগ করলেন যদিও মুখে প্রকাশ করলেন না। অবাকও হলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই আবিরের বাবা ওদেরকে শহরের বাসা থেকে গ্রামে নিয়ে আসে। গ্রামেগঞ্জে আবিরের বাবার ব্যবসা। ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর পরে আবিরকে বাবা শহরের বাসা চন্দনপুরা থেকে গ্রামে নিয়ে আসেন। গ্রামে স্কুল না থাকায় আবিরের বাবা, মা ও আবিরকে শহরে বাসা ভাড়া করে শহরের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। মার্চ মাসের পর প্রতিদিন আবিরের বাবা মাথায় টুপি দিয়ে বুকে পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকা এঁটে গঞ্জের দোকানে যান। তবে মাসখানেক হয় তাদের পাশের গ্রাম সারোয়াতলী মুক্তিযোদ্ধারা দখল নেয়াতে এখন পাকিস্তানের পতাকা খুব একটা বুকে না লাগালেও মাথায় টুপি পরেন। বলা তো যায় না কখন হিন্দু বলে তাকে সন্দেহ করে। আজ এত সকাল বেলায় সোহরাব আবিরদের বাড়িতে আসায় সোহরাবকে আবিরের আম্মু জিজ্ঞেস করেই ফেললেন ‘বাবা আজ এত সকালে এলে যে? আবির এদিক সেদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল’ চাচি আমাদের বাড়িতে মুক্তি বাহিনী এসেছে পাঁচ ছয়জন হবে প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র, ওরা বাবার সঙ্গে কাচারি ঘরে বসে চা খাচ্ছে আর বলছে আজ রাতে অপারেশন আছে। এলাকার এক কুখ্যাত ডাকাত সর্দার নাকাইয়া, যে মিলিটারিদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে তাকে ধরে এনে ক্যাম্পে রেখেছে। আরও কি সব যেন বলছে। রাতে অপারেশনে ডাকাত নাকাইকে নিয়ে যাবে দুই গ্রাম পর আলিম রাজাকারের বাড়িতে। সেখানে নাকি বিকেলে মিলিটারিরা আসবে এক পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনসহ। আজ জুমার দিন ওরা জুমার নামাজ আপনাদের বাড়ির মসজিদে আদায় করবে’-এই কথাগুলো বলে সোহরাব হাঁপাচ্ছে। ওর কিশোর চোখ এই প্রথম অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনী দেখে কিছুটা বিস্ময় কিছুটা শিহরণে হতবিহবল। মুক্তি বাহিনীর কথা সে বাবার সঙ্গে রাতে চুপি চুপি বসে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ শুনেছে, তাই সে অবাক। আবিরের মা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। বাড়িতে ওর বাবা পাকিস্তানী ও বাংলাদেশের পতাকা দুটিই রেখেছেন। তিনি তাড়াতাড়ি পাকিস্তানের পতাকা লুকিয়ে রাখলেন। সোহরাবকে মুড়ি ও মোয়া খেতে দিলেন। এবার মোয়ামুড়ি খেতে খেতে সোহরাব আবার বলল ‘মুক্তি বাহিনী আপনাদের বাড়িতেও আসবে। দুপুরের খাবার খাবে।’ একথা শুনে আবিরের মা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। গঞ্জে যাওয়ার জন্য আবিরের বাবা তৈরি হচ্ছিলেন। তাঁকে কি জানি বললেন। আবিরকে ডেকে তুললেন। সোহরাব কিছুই বুঝতে পারছে না। আবির দু’হাত চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে সোহরাবের সামনে এলো। মা মুখ ধুয়ে আসার জন্য একটু ধমক দিলেন। আবির মুখ ধুয়ে আসতে না আসতেই আবিরদের কাচারির সামনে থেকে সোহরাবের বাবার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। তিনি আবিরের বাবাকে ডাকছেন। হন্তদন্ত হয়ে আবিরের বাবা বের হয়ে আসলেন। দেখলেন ৪/৫ জন যুবক কারও পরনে পেন্ট কারও পরনে লুঙ্গি হাতে চকচকে অস্ত্রসহ সঙ্গে সোহরাবের বাবা। যুবকরা আবিরের বাবাকে পায়ে ধরে সালাম করল। সালাম করার পর ওদের মধ্যে কামাল নামের একজন বললো ‘চাচা আমরা মুক্তি বাহিনী। পাশের মুক্ত স্থানে থাকি’ দুই ইউনিয়ন পর বরকল গ্রামের দফাদার বাড়িতে আজ পাকিস্তানী বাহিনীকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। রাজাকার দফাদারের ডানহাত ডাকাত নাকাইকে আমরা ধরে ফেলেছি। আজ রাতে ও সহ অপারেশনে যাব। দুপুরে আপনার এখানে খাব। দেশ স্বাধীন হতে খুব দেরি নেই। ভয় পাবেন না। জুমার নামাজ পড়ে খেয়ে আমরা চলে যাব’ আবিরের বাবা যথাসম্ভব শান্তভাব বজায় রেখে বললেন ‘না বাবারা আপনারা বসেন। আমাদের কোন অসুবিধা নেই।’ ওদের কাচারিতে বসতে দিয়ে আবিরের বাবা বাড়ির ভেতরে গেলেন ওদের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে। আজ আর গঞ্জে যাওয়া হলো না। তাঁর বুকের ভেতর ভয় আবার আনন্দও। মুক্তি বাহিনীরা দেশ স্বাধীন হওয়ার কথা বলেছে। আবির মুখ ধুয়ে মুড়ি মোয়া খেয়ে সোহরাবসহ কাচারি ঘরে উঁকি দিচ্ছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবা হারিকেন এর আলো ছোট করে রেডিও হাতে নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে ‘আকাশ বাণী’ ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ শোনেন। সেখানে আবির ও মাঝে মাঝে থাকে। রেডিওতে সে মুক্তি ফৌজ, মুক্তি বাহিনীর নাম শুনেছে। ওরা যুদ্ধে কতজন পাকিস্তানী সৈন্য মেরেছে কোন এলাকা দখল করেছে এসব শুনেছে। এখন দেখছে সত্যিকারের মুক্তি। আবিরের অবুজমনে নানা প্রশ্ন? এরা কি করে যুদ্ধ করে? পাশে রাখা বন্ধুক থেকে কিভাবে গুলি ছোঁড়ে? দেশ স্বাধীন হবে তো? আবির আর সোহরাবকে কাচারিতে বসা মুক্তিযোদ্ধারা দেখে ফেলে। ভিতরে ইশারায় কাছে ডাকে। মুচকি হেসে বলে ‘জয় বাংলা’ বলতে পারো? দু’জনই জোরে ‘জয় বাংলা’ বলে উঠে। কামালসহ অন্য মুক্তিযোদ্ধারা হাত তালি দিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে ওঠে। চা নাস্তা খাওয়ার পর সময় গড়িয়ে জুমার নামাজের সময় হয়ে যায়। মসজিদে মুসল্লিরা আসতে থাকে। আবির ইতোমধ্যেই জেনে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। ওরা নিজেরাই নাম বলে করিম , আশরাফ, রহমান, রহিম, কামাল রইস। কামাল ওদের কমান্ডার। মুক্তিরা অস্ত্র পাশে রেখে অজু করে অস্ত্রসহ মসজিদে নামাজের জন্য ঢোকে। গ্রামের মুসল্লিরা চুপচাপ। আশঙ্কা ও আশা দুটোই সবার ভেতর কাজ করছে। কেউ বলছে না কিন্তু ভাবছে কি হবে? দেশ স্বাধীন না হলে মিলিটারিরাতো এই গ্রাম ধ্বংস করে দেবে। এরি মধ্যে হুজুর জুমার খুৎবা শুরু করেছেন। খুৎবার মাঝখানে হঠাৎ কমান্ডার কামাল দাঁড়িয়ে গেলেন। হুজুরকে উদ্দেশ্য করে বল্লেন ‘হুজুর হুকুমতে বাংলাদেশ বলেন।’ হুজুরসহ সবাই ভীত। কিন্তু নির্দেশ মানতে হবে। কাঁপা কাঁপা গলায় বড় করে হুজুর খুৎবায় পাঠ করলেন ‘হুকুমতে বাংলাদেশ’। বড় হয়ে আবির পরে জেনেছে জুমার খুৎবায় হুকুমত বলতে হয় অর্থাৎ কোন দেশের অধীনে আমরা বসবাস করি। নামাজ শেষে খেয়ে দেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চলে যায়। বাংলাদেশের হুকুমত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য বরলিয়া গ্রামের মুসল্লিরা অপেক্ষা করতে থাকে।
×